আদালত চত্বরে হামলা গ্রহণযোগ্য না: আইন উপদেষ্টা
গতকাল বুধবার সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আসিফ নজরুল এ কথা বলেন। এ দিন জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে জারি করা প্রজ্ঞাপন বাতিলের পর এ বিষয়ে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তিনি একটি হত্যা মামলায় সাবেক সংসদ সদস্য ও জাতীয় দলের ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকে গ্রেপ্তার করা না–করা, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা না–করা, ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানকে ঘিরে বিভিন্ন স্থানে মামলা ও আসামির করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন।
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর হত্যাসহ বিভিন্ন মামলায় বেশ কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী–প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, ১৪–দলীয় জোটের একাধিক শীর্ষস্থানীয় নেতা এবং সাবেক বিচারপতিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আদালতে নেওয়ার সময় আদালত চত্বরে কারও কারও ওপর হামলা বা মারধরের মতো ঘটনা ঘটছে। এ নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে।
এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, আদালতে যাওয়ার সময়ে কখনো কাউকে আক্রমণ করা উচিত নয়, কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।’
এ সময় আসিফ নজরুল আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ওপর হামলার প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সাংবাদিক মাহমুদুর রহমানকে নির্মমভাবে আদালতে রক্তাক্ত করা হয়েছিল। তখন কি এই প্রশ্ন করেছিলেন, টিভিতে কি এই নিউজ দেখাতে পেরেছিলেন? আসিফ নজরুল বলেন, একটি দল (আওয়ামী লীগ) ও মন্ত্রিসভার সঙ্গে থাকা ব্যক্তিদের জনগণের শত্রুর পর্যায়ে নিয়ে আসা—এটা তো সাবেক সরকারের দায়ভার। তারা মন্ত্রিসভার সদস্য ও সমর্থকদের এমন জায়গায় নিয়ে গেছে যে একটি জনরোষ তৈরি হয়েছে। সাংবাদিক মাহমুদুর রহমানের ওপর জনরোষ ছিল না। সেটি ছিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। আরও অনেকভাবে অনেক সাংবাদিককে অপদস্থ করা হয়েছে।
একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের একটি কলামের প্রসঙ্গ টেনে সাংবাদিকেরা ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বিষয়ে বাধ্যবাধকতা নিয়ে প্রশ্ন করেন। এ বিষয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, নির্বাচন কমিশনের প্রথম উপলব্ধি করা উচিত, তাদের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা কী ছিল। ভুয়া নির্বাচন করা তাদের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ছিল? তারা আগে বিবেচনা করুক।
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা সমীচীন হবে না
একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, অনেকে মনে করেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা দরকার, এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী? জবাবে আসিফ নজরুল বলেন, যখন আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার একটি দাবি হাইকোর্টে (রিট) করা হয়, তখন অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস এর বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে তিনি কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে নন। তবে শক্তভাবে জঙ্গি তৎপরতা, রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা থাকলে সেটি সততার সঙ্গে তদন্ত করে এটি (নিষিদ্ধ) করা যেতে পারে। সংবিধানে সংগঠন করার স্বাধীনতা আছে।
আসিফ নজরুল বলেন, আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদানকারী দল, বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংগ্রামে এই দলটির অবদান ছিল। গত ১৫ বছরে তারা যা করেছে, এটি তাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে যায় না, সেটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে যায় না। তারা বাংলাদেশের ইতিহাসে বর্বরতম এক ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছিল। এই কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যক্তিগত দায় থাকতে পারে। নেতাদের সামষ্টিক দায় থাকতে পারে। তাই দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা সমীচীন হবে না বলে মনে করেন আসিফ নজরুল।
সাকিব গ্রেপ্তার হবে না বলে আশা প্রকাশ
হত্যা মামলায় সাবেক সংসদ সদস্য ও ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকে গ্রেপ্তার করা না–করা বিষয়ে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেন। এ সময় আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ফুটবলার (বিএনপি নেতা) আমিনুল হক বাংলাদেশের জন্য পুরস্কার এনেছিলেন। তাঁকে যেভাবে অত্যাচার করা হয়েছিল, তখন কি প্রশ্ন করেছিলেন? আমিনুলকে জেলেও ভরা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘সাকিবের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এটি পুলিশের ব্যাপার। মামলা হওয়া মানে তো গ্রেপ্তার নয়। আমার বিশ্বাস, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে উদ্যোগ নেওয়া হবে, যাতে কেউ অতি উৎসাহী হয়ে গ্রেপ্তার না করে।’ সাকিব গ্রেপ্তার হবে না বলে আশা প্রকাশ করেন আসিফ নজরুল।
প্রসঙ্গ মামলা
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনীতিবিদসহ অজ্ঞাত অনেকের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হচ্ছে। এভাবে যত্রতত্র মামলায় ভুক্তভোগীদের বিচারপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা নিয়ে কেউ কেউ শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এভাবে মামলার ক্ষেত্রে হয়রানিরও আশঙ্কা থাকে।
এ নিয়ে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করলে আসিফ নজরুল ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অনেকের সন্তান হারানোর কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ব্যক্তিগতভাবে কেউ মামলা করলে রাষ্ট্রের কোনো অধিকার নেই তা না বলার। তবে তাঁর ও তাদের (সরকার) একটাই করণীয় আছে, সেটি হলো পুলিশ তদন্ত করবে, তদন্তে সুস্পষ্ট তথ্য না পেলে পুলিশ অব্যাহতি দিয়ে দেবে। তদন্ত ও বিচারকাজে যথাযথ প্রক্রিয়া বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করা হবে। তবে সরকার আদালতে হস্তক্ষেপ করতে পারে না।
এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে মামলা করার পরামর্শ দিয়েছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগের সময়ে বিভিন্ন মামলায় কিছু নাম দিয়ে অনেক অজ্ঞাতনামা আসামি রাখা হতো। এর মাধ্যমে প্রথমত একটি ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা হতো। দ্বিতীয়ত, অবৈধ বাণিজ্যের চিন্তাও কাজ করত। এখন যেসব মামলা হচ্ছে, সেগুলোর ধরনও প্রায় একই রকম। এসব মামলায় তদন্ত করে, সাক্ষী জোগাড় করে কাউকে দোষী প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব।
No comments