এক কাপড়ে বেরিয়েছি সব শেষ by মারুফ কিবরিয়া ও নাজমুল হক শামীম
‘কিছু নাই। সব শেষ হই গেছে। মাডির লগে মিশি গেছে। আবার কবে এই ঘর জোড়ামু জানি না।’ কথাগুলো বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার রাধারনগর ইউনিয়নের দক্ষিণ আন্দারমানিক গ্রামের বাসিন্দা প্রিয়রঞ্জন। গত সপ্তাহের বুধবার গভীর রাতে আচমকা উজান থেকে আসা ঢলে ভেঙে পড়ে তার ঘর। স্ত্রী সন্তান নিয়ে কোনোমতে এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়েন প্রিয়রঞ্জন। আশ্রয় নেন পাশের একটি দোতলা ভবনের ছাদের উপর। সঙ্গে স্ত্রী ও তিন সন্তান ছিল। বানের স্রোত এতটাই তীব্র ছিল কিছুই বের করতে পারেনি পরিবারটি। পেশায় কুমার এই পরিবারের মাথাগোঁজার ঠাঁই কবে হবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা কাটছে না। প্রিয়রঞ্জন মানবজমিনকে বলেন, মাটির কাজ করে খাই। আঙ্গো আর কিছু করার নাই। এই ঘর বানাইতে আবার ঋণ নিতে হইবো। তিনি জানান, বুধবার রাতে ঘরে কোমর সমান পানি ছিল। ভোরবেলায় বন্যার পানির স্রোত আরও বাড়ে। তখনই ঘর ছেড়ে পাশের বাড়িতে গিয়ে উঠেন তারা। তিনদিন পর এসে দেখেন নিজের ঘরটি মাটির নিচে দেবে যায়। আসবাবপত্রও তলিয়ে যায়। ফেনীর ইতিহাসে এবারই এত বন্যার পানি দেখতে পেলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাদের চোখে-মুখে এখনো বুধবারের সেই ভয় আতঙ্ক বিরাজ করছে। ছাগলনাইয়ার রাধানগর ইউনিয়নের নিজ পানুয়া গ্রামের বাসিন্দা জোহরা বেগমের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার কাঁচা ঘরটি ভেঙে গেছে। বুধবার দুপুরে সরজমিন দেখা গেছে, চল্লিশোর্ধ্ব এই নারী মাটির নিচে চাপা পড়া ঘর থেকে নষ্ট হয়ে যাওয়া আসবাবপত্র বের করেছেন। জোহরা বেগম বলেন, আর কিছু নাই। সব মাটির নিচে মিশে গেছে। বন্যা হইতে দেখছি। এত বন্যা আর ঘর বিরানা (নষ্ট) হয় নাই কোনো কালে। আমার দুই বাচ্চা লই সাঁতার কাটি এক আত্মীয়ের বাড়ি চলি গেছি। বাচ্চাগুলা এত পানি দেখি ভয় পাই গেছে। একই ইউনিয়নের রাজিব চন্দ্র পাল বলেন, তিনি ও তার ছোট ভাই নিপুচন্দ্র পাল বুধবার রাতে যখন পানি উঠছিল তখন পরিবার নিয়ে এক কাপড়ে তারা ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। পানি নামার পর ঘরে এসে দেখেন মাটির ঘরটি পুরোটাই দেবে গেছে। ঘরের সকল আসবাবপত্র মাটির নিচে চাপা পড়ে আছে। নিপুচন্দ্র পাল বলেন, কুমারের কাজ করে পরিবার চালাতেন তিনি। তৈরি সকল তেজসপত্র পানিতে ভেসে গেছে। বন্যার পানিতে ঘর গেছে তৈরীকৃত পণ্য গেছে এখন সামনের দিনগুলো কেমনে চলবে? ভেঙে যাওয়া ঘর থেকে মালপত্র সরাতে দেখা গেল পঞ্চাশোর্ধ্ব সন্ধ্যা রানী পাল, বন্যার পানি নামলেও তিন মেয়ে নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ঘর নেই, খাবার নেই, পরনের একাধিক শুকনো কাপড়ও নেই। ছোট ছোট তিন মেয়ে