রাজস্ব বিভাগে আইএমএফের ভূত!

রাজস্ব বিভাগের কাঁধে ভর করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ভূত। প্রায় ৫ বছর নিরন্তর চেষ্টা করে বহুজাতিক এ সংস্থাটি ভ্যাটের হার বাড়িয়ে দিতে রাজস্ব বোর্ডকে বাগে নিয়ে আসে। ২০১২ সালে বাংলাদেশকে বর্ধিত ঋণ সহায়তা ১০০ কোটি ডলার অনুমোদন করে আইএমএফ। আর এতেই যুক্ত করে দেয়া হয় ভ্যাট আইন সংস্কারের বিষয়। বহুজাতিক কোম্পানি আর কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান থেকে রাজস্ব আদায় কঠিন হয়ে পড়ায় তুলনামূলক সহজ পথে চলতে রাজস্ব বোর্ডকে পরামর্শ দেয় আইএমএফ। পরোক্ষ কর ভ্যাটের হার এবং এর আওতা বাড়ানো হয়। এতে যে সাধারণ মানুষের ওপর বোঝা বাড়বে, সেটি স্বীকার করেন অর্থমন্ত্রী নিজেও। তার মতে, ক্রমবর্ধমান অর্থনীতিতে আর কিছু করার নেই। তার যুক্তি, এতে বাড়তি চাপ তৈরি হবে, তবে তা বহনের সক্ষমতা আছে। ভ্যাট ধনী ও গরিবের মধ্যে আয় বৈষম্য বাড়িয়ে দেয়। তত্ত্বীয়ভাবে বলা হয়, পরোক্ষ কর সবসময় গরিব ও সাধারণ মানুয়ের জন্য নিবর্তনমূলক। যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইন্সটিটিউট অব ফিসক্যাল স্টাডির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরোক্ষ কর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য দমনমূলক পদক্ষেপ। এটি উন্নয়নশীল দেশের দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রাকে অব্যাহতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। দরিদ্র জনগোষ্ঠী তাদের আয়ের অধিকাংশই খরচ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে। আর এর পরের ব্যয় আবাসন ও চিকিৎসায়। ফলে আনুপাতিক হারে দরিদ্রদের ওপর কর ভারও বেশি পড়ে।
এখন যেভাবে ভ্যাট আরোপের কথা বলা হচ্ছে তাতে দুশ্চিন্তার কারণ হল, ৪ হাজার ৮১৬ ধরনের পণ্যের ওপর বাড়তি হারে ভ্যাট বসবে। অর্থাৎ এসব পণ্য ও সেবার মূল্য বাড়িয়ে দেবে নতুন ভ্যাট আইন। ক্রেতা ও ভোক্তাকে গুনতে হবে বাড়তি অর্থ। গ্যাস-বিদ্যুতের ওপর বর্তমানে ৫ ভাগ ভ্যাট আছে এবং নতুন আইনে সেটি বাড়বে। আর তা হলে সেটি ভোক্তা ও উৎপাদক পর্যায়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে। রাজস্ব আদায়ে জনঅংশীদারিত্বের কথা বলা হচ্ছে জোরেসোরে। ভীতিকর পরিবেশ দূর করার আশ্বাস মিলছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র। চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে ভ্যাট আদায়ের হার। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় করা হলেও তৃণমূলের ভাবনার কোনো ছাপ নেই। বরং চোখ রাঙানি বাড়ছে রাজস্ব কর্মকর্তাদের। ঔপনিবেশিক আমলে রাজস্ব আদায়ে জবরদস্তি চলত। এজন্য ব্যবহার করা হতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। শাসিয়ে রাজ কোষাগারে আনা হতো রাজস্ব। তখন সেটি মেনে নেয়া হতো। কিন্তু এখন তো রাজস্ব বোর্ড বলছে, ‘জনকল্যাণে রাজস্ব’। ভোক্তা ও ব্যবসায়ী কেউ এখন বাড়তি হারে ভ্যাট পরিশোধের জন্যে প্রস্তুত নয়। তারপরও অস্বস্তিকর পরিবেশে কল্যাণ করতে দৃঢ়প্রত্যয়ী রাজস্ব বোর্ড। ভ্যাট পরিশোধ করে থাকেন ক্রেতা-ভোক্তারা। খুচরা পর্যায়ে আদায় করেন ব্যবসায়ীরা; আর পাইকারিভাবে অর্থ নিয়ে যায় রাজস্ব বোর্ড। ভ্যাট আদায়ে গাণিতিক হিসাব সহজ, এমনটা মনে করেন না ব্যবসায়ীরা। অর্থাৎ এর জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষণ। আইএমএফ এ ব্যাপারে তহবিল জোগান দিলে এ আর্থিক শিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন মুষ্টিমেয় কয়েকজন। তলানিতে এর কোনো কার্যক্রম ছিল না।
