মানহানির মামলা -গ্রেপ্তারি পরোয়ানার বিধান বাতিলকে স্বাগত জানাই

সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে দণ্ডবিধির ৫০০, ৫০১ ও ৫০২ ধারা সংশোধন করে মানহানি মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সরাসরি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির বিধান বাতিল করার যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তাকে আমরা স্বাগত জানাই। উল্লিখিত ধারায় যেকোনো ব্যক্তি মানহানির মামলা করলে আদালত আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে পারতেন। ঔপনিবেশিক আমলে প্রণীত যেসব ফৌজদারি আইনের যথেচ্ছ ব্যবহার হয়ে আসছে, এটি তার মধ্যে অন্যতম। সংবাদপত্র তথা সাংবাদিক-সমাজের উদ্বেগের বাড়তি কারণ হলো, সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধের হাতিয়ার হিসেবে এর সর্বাধিক স্বেচ্ছাধীন প্রয়োগ।
দেখা গেছে, সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবেদন ছাপা হলে তাঁরা প্রকাশ্যে হুমকি-ধমকি দেওয়া ছাড়াও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা ঠুকে দেন। আর এসব মামলায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সম্পাদক, প্রকাশক ও সাংবাদিকেরাই হয়রানির শিকার হন। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিক ইউনিয়ন ও সংবাদপত্রসেবীরা প্রতিবাদও জানিয়ে আসছিলেন। দেরিতে হলেও বর্তমান সরকারের দণ্ডবিধির সংশ্লিষ্ট ধারা থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির বিধান বাতিল করার নীতিগত সিদ্ধান্ত সংবাদপত্রসেবীদের জন্য সত্যিই স্বস্তিদায়ক খবর। তবে মন্ত্রিসভায় নীতিগত সিদ্ধান্ত হলেও ফৌজদারি কার্যবিধি (সংশোধন) আইন, ২০০৯ আইন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক ভাষায় রূপান্তরের অপেক্ষায় আছে। আমরা আশা করি, অবিলম্বে এটি আইনে পরিণত হতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, যেকোনো অগণতান্ত্রিক আইন ও নিয়ন্ত্রণের প্রথম শিকার হয় সাংবাদিক-সমাজ। সংবাদ পরিবেশনে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি নীতিমালা আছে। সে নীতিমালা কেউ লঙ্ঘন করলে তার বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি প্রেস কাউন্সিলে যেতে পারেন। সেখানে প্রতিকার না পেলে তিনি বা তাঁরা ফৌজদারি আদালতের আশ্রয় নিতে পারেন। অথচ প্রভাবশালী ব্যক্তিরা প্রেস কাউন্সিলকে পাস কাটিয়ে প্রায়ই ফৌজদারি মামলার আশ্রয় নেন, যা সত্ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার ওপর হস্তক্ষেপ ছাড়া কিছু নয়।
নব্বইয়ে স্বৈরাচারের পতনের পর বিশেষ ক্ষমতা আইনের সংবাদপত্রসংশ্লিষ্ট ধারাগুলো বাতিল হওয়ায় গণমাধ্যমসেবীরা এই ভেবে স্বস্তি বোধ করেছিলেন—এখন আর সরকার নির্বাহী আদেশে কোনো পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দিতে পারবে না। তত্কালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ কাজটি করেছিলেন। এ জন্য সংবাদপত্রসেবীরা তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। দণ্ডবিধির ৫০০, ৫০১ ও ৫০২ ধারা সংশোধন করা হলে সংবাদপত্রসেবীসহ সব নাগরিক অযথা হয়রানি থেকে রেহাই পাবেন। তবে সাংবাদিকদের দায়িত্বশীলতা ও পেশাদারি মনোভাবের বিষয়টিও একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখা প্রয়োজন, সাংবাদিক বা সংবাদপত্রের দায়িত্বহীন আচরণ কোনো ব্যক্তিজীবনকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলতে পারে। ফৌজদারি দণ্ডবিধি সংশোধনের পাশাপাশি সাংবাদিকরাও পেশাদারি দায়বদ্ধতার ব্যাপারে আরও সচেতন থাকলে এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে আশা করি।

No comments

Powered by Blogger.