জলবায়ু পরিবর্তন -ক্ষতিপূরণ ও আমাদের কীর্তিকলাপ by ফারুক মঈনউদ্দীন

সীতাকুণ্ডের ঘোড়ামারা উপকূলের সবুজবেষ্টনীর টিকে থাকা অবশিষ্ট কেওড়াগাছগুলো যে রাতে নিধন করা হয়, সেই সকালে শেষবারের মতো গাছগুলো দেখে আসার সুযোগ হয়েছিল এই পত্রকারের। দুপাশে বিশাল সব আধাভাঙা দৈত্যাকার জাহাজের মাঝখানে নিতান্ত অপরাধীর মতো টিকে থাকা একচিলতে জায়গাজুড়ে দীর্ঘকায় গাছগুলো বিরান সৈকতের দিক থেকে ধেয়ে আসা সকালের হাওয়ায় খুব কষ্টে নিঃশ্বাস নিয়ে দাঁড়িয়ে যেন মৃত্যুর প্রহর গুনছিল। তার ছায়াময় বেলাভূমিতে খেলায় মগ্ন জেলেবস্তির একদল কিশোরী তখনো জানে না, ওদের আজন্ম পরিচিত গাছগুলোর আসন্ন বিপদের কথা। ওদের কারও মা আগাম শীতের আভাসে গায়ে চাদর জড়িয়ে পথের পাশে বসে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন ভাটাপড়া সমুদ্রের হালকা নীল জলরাশির ওপারের অসীম দিগন্তের দিকে। তাঁর দৃষ্টির কিনারাঘেঁষে বিরান সৈকতের বুক খুঁড়ে ঢালাই হচ্ছে ইয়ার্ডের জন্য উইঞ্চ (ভারি বস্তু টেনে আনার জন্য শক্তিশালী যন্ত্র)। সেই সকালে জেলেপাড়ার কোনো ঘর থেকে ভেসে আসে ঢোল আর কাঁসরের শব্দ, গঙ্গাপূজা হবে হয়তো।
২০ বছর ধরে এই এলাকার উপকূল ঘিরে ১২৫ একর জায়গার ওপর যে সবুজবেষ্টনী তৈরি করেছিল বন বিভাগ, তার মূল লক্ষ্য ছিল ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাস থেকে এলাকার মানুষ ও সম্পদ রক্ষা করা। এলাকাটি একসময় যখন ভাঙনের কবলে পড়ে প্রায় বিলীন হতে বসেছিল, তার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এই সবুজবেষ্টনীর প্রতি স্থানীয় কারোই কোনো দরদ না থাকার বিষয়টা রীতিমতো বিস্ময়কর। অথচ এই সবুজবেষ্টনীর কারণে কেবল যে ভাঙন রোধ হয়েছে তা নয়, জেগে উঠছিল নতুন চর, ভারসাম্য ফিরে পাচ্ছিল এলাকার জীববৈচিত্র্য, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছিল এলাকাবাসী। বনের পশুও তার আত্মরক্ষার উপায় ও কৌশল এবং তার প্রতি প্রকৃতির সহজাত সুরক্ষার বিষয়ে সচেতন। সেদিন গ্রামের যেসব সহজ, হতদরিদ্র ও অশিক্ষিত মানুষ সামান্য অর্থের প্রলোভনে এরকম একটা গর্হিত কাজে নিয়োজিত হয়, তারা যদি জানত, যে কুড়াল দিয়ে তারা গাছগুলোকে হত্যা করেছে সে কুড়াল আসলে তারা মারছে নিজেরই পায়ে, তাহলে হয়তো নিধনকর্মটা এমন সহজ হতো না। তারা তাদের ভুল বুঝতে পারবে, যখন ধেয়ে আসবে আরেকটি ঘূর্ণিঝড় কিংবা জলোচ্ছ্বাস, বৃক্ষহীন উপকূল পেরিয়ে ছুটে আসবে হার্মাদের মতো বাতাস আর নিশ্চিহ্ন বেড়িবাঁধের জায়গা ছাড়িয়ে তেড়ে আসবে উন্মত্ত জলরাশি, ভাসিয়ে নিয়ে যাবে উপকূলের গ্রামগুলো। পৃথিবীর দেশে দেশে দেখা যায়, পরিবেশের ভারসাম্যবিরোধী যেকোনো প্রকল্পের বিরোধিতা করে স্থানীয় জনগণ। শত প্রলোভন কিংবা হুমকিতে পিছপা হয় না তারা। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগা দেশ, আমরা তার দুর্ভাগা জাতি বলে এরকম কোনো প্রতিরোধ বা বিরোধিতার আলামত দেখা যায়নি সেদিন। হয়তো অন্য সব ক্ষেত্রেই এরকমই ঘটে।