এতে ক্রেতা ও খুচরা পর্যায়ের সংগ্রহকারীদের কাছে কোনো বার্তা পৗঁছানো যায়নি। চলতি অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে ঘোষণা ছিল, বাড়তি ইসিআর মেশিন আনা হবে। কিন্ত বাস্তবে তেমনটা দেখা যায়নি। যদিও অর্থমন্ত্রী আবার বলেছেন, আগামীতে ৪০ থেকে ৫০ হাজার ইসিআর মেশিন আনা হবে। সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের হিসাব অনুসারে, আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ভ্যাট ১০ শতাংশ হওয়া উচিত। রাজস্ব বোর্ড চায় ১৫ শতাংশ হারে। অসন্তোষ বিবেচনায় এ হার কিছুটা কমাতে বলছে প্রধানমন্ত্রীর দফতর। আজ রোববার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তখনই এ বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত আসবে বলে আশা করা যাচ্ছে। তবে এর আগেই অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, সব ক্ষেত্রে অভিন্ন হার হবে। এটা না হলে নাকি ভ্যাটের মূল চেতনা ব্যাহত হয়। কিন্তু বড় অর্থনীতিতে ভিন্ন ভিন্ন ভ্যাট হার রয়েছে। মূলত বিভিন্ন খাতে প্রণোদনা দিতেই এসব উদ্যোগ। ভারতে সাড়ে ১২ শতাংশ, নেপালে ১৩ শতাংশ, মালদ্বীপ ও ভুটানে ভ্যাট না থাকলেও গুড্স অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স আছে। মালদ্বীপে সব ক্ষেত্রে ৬ শতাংশ এবং পর্যটন খাতে ১২ শতাংশ জিএসটি আরোপ হয়। প্রতিযোগী অর্থনীতির দেশ ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও মিয়ানমারে ভ্যাটের হার ১০ শতাংশ। এশিয়ার উন্নত অর্থনীতির দেশ জাপানে মাথাপিছু জিডিপি সবচেয়ে বেশি, কিন্তু দেশটিতে ১৯৮৯ সাল থেকে ভ্যাট ৫ শতাংশ। চীন ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফেরাতে গত মাসে তাদের সর্বোচ্চ ভ্যাট ১৩ শতাংশ থেকে ১১ শতাংশে নামিয়েছে। আর্থিক সেবা, ইন্টারনেট ও তথ্য-প্রযুক্তির ওপর চীনে ভ্যাট ৬ শতাংশ,
নির্মাণ শিল্পে ৩ শতাংশ। ২০১৬ সালের ১ অক্টোবর থেকে মিসর নতুন ভ্যাট আইন চালু করেছে, যেখানে সর্বোচ্চ ১৩ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। তবে পণ্য ও সেবা উৎপাদনে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির ওপর ভ্যাট ৫ শতাংশ। গত ১ এপ্রিল থেকে ভারতে ১২.৫, ইন্দোনেশিয়ায় ১০, ইরানে ৮, নেপালে ১৩, সিঙ্গাপুরে ৭, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১০, তাইওয়ানে ৫, থাইল্যান্ডে ৭ ও ভিয়েতনামে ১০ শতাংশ ভ্যাট চালু হয়েছে। এসব দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করে তাদের ব্যবহৃত ভোগ্যপণ্যগুলো করমুক্ত রাখা হলেও বাংলাদেশে এ চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। সরকার দরিদ্র মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের ওপর ভ্যাট আরোপ করেছে। ভ্যাট আইনের অংশবিশেষ প্রয়োগের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ৬০০ পণ্যে সম্পূরক শুল্ক বহাল রাখা হবে। আগে বলা হয়েছিল, সাড়ে ১৩০০ পণ্যে আমদানি পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক তুলে নেয়া হবে। এ আইন কার্যকর হলে প্রথম দিন থেকেই বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। এমন আশঙ্কার কথা বেশ আগেভাগেই বলা হচ্ছে। ভ্যাট আইনে কাঁচামাল সরবরাহের জন্য রেয়াত সুবিধা নেয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। দেশে বেশিরভাগই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। লেনদেনের সময় ভ্যাটের চালান রাখেন না তