হামাগুড়ি দিচ্ছিলেন গুলিবিদ্ধ রিপন, আছেন পা কাটার শঙ্কায় by ফাহিমা আক্তার সুমি

বাইশ বছর বয়সী রিপন। তিনি থাইগ্লাস মেরামতের কাজ করতেন। ৪ঠা আগস্ট গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে ছিলেন রাস্তায়। বাম পা দিয়ে রক্ত ঝরছিল অনবরত। সেদিন সেই রক্তে ভিজেছিল রাস্তা। চিৎকার করে কাঁদলেও এগিয়ে আসেনি কেউ। রক্তাক্ত পা চেপে হামাগুড়ি দিতে দিতে নিজেই যান হাসপাতালে। বর্তমানে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। পুলিশের ছোড়া গুলিতে রিপনের বাম পা এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যায়। রিপনের মা আছর বিবি মানবজমিনকে বলেন, চার সন্তানের মধ্যে রিপন আমার একমাত্র ছেলে। আমি বিচার চাই।
একটি ভিডিওতে দেখা যায়, পুলিশ ধাওয়া দিলে আমার সন্তান দৌড়ে একটি গলির মধ্যে যায়। সেখানে কয়েকটি সিএনজি থামানো ছিল। এ সময় কয়েকজন পুলিশ দৌড়ে গিয়ে পায়ে বন্দুক ঠেঁকিয়ে গুলি করে। সুনামগঞ্জ সদরে ঘটনাটি ঘটে তার কিছুদূরেই আমার বাড়ি। লোকজন আমার ছেলেকে ধরে না, সবাই শুধু ভিডিও করে। তখন আমার সন্তান রক্তাক্ত পা নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। রক্তাক্ত পা চেপে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে বাঁচার জন্য আকুতি জানায়। নিজের শরীরে থাকা টি-শার্ট খুলে পা বেঁধে আমাকে ফোন দেয়। সেসময় চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, মা আমি নেই, আমাকে মেরে ফেলেছে পুলিশ। আমার সন্তানকে খুঁজতে সুনামগঞ্জ মেডিকেলে যাই, সেখানে দেখি পায়ে গুলি লেগে এক পাশ থেকে আরেক পাশে বেড়িয়ে গেছে। পায়ের হাড় ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যায়। হাসপাতালের বেডে ঘুমন্ত সন্তানকে আগলে ধরে তিনি বলেন, আমার কলিজাটা ছিঁড়ে যায়, এখনো কানে বাজে ছেলের সেদিনের ফোনের ওইপাশের চিৎকার। ওর আয় দিয়ে পুরো সংসার চলে। ওর বাবা কামাল উদ্দিনের হার্টের সমস্যা। সে বাসায় থাকে, কোনো কাজ করতে পারে না। আমার ছোট তিন মেয়ে। তারা পড়াশোনা করে। জানি না কবে ওর পা ভালো হবে। কীভাবে যে আমি চলবো, আল্লাহ কীভাবে আমাকে চালাবেন?

রিপনের মামাতো ভাই তোফায়েল আহমেদ বলেন, অভাবের কারণে রিপন এসএসসি পাস করে আর পড়তে পারেনি। ঘটনার দিন সদর হাসপাতালে যাই, পরে সেখান থেকে ১৪ই আগস্ট বার্ন ইউনিটে নিয়ে আসি। সিলেটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অনেক খরচ হয়েছে। এখানে এখন মোটামুটি খরচ হচ্ছে। তবে সামনের দিনগুলো ওর চিকিৎসা কীভাবে চালিয়ে যাবে সেই চিন্তা করছে ওর পরিবার। চিকিৎসক আমাদের বলেছেন, পা কেটে ফেললে ২-১ মাসের মধ্যে ভালো হবে। আর যদি রাখা হয় তাহলে সুস্থ হতে এক-দেড় বছর লেগে যাবে। আমরা পা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করবো, যতদিন হোক চিকিৎসা চালিয়ে যাবো।
শুধু রিপন নয়, কোটা সংস্কার আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ অনেকে চিকিৎসাধীন রয়েছেন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। আহত সবুর মিয়া বলেন, ৫ই আগস্ট অন্দোলন করেছিলাম আশুলিয়া থানার সামনে। দুপুর ১টার দিকে পুলিশের গোলাগুলি শুরু হলে আমি গুলিবিদ্ধ হই। পায়ের পাতায় গুলি লেগে উপর থেকে বেড়িয়ে যায়। প্রথমে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যাই। সেখানে ঠিকমতো চিকিৎসা না হওয়ায় ইনফেকশন হয়। আমাদের বাড়ি জামালপুরে গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হই। সেখান থেকে বুধবার আমাকে বার্ন ইউনিটে পাঠায়। তিনি বলেন, আমি একটি গার্মেন্টে চাকরি করতাম। ছাত্রদের রাস্তায় নামতে দেখে আমি আর ঘরে বসে থাকতে পারিনি। ওইদিন আশুলিয়া এলাকায় অনেক মানুষ মারা গেছে। আমার স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঢাকাতে থাকতাম। বাড়িতে আমার বাবা-মা, ছোট দুই ভাইবোন রয়েছে। এখন পায়ের অবস্থা খুবই খারাপ। জালামপুর থেকে ডাক্তার বলে দিয়েছে প্লাস্টিক সার্জারি করার জন্য। আমিই আমার পরিবারে আয় করতাম। বাবা মুদি দোকানি। ছোট দুই ভাইবোন পড়াশোনা করে। আমার যদি জীবনও চলে যেতো তবুও দুঃখ ছিল না, একটি যৌক্তিক আন্দোলন করতে পেরেছি।

গুলিবিদ্ধ হৃদয় বলেন, ১৮ই জুলাই আন্দোলনে সাভারে ওভার ব্রিজের উপরে গুলিবিদ্ধ হই। পুলিশ ওভারব্রিজ লক্ষ্য করে নিচ থেকে গুলি করে। এ সময় আমার পেটে দুইটি গুলি লাগে। সেখান থেকে আমাকে সাভার এনাম মেডিকেলে ভর্তি করে। ১১ই আগস্ট বার্ন ইউনিটে নিয়ে আসে। সাভারে একটি বিল্ডিংয়ে কেয়ারটেকারের কাজ করতাম। আমার বাবা স্ট্রোক করে মারা গেছেন। বাবা আইসক্রিম বিক্রি করতেন। আমি বেশি দূরে পড়তে পারিনি। হৃদয়ের মা রুপালি বলেন, আমি বাসা বাড়িতে কাজ করি। ছেলের আয়ে সংসার চলতো। গ্রামের বাড়ি শেরপুরে। ধার-দেনা করে ওর চিকিৎসা চালিয়েছি। প্রথম দিকে অনেক টাকা খরচ হয়েছে। এখানে আসার পরে কিছুটা খরচ কমেছে।

No comments

Powered by Blogger.