জাহাজভাঙা শিল্প আমাদের অর্থনীতির বর্তমান বাস্তবাতায় প্রয়োজনীয়—একথা স্বীকার করলেও পরিবেশের ভারসাম্য এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষার অত্যাবশ্যকীয়তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। বিশ্বের সব দেশে যেকোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে পরিবেশ বিনষ্ট হয়, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ হয়। এই সমর্থন ও বিরোধিতার সংশ্লেষণে নির্ধারিত হয় কোনো প্রকল্পের উপযোগিতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে ভবিষ্যত্ও। প্রতিবেশী দেশ ভারতের নর্মদা নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণের সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে লড়ে সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছেন মেধা পাটকর। ব্রাজিলের আমাজন রেইন ফরেস্টের বুক চিরে তৈরি দীর্ঘ পাঁচ হাজার ৩০০ কিলোমিটার ট্রান্স আমাজন হাইওয়ের বিরুদ্ধে পরিবেশবাদীরা ছিলেন সরব, কারণ দুর্গম অরণ্যসংকুল প্রকল্পটির কারণে সেখানে ঘটেছে বিভিন্ন ধরনের পরিবেশ বিপর্যয়, ব্যাহত হয়েছে জীববৈচিত্র্য। সীতাকুণ্ড উপকূলের সবুজবেষ্টনীটি সে তুলনায় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, অথচ সেটির ধ্বংসের বিরূপ প্রতিক্রিয়া আরও ব্যাপক।
সীতাকুণ্ড উপকূলের ঘটনাটির বিষয় অবশ্য একটু ভিন্নতর। এটি কোনো সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প নয়। ব্যক্তিমালিকানাধীন জাহাজভাঙার ইয়ার্ড তৈরি করার জন্য প্রয়োজন হয় উপকূলবর্তী জমির। তার জন্য উপকূলের জায়গা ইজারা নিতে হয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। কর্তৃপক্ষ শর্তসাপেক্ষে দায়সারা একটা অনুমতি দেয়। এই শর্তটি সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। শর্তটি হচ্ছে ইয়ার্ড করা যাবে, তবে গাছ কাটা যাবে না, অথবা গাছ থাকলে সেখানে ইয়ার্ড করার অনুমতি দেওয়া যাবে না। অর্থাত্ গাছ না থাকলে অনুমতি দেওয়া হবে। আর এই শর্তটি কাজে লাগায় বিশেষ স্বার্থান্বেষী মহল ও আগ্রহী ইয়ার্ড মালিকেরা। এই গোলমেলে ও ছিদ্রযুক্ত শর্তটিই এভাবে বৃক্ষনিধনের অজুহাত এবং উত্সাহ জোগায়। অবৈধভাবে খাস জমির গাছ কেটে জায়গাটি কেটে সাফ করে ফেললে অনুমোদনদানকারী কর্তৃপক্ষ অম্লানবদনে বলতে পারবে, সেখানে কোনো গাছ ছিল না বলে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, গাছ থাকলে কখনোই দেওয়া হতো না। এখন অনুমতি দেওয়ার প্রক্রিয়াটি যদি বদলানো যায়, যদি সরেজমিনে তদন্ত করে, প্রভাবমুক্ত অবস্থায় স্থানীয় জনগণের মতামত নিয়ে যদি জানা যায় নির্দিষ্ট জায়গাটিতে কখনোই কোনো বৃক্ষ ছিল না, সবুজবেষ্টনী গড়া হয়নি—তাহলেই কেবল অনুমোদন দেওয়া হবে, তাহলে এজাতীয় দুর্বৃত্তায়নের সুযোগ থাকে না। সরকারের উপকূলবর্তী যে খাস জায়গাগুলো আছে, যেগুলোতে বন বিভাগের সবুজবেষ্টনী গড়া হয়েছে সেগুলো কিংবা তার পেছনের জায়গা উপজেলা প্রশাসনের হাতে দেওয়ার কোনো যুক্তি নেই, এটা অনেকটা শেয়ালের কাছে মুরগি গচ্ছিত রাখার মতো। অবশ্য বন বিভাগের হাতে জায়গাগুলো থাকলেও যে খুব একটা ইতরবিশেষ হতো তা বলা যায় না। সুন্দরবন, লাউয়াছড়া কিংবা চুনারুঘাটের রেমা-কালেঙ্গা সংরক্ষিত অরণ্যে বৃক্ষদস্যুদের দৌরাত্ম্যের কথা পত্রিকার খবরেই পাওয়া যাচ্ছে। তবুও বনসৃজনের পর সেটা সত্মায়ের হাতে তুলে না দেওয়াই ভালো। সীতাকুণ্ডের ঘটনায় বন বিভাগ বনাম দুর্বৃত্তদের সঙ্গে উপজেলা প্রশাসনও আজ মুখোমুখি।