নিয়ে কীভাবে সামনের সময় পার করবো? স্থানীয় ইলেকট্রিক দোকানদার পঙ্কজ কর্মকার বলেন, বন্যার পানিতে শুধু তার ঘরেই ক্ষয়ক্ষতি হয়নি উপার্জনের একমাত্র দোকানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দোকানে থাকা প্রায় তিন লাখ টাকার মালামাল নষ্ট হওয়ায় না খেয়ে থাকার উপক্রম হয়েছে। তাদের ঘরগুলো পার হয়ে সামনে এগুতেই চোখে পড়ে কলেজ শিক্ষার্থী মোবারক হোসেনের সঙ্গে। বাবা নেই। তিন ভাইও মা নিয়ে তাদের সংসার। মাটির ঘরটি ভেঙে পুরো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘর থেকে বের করা যায়নি কোনো আসবাবপত্র। শুধুমাত্র গবাদিপশু রক্ষা করে উচ্চস্থানে রেখেছেন। গ্রামটিতে বসবাস করা সত্তরোর্ধ্ব আব্দুর রহমান বলেন, তার জন্ম তো পরে তার বাবার কিংবা দাদার জন্মেও এ সকল গ্রামগুলোতে এত পানি কখনো দেখেননি। বন্যার কারণে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে মাটির ঘর ও টিনের ঘরগুলোতে। ছাগলনাইয়া উপজেলার বক্সমাহমুদ ইউনিয়নের পশ্চিম বক্সমাহমুদ গ্রামের মোহাম্মদ মুসা মিয়া বলেন, পশ্চিম বক্সমাহমুদ গ্রামটি নদীর পাড়ে হওয়ায় এ গ্রামের যত মাটির ঘরবাড়ি আছে সব ভেঙে সর্বস্ব হারিয়েছেন ওই সকল ঘরের বাসিন্দারা। ছাগলনাইয়া উপজেলার পাঠাননগর ইউনিয়নের বাংলাবাজার গ্রামের ওয়াহিদের রহমান জানান, গত দুদিন আগে বন্যার পানিতে ভেলায় ভাসতে থাকা একটি লাশ দেখেছেন। চারিদিকে পানি থাকায় হয়তো মৃত ব্যক্তিটির দাফন করতে পারেননি স্বজনরা। ছাগলনাইয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম কমল বলেন, উপজেলায় কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এটি নিরূপণে কাজ করা হচ্ছে। প্রতিটি বিভাগকে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে তালিকা দ্রুত তার কার্যালয়ে পাঠাতে বলা হয়েছে। তিনি আরও জানান, উপজেলায় কতোজন নিহত হয়েছে তার তথ্য এখনো নিরূপণ করা হয়নি। এই উপজেলায় ত্রাণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এদিকে ফেনী সদর উপজেলার কাজিরবাগ ইউনিয়নের মধ্যম কাজিরবাগ গ্রাম ঘুরে দেখা যায় গ্রামের অন্তত ত্রিশটিরও বেশি মাটির ঘর বন্যার পানিতে একেবারে ভেঙে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গ্রামের কালু চন্দ্র পাল জানান বন্যায় তার থাকার ঘর রান্নাঘর একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। তিনি একটি ওষুধের দোকানে কাজ করে পরিবার চালাতেন। থাকার সহায়সম্বল হারিয়ে তিনি এখনো অনেকটা নিঃস্ব। ফেনী জেলা প্রশাসক মোছাম্মৎ শাহিনা আক্তার বুধবার রাতে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানান, জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার তথ্য অনুযায়ী বন্যায় জেলায় ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।
No comments