টাকার নেশা সাবেক এমপি ওদুদের by ফারুক আহমেদ চৌধুরী

চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ (সদর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল ওদুদ বিশ্বাস। ঘুষ, টেন্ডারবাজি আর নিয়োগ-বাণিজ্যের সিন্ডিকেট গড়ে  তুলেছিলেন  তিনি। অবৈধ অর্থ লেনদেনে ছিল বিশ্বস্ত সব হাতিয়ার। বালুমহল দখল, ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, নিয়োগ-বাণিজ্য, জমি দখল; একেকজন একেক সেক্টর দেখতেন। এরাই ছিলেন এমপি ওদুদের টাকার মেশিন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে এমপি ওদুদ ও তার লোকজন এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন। আব্দুল ওদুদ ২০০৮ সালে প্রথমবার নৌকার মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হন। পাশাপাশি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন। এসব পদ-পদবি পেয়ে গত প্রায় ১৬ বছর তিনি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। গড়েছেন শতকোটি টাকার সম্পদ।

এমপি’র হাত থেকে দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরাও রেহাই পাননি। দলের নেতারাই ছিলেন অনেকটা সংখ্যালঘুর মতো। তার আশপাশে ঘিরে ছিল সুবিধাভোগীরা। এদের নিয়ে আব্দুল ওদুদ গড়ে তোলেন ঘুষ, দুর্নীতি আর লুটপাটের সাম্রাজ্য।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রথমদিকে এমপি আব্দুল ওদুদের দুর্নীতি ও অপকর্মের মূল সহযোগী ছিলেন এজাবুল হক বুলি। দলীয় ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর কলেজের অধ্যক্ষের পদ বাগিয়ে নেন। এই বুলির মাধ্যমে সব বাণিজ্য করতেন আব্দুল ওদুদ। পরে অনেকেই আব্দুল ওদুদের অপকর্মের সঙ্গী হন। উপজেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন রাসেল বিভিন্ন প্রকৌশল বিভাগের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করতেন। পরে অবশ্য বালুমহালও ইজারা নেন রাসেল। আওয়ামী লীগ নেতা মনিরুল ইসলাম (মুনিরুল সচিব) খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, আতাহিরের কালাম বোল্ডার করতেন জমি দখল কারবার, আবু নাসের পালন করতেন নিয়োগ বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ। সুবোধ মহুরি ছিলেন জমি জালিয়াতি চক্রের নেতৃত্বে, হাবিবুর রহমান হাবিব করতেন হাসপাতালের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ। এ ছাড়াও তারই চাচাতো ভাই ওলি মিয়া ও উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি রুহুল আমিনও ছিলেন আব্দুল ওদুদের টাকার মেশিন। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মঈনুদ্দিন মণ্ডলের মৃত্যুর পর তার ঘনিষ্ঠ আশরাফুল হককে জেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বানান এমপি ওদুদ। তার মাধ্যমে জেলা পরিষদ বিপুল অর্থ লুটপাট করেন।

দলের নেতাকর্মীরাও তার ভয়ঙ্কর থাবা থেকে রেহাই পাননি বলে অভিযোগ রয়েছে। একাধিকবার এলাকার মানুষ তার অবৈধ সম্পদ ও কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি তুলে ধরে দুদকে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন। সর্বশেষ অভিযোগ দেয়া হয়েছিল গত বছর জুলাই মাসে। কিন্তু অনুসন্ধান কিংবা তদন্ত কোনোটাই হয়নি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে ওদুদ বিশ্বাস যে হলফনামা নির্বাচন কমিশনে দাখিল করেছিলেন তাতে তিনি পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত কৃষি জমির পরিমাণ উল্লেখ করেছিলেন নিজের নামে ৩০ বিঘা এবং স্ত্রীর নামে ছয় বিঘা। যৌথ মালিকানার দুই বিঘা দালানে ওদুদের অংশের মূল্য ছিল দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা। ২০০৮ সালে স্থায়ী সম্পদ হিসেবে রাজশাহীর সোনাদিঘি মোড়ের একটি তিনতলা বাড়ি এবং নিজ গ্রাম মহারাজপুরে ৬০ হাজার টাকা মূল্যের ছয়টি দোকানঘর থাকার কথা উল্লেখ করেছিলেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের সর্বশেষ নির্বাচনে ওদুদের দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে দেখা যায়, ২০০৮ সাল থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ১৫ বছরে ওদুদের সম্পদ বেড়েছে শত গুণের বেশি। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী ও ঢাকাতে জমি, মার্কেট, অ্যাপার্টমেন্ট ও বাড়ির ছড়াছড়ি।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, রাজশাহী নগরীর কোর্ট ঢালান এলাকায় ২২ কাঠা জমির উপর ওদুদ একটি মার্কেট করেছেন। এই জমি ও মার্কেটের বর্তমান দাম ২৫ কোটি টাকার বেশি। ২০০৮ সালে মৌসুমি ব্যবসা থেকে তার বার্ষিক আয় ছিল ৪০ হাজার টাকা। বর্তমানে তার ব্যবসার মূলধন বেড়ে হয়েছে ১০ কোটি ৮০ লাখ ২৭ হাজার টাকা। ২০২৩ সালে ওদুদ বিশ্বাসের নিজ নামে জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৭ বিঘা। ১৪ বছর পর পৈতৃক ও ক্রয়সূত্রে ওদুদ বিশ্বাসের অকৃষি জমির পরিমাণ ১০ বিঘা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৮ বিঘা। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে হাতে নগদ টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ৪০ লাখ। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে স্থায়ী জমার পরিমাণ ১০ লাখ টাকা। মোটরসাইকেল ছাড়াও একটি ট্রাক, একটি জিপ গাড়ি ও একটি ট্যাংক লরি রয়েছে। এরমধ্যে এমপি কোটায় আমদানি করা দুটি গাড়ি বিক্রি করে তিন কোটি টাকা পেয়েছেন বলে ওদুদ বিশ্বাস দাবি করেছেন।