ইয়ার্ড তৈরি এবং ধ্বংসের ঘটনাটি এতখানি আলোড়ন তুলত না, যদি ব্যাপারটা নিয়ে কর্তৃপক্ষের চোর-পুলিশ খেলার মনোভাব না থাকত। জাহাজভাঙা শিল্পে একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা এবং সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনার অভাবে নীতিবর্জিত মহল বারবার একই কৌশলে পার পেয়ে যাচ্ছে, আর বিবেকবান মানুষ হচ্ছে দিকভ্রান্ত ও হতাশ। পরিবেশ রক্ষা বিষয়ে জাহাজভাঙা শিল্পে দিকনির্দেশনা দেওয়া আদালতের নির্দেশ আজ পর্যন্ত প্রতিপালিত হয়নি। সীতাকুণ্ডের ঘটনায় স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সহায়তা না পাওয়ায় বনমন্ত্রীর সাহায্য চাইতে হয়েছে, অথচ প্রাথমিক দায়িত্বটি ছিল আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিতদের। সেদিন পুলিশ তার দায়িত্ব পালন করেনি, দায়িত্ব পালন করেনি স্থানীয় জনগণও, অথচ রাতের অন্ধকারে গাছগুলো যে কেটে নেওয়া হবে সে খবর নাকি এলাকার সব লোকই জানত। পরিবেশ রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী স্থানীয় মানুষের তরফ থেকে কোনো প্রতিরোধ বা প্রতিবাদ ওঠেনি, হয়তো তারা প্রভাবশালী মহলের পেশিশক্তির কাছে ছিল অসহায় কিংবা সবুজবেষ্টনী এবং পরিবেশের চেয়েও তাদের কাছে শ্রেয়তর জাহাজভাঙা শিল্পের উচ্ছিষ্টভোগী হওয়া। কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে মন্ত্রী এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে প্রধানমন্ত্রীকে বলতে হয়, ‘কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ অথচ কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা আইনেই বলা আছে, তার জন্য মন্ত্রীকে হুঁশিয়ারি বা নির্দেশ দিতে হয় না। সেদিন সীতাকুণ্ডের ঘটনায় সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রশংসনীয় ভূমিকা ছাড়া আর কারও ভূমিকা দেখা যায়নি। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো কেবল আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানিয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করেছে, কিন্তু তাতে প্রলয় বন্ধ হয়নি।
জাহাজভাঙা শিল্পকে বন্ধ বা অবাঞ্ছিত ঘোষণা করার কোনো অবকাশ নেই বলে পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থাপনার জন্য এ শিল্পের জন্য পৃথক এলাকা চিহ্নিত করে দিতে হবে সরকারকেই। সীতাকুণ্ড-কুমিরা উপকূলে যদি জাহাজভাঙা শিল্প রাখতেই হয়, তাহলে বিচ্ছিন্নভাবে যদি দূরে দূরে তা করা যায়, তার ফাঁকে ফাঁকে রক্ষা করা যায় সবুজবেষ্টনী, তাতে কিছু মাত্রায় বজায় রাখা যাবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। আমাদের সহজাত অসচেতনতা এবং ছিদ্রযুক্ত আইনের কারণে যাতে সুদূরপ্রসারী বিরূপ প্রভাব প্রকৃতির ওপর না পড়ে তার জন্য স্থানীয় জনগণ, পরিবেশবাদী সংগঠন এবং এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত উদ্যোক্তাদের সম্পৃক্ত করে প্রয়োজনীয় এবং যুগোপযোগী নীতিমালা তৈরি করতে হবে। আর, সীতাকুণ্ড উপকূলে যে ঘটনা ঘটে গেছে তার সবচেয়ে যোগ্য প্রতিকার হবে যদি কেটে ফেলা গাছগুলোর জায়গায় আদৌ আর ইয়ার্ড তৈরির অনুমতি দেওয়া না হয় এবং সেখানে আবার বনসৃজন করা হয়।
আসন্ন কোপেনহেগেন সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশ নাকি ৭০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ চাইবে। কিন্তু যাঁদের কাছে এই সহায়তা চাওয়া হবে তাঁদের দূতরা কি আমাদের পত্রিকা পড়ে আমাদের আত্মঘাতী বননিধন, নদীভরাট এবং পরিবেশদূষণ সম্পর্কিত কীর্তিকলাপ সম্পর্কে সম্যক অবহিত নন? আমরা জানি, আল্লাহ সে জাতিকে সাহায্য করেন, যে জাতি নিজেকে নিজে সাহায্য করে। আমরা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি যে আমরা নিজেদের সাহায্য করছি?
ফারুক মঈনউদ্দীন: ব্যাংকার।
fmainuddin@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.