ওসি রফিককে ঘিরে সিলেটে এত বিতর্ক by ওয়েছ খছরু
সিলেটের গোয়াইনঘাটে মাত্র ৮ মাস দায়িত্বে ছিলেন ওসি রফিকুল ইসলাম। বলা হচ্ছে; এই সময়ে তিনি এক থানা থেকেই শত কোটি টাকার বাণিজ্য করে গেছেন। বস্তা বস্তা টাকা গোয়াইনঘাট থেকে সিলেটে নিয়ে আসতেন। ৫ই আগস্ট পট-পরিবর্তনের পর নিজ থেকেই থানা থেকে সরে এসেছেন। তার স্থলে নতুন ওসি হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন ইন্সপেক্টর হারুনুর রশীদ। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গত বছরের ১১ই ডিসেম্বর গোয়াইনঘাট থানার ওসি হিসেবে যোগ দেন রফিকুল ইসলাম। এই সময়ের মধ্যে তিনি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দায়িত্বে ছিলেন। মূলত নির্বাচন কেন্দ্রিক রদবদলে তাকে গোয়াইনঘাট থানায় পাঠানো হয়। নির্বাচনকে সামনে রেখে গোয়াইনঘাটে যোগ দিলেও গোটা উপজেলার সীমান্ত এলাকাকে চোরাকারবারিদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেন তিনি। একইসঙ্গে বিরোধীদের দমন-পীড়নও চালান। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন; তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল মামলা বাণিজ্য। চোরকারবারিদের নিরীহ লোকজনকে আসামি করে তিনি কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। গোয়াইনঘাটের চারটি পয়েন্ট হচ্ছে চোরাচালানিদের স্বর্গরাজ্য। এগুলো হচ্ছে বিছনাকান্দি, মাতুরতল, পাদুয়া হাজীপুর ও পূর্ব জাফলংয়ের সোনাটিলা এলাকায়। ওসি যোগদান করার পর থেকেই প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ হাজার বস্তা চিনির চালান ওইসব রুট দিয়ে বাংলাদেশে প্রকাশ্যেই প্রবেশ করে। আর সব নিয়ন্ত্রিত করতো ওসির দালালরা। পশ্চিম জাফলংয়ের হাজীপুর মাতুরতল এলাকায় ওসির নিয়ন্ত্রিত চোরাকারবারি ছিল দেলোয়ার হোসেন, মধ্য জাফলংয়ে ছিল উজ্জ্বল মানিক ও মাসুক আহমদ, বিছনাকান্দিতে কামাল ও ফয়সল, পূর্ব জাফলংয়ে শামসুল। লাইনম্যান হিসেবে নিয়োগ দিতে তাদের কাছ থেকে প্রথমে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এরপর তাদের দিয়েই চোরাকারবারি নিয়ন্ত্রণ করেন। এ ছাড়া- জাফলং, বিছনাকান্দি ও আড়কান্দি পাথর ও বালু কোয়ারি তার নিয়ন্ত্রিত লোকজনকে দিয়েই পরিচালিত হতো। ওসির সিন্ডিকেটের সদস্যদের অনেকেই ৫ই আগস্টের পট-পরিবর্তনের পর গা ঢাকা দিয়েছেন। স্থানীয়রা জানিয়েছেন; গোয়াইনঘাট থানার চোরাই পণ্য থেকে প্রতিদিন ওসির আয় ছিল ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা। থানায় বসে বসে এসআই ইমরুল, এসআই জাহাঙ্গীর হোসেন ও এনামুল হককে দিয়ে টাকা সংগ্রহ করতেন। তাদের মতে; ওসি রফিকুল ইসলাম নিজেকে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা পরিচয় দিয়ে আধিপত্য বিস্তার করেন। তার সঙ্গে গোয়াইনঘাটের সিন্ডিকেটও সক্রিয় ছিল। তিনি নিজেকে কেন্দ্রীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচয় দিতেন। দাপট দেখিয়ে তিনি ৮ মাস শাসন করেন গোয়াইনঘাট। পশ্চিম জাফলং এলাকার লোকজন জানান- কয়েক মাস আগে হাজীপুর এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ওসি’র ইন্ধনে চোরাকারবারিদের দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় প্রকাশ্যে দা, রামদা নিয়ে ওই এলাকায় কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়। এ নিয়ে ৪-৫টি মামলা হয়েছে। প্রতিটি মামলা ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার বিনিময়ে ওসি রেকর্ড করেন। পরে কিছু মামলা তার নির্দেশেই সমঝোতায় শেষ হয়। সমঝোতায়ও তিনি লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। ৮ মাস গোয়াইনঘাট শাসন শেষে যখন ৫ই আগস্টে প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয় তখন ওসি রফিকুল ইসলাম নিজেই ঊর্ধ্বতনদের কাছে আবেদন করে থানা ছেড়েছেন। এর আগে স্থানীয় ছাত্র-জনতা কয়েক দফা থানা ভাঙচুর করে। এতে থানা ছেড়ে চলে গিয়েছিলো পুলিশ। পরে অবশ্য সেনাবাহিনী মোতায়েনের পর থানার কার্যক্রম শুরু হয়। আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা জানিয়েছেন- ওসি রফিকুলের মধ্যে গোয়াইনঘাটে অতীতে কোনো ওসি এত বাণিজ্য করেননি। তার সময় প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০টি চোরাচালানের ট্রাক গোয়াইনঘাট থেকে বের হয়ে যেতো। এরমধ্যে অর্ধেক চোরাই পণ্য থানার সামনের রাস্তা দিয়ে সিলেটে আসতো। পুলিশ নীরব ভূমিকা পালন করতো। এসব কারণে ওসির ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন স্থানীয় ছাত্র-জনতা। এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ৫ই আগস্ট থানায় ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। তারা জানান- পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে ওসি নিজ থেকেই থানার দায়িত্ব থেকে সরে এসেছেন। একইসঙ্গে তার নিয়ন্ত্রণে থাকা চোরাকারবারিরাও এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছে। গত কয়েকদিন ধরে গোয়াইনঘাটে ওসি রফিকুলকে নিয়ে তুমুল আলোচনা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু তিনি। ইতিমধ্যে তার বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে একটি হত্যা মামলাও দায়ের করা হয়েছে। মাতুরতল বাজার এলাকার সোনারহাট বিজিবি ক্যাম্পের সামনে আনন্দমিছিলে হামলা ও গুলি চালিয়ে সুমন মিয়া নামের এক তরুণ নিহতের ঘটনায় সিলেট জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ১ম আদালতে মামলাটি করেছেন নিহতের বাবা আব্দুন নুর বিলাল। তিনি গোয়াইঘাটের মাতুরতল বাজার এলাকার ফেনাইকোনা গ্রামের বাসিন্দা। মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য কয়েকজন আসামি হলেন- সাবেক সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সিলেট-৪ আসনের সাবেক এমপি ও সাবেক প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ, জেলা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের প্রধান ইমাম উদ্দিন সাদেক ও ঘটনার সময়ের গোয়াইনঘাট থানার ওসি রফিকুল ইসলাম। মামলার আবেদন আমলে নিয়ে সংশ্লিষ্ট থানাকে এফআইআর করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এ ব্যাপারে ওসি রফিকুল ইসলাম মানবজমিনকে জানিয়েছেন- আমার বিরুদ্ধে যে টাকার অভিযোগ করা হচ্ছে সেই টাকা কী জীবনে ওরা দেখেছে। কিংবা কোনো দিন গুনেছে। যারা সবচেয়ে বেশি ফায়দা নিয়েছে তারাই এখন তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছে। তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হচ্ছে সেগুলো মিথ্যা বলে জানান তিনি। বলেন- যে মামলায় তাকে আসামি করা হয়েছে তখন তো তিনি নিজেই আক্রান্ত। থানায় ভাঙচুর করা হয়েছে। ওই সময় তিনি ঘটনাস্থল এলাকায় থাকার কোনো সুযোগ ছিল না। তাকে হয়রানি করতে এ মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে জানান ওসি রফিকুল।
No comments