আয়কর ফাইলের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, নিজ নামে ৫ ভরি সোনা, স্ত্রীর ৮০ ভরি ও দুই মেয়ের ১২০ ভরি সোনা রয়েছে। এমপি হওয়ার আগে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া বাদে নিজের নামে কোনো বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্ট ছিল না। বর্তমানে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে তিনটি বাড়ির মালিক হয়েছেন। ঢাকায় আছে তিনটি ফ্ল্যাট। এমপি হওয়ার পর নিজ এলাকা ঘোড়া স্ট্যান্ড মোড়ে করেছেন একটি পেট্রোল পাম্প। চাঁপাইনবাবগঞ্জের অনুপনগরে কিনেছেন তিন কোটি টাকা মূল্যের একটি অটো ইটভাটা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহী নগরীর সোনাদিঘি মোড়ের চারতলা বাড়িটি এমপি হওয়ার পর সাততলা করেছেন। রাজশাহী নগরীর প্রাণকেন্দ্রে সাততলা এই বাড়িটির বর্তমান মূল্য পাঁচ কোটি টাকার বেশি। রাজশাহীর নবীনগর মৌজার অধীন চারলেন বিমানবন্দর সড়ক ঘেঁষে ৩০ কাঠা জমির উপর নির্মাণ করেছেন তিনতলা মার্কেট। রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা এই মার্কেটের শুধু জমির দামই ১৫ কোটি টাকা বলে এলাকাবাসী জানান। এমপি হওয়ার পর চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের পুরাতন জেলখানা মোড়ে শূন্য দশমিক ৭৮১ একর জমি কেনেন ওদুদ। সেই জমিতে নির্মাণ করেন তিনতলা বাড়ি। এই ভবনের উপর তলায় ওদুদ বসবাস করতেন। তার আয়কর ফাইলে এই জমিসহ বাড়ির মূল্য দেখিয়েছেন মাত্র ৩৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা। বর্তমানে বাড়িটির মূল্য তিন কোটি টাকার বেশি বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। ওদুদ এমপি হওয়ার পর রাজশাহীর সিরোইল মৌজায় শূন্য দশমিক ১০৬৭ একর জমি কিনেছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের চরজোতপ্রতাপ এলাকায় কিনেছেন শূন্য দশমিক ৮০০ একর জমি। রাজশাহী নগরীর বড়বনগ্রাম মৌজায় দশমিক ০৯৫০ একর জমি কেনেন নিজ নামে।

নথিপত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জের কোচলাপাড়া মৌজায় ১ দশমিক ৪৬০০ একর জমি, অনুপনগর মৌজায় ২ দশমিক ২৭৫০ একর, কোচলাপাড়ায় ১ দশমিক ১৯ একর, দক্ষিণশহর মৌজায় দশমিক শূন্য ৩৪০০ একর, কোচলাপাড়ায় ১ দশমিক ২৯০০ একর এবং রাণীহাটি মৌজায় দশমিক শূন্য ২৩০০ একর জমি কিনেছেন এমপি ওদুদ। খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের দক্ষিণ শহর এলাকায় ওদুদের প্রায় ৭০ বিঘা জমির ওপর একটি বিশাল খামারবাড়ি রয়েছে। ঢাকার কলাবাগান এলাকায় একাধিক অ্যাপার্টমেন্ট থাকলেও সেগুলো তিনি আয়কর ফাইলে দেখাননি। ঢাকার খিলগাঁও এলাকায় থাকা দুটি ফ্ল্যাটের মালিক তিনি। আয়কর ফাইলে খিলগাঁও এলাকার ফ্ল্যাট দুটির মূল্য দেখিয়েছেন ২৭ লাখ ৪৮ হাজার টাকা।

এদিকে, এক বিএনপি নেতাকে হত্যাচেষ্টা ও লুটপাটের ঘটনায় গত ১৯শে আগস্ট সদর মডেল থানায় একটি মামলা হয়েছে। ওই মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে আব্দুল ওদুদকে। এ ছাড়াও এক বিএনপি কর্মী হত্যার ঘটনায় আব্দুল ওদুদকে প্রধান আসামি করে ২৫শে আগস্ট আদালতে মামলার আবেদন করেছেন রাণীহাটি ইউপি চেয়ারম্যান রহমত আলী। আগামী ৪ঠা সেপ্টেম্বর আদেশের জন্য তারিখ নির্ধারণ করেছে আদালত।

No comments

Powered by Blogger.