ঝিনাইদহে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন ৪২ জন by আমিনুল ইসলাম লিটন
ঝিনাইদহে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বিএনপি-জামায়াতের ১৯ নেতাকর্মীসহ ৪২ জন। এই বিভীষিকাময় হত্যাকাণ্ড চলে ২০১৩-২০১৬ পর্যন্ত। বিচারবহির্ভূত অমানবিক হত্যাকাণ্ডের শিকার যুবদল নেতা মিরাজুল ইসলাম মির্জা ছিলেন এক প্রতিবাদী যুবক। অন্যায় দেখলেই করতেন প্রতিবাদ। সাংগঠনিক দক্ষতা আর নিজ এলাকার আধিপত্যের কারণে দিনে দিনে চক্ষুশূল হয়ে ওঠে এলাকার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের। সরকার বিরোধী সকল আন্দোলনে সামনের সারিতে থেকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতেন মির্জা। আর এটাই কাল হয় দাঁড়ায় তার। মাত্র ২৫ বছর বয়সে মির্জা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। ২০১৫ সালের ১৭ই মার্চ ঝিনাইদহ শহরের একটি ছাত্রাবাস থেকে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় মির্জাকে। ৮দিন তাকে ঝিনাইদহ জেলার বিভিন্ন পুলিশ ক্যাম্পে রেখে মোটা অংকের টাকা দাবি করেন। টাকা না পাওয়ার কারণে ৮ দিনের মাথায় ২৫শে মার্চ মির্জার গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায় ঝিনাইদহ জেলার সীমান্তে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার পন্নাতলা মাঠে। মির্জার ১০৭ বছর বয়সী পিতা জোনাব আলী একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ। ছেলে হারানোর শোক আর কান্নায় কেটে গেছে ৯ বছরেরও বেশি সময়। বয়সের ভারে আর চলাফেরা করতে পারেন না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন বৃদ্ধ পিতা। বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমান প্রতি মাসে অনুদানের টাকা পাঠান। এছাড়াও জেলা বিএনপির সভাপতি এড এম এ মজিদ মাঝে মধ্যেই মির্জার পরিবারের জন্য চাল, ডাল ও নগদ টাকা দিয়ে আসেন তাতেও তাদের সংসার চলে না। ফলে মির্জার মা বুলবুলি খাতুন বৃদ্ধ বয়সেও বাধ্য হয়ে পরের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালান। শুধু মির্জাই নন, তার মতো বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন ঝিনাইদহ বিএনপি-জামায়াতের ১৯ নেতাকর্মী। একই সময়ে চরমপন্থি সংগঠনের ক্যাডার নিহত হয়েছে ১৪ জন। লাশ পাওয়ার পর আজ পর্যন্ত পরিচয় মেলেনি ৮ জনের। কেন্দ্রে পাঠানো বিএনপির খুন গুমের তালিকা সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৪০ মাসে জেলায় বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ৪২ জন। এরমধ্যে বিএনপির ৪ জন, জামায়াত শিবিরের ১৫ জন, সাধারণ ব্যবসায়ী একজন, সন্ত্রাসী ১৪ জন ও অজ্ঞাত রয়েছেন ৮ জন। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন, ঢাকার শনির আখড়া এলাকার বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম, কালীগঞ্জ উপজেলার নলভাঙ্গা গ্রামের বিএনপি নেতা রবিউল ইসলাম রবি, ঝিনাইদহ শহরের খাজুরা গ্রামের বিএনপি নেতা গোলাম মোস্তফার ছেলে গোলাম আজম পলাশ, একই গ্রামের দুলাল হোসেন, আরাপপুর ক্যাডেট কলেজ পাড়ার ব্যবসায়ী তমুর রহমান তুরান, হরিণাকুন্ডুর রঘুনাথপুর ইউনিয়ন জামায়াতের সেক্রেটারি ইদ্রিস আলী পান্না, শৈলকুপার শিবির কর্মী ইবি ভার্সিটির ছাত্র সাইফুল ইসলাম মামুন, ঝিনাইদহ শহরের জনপ্রিয় শিবির নেতা ইবনুল পারভেজ, মেধাবী ছাত্র জহুরুল ইসলাম, তারিক হাসান সজিব, কুষ্টিয়ার আনিছুর রহমান, ঝিনাইদহ শহরের শহীদ আল মাহমুদ, কালীগঞ্জের ঈশ্বরবা গ্রামের সোহানুর রহমান সোহান, একই উপজেলার বাকুলিয়া গ্রামের শামিম হোসেন, চাপালী গ্রামের আবুজার গিফারী, সদর উপজেলার কালুহাটী গ্রামের হাফেজ জসিম উদ্দীন, সদর উপজেলার অশ্বস্থলী গ্রামের মাদ্রাসা শিক্ষক ও জামায়াত কর্মী আবু হুরাইরা, কোটচাঁদপুরের বলাবাড়িয়া গ্রামের জামায়াত কর্মী হাফেজ আবুল কালাম ও একই উপজেলার চাঁদপাড়া গ্রামের জামায়াত নেতা এনামুল হক বিশ্বাস। বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের অভিযোগ সাংগঠনিকভাবে দক্ষ ঝিনাইদহের এসব কর্মীদের টার্গেট করে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা পুলিশ দিয়ে একের পর এক এসব হত্যা কাণ্ড ঘটিয়েছে। আর এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল অতি উৎসাহী কতিপয় পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের অফিসাররা। বিশেষ করে ২০১৩ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মদদে টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হন বিএনপি জামায়াতের নেতাকর্মীরা। এসব নেতাদের প্রথমে পুলিশ, ডিবি বা র্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হতো। কিছুদিন পর ঝিনাইদহ এবং পার্শবর্তী জেলার সীমান্তের বিভিন্ন স্থানে গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যেত তাদের। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে ঝিনাইদহ জেলা জামায়াতের আমীর অধ্যাপক আলী আজম মো. আবু বকর জানান, হাসিনা সরকারের আমলে ঝিনাইদহে জামায়াত শিবিরের ১৬ নেতাকর্মীকে খুন করা হয়েছে। কেন্দ্র থেকে আমাদের নির্দেশনা দিয়েছে মামলা করার। ইতিমধ্যে আমরা জামায়াত কর্মী আব্দুস সালাম হত্যার ঘটনায় মামলা করেছি। পর্যায়ক্রমে সব খুনের মামলা করা হবে এবং সেই প্রচেষ্টা চলছে। ঝিনাইদহ জেলা বিএনপির সভাপতি এ্যাড এম এ মজিদ বলেন, হাসিনা সরকারের আমলে ঝিনাইদহে যেসব বিএনপি ও যুবদলের নেতাকর্মীদের হত্যা করা হয়েছে সে বিষয়ে মামলার প্রক্রিয়া চলছে। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কুশীলবদের বিরুদ্ধে মামলা করে আইনের মাধ্যমে তাদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।
No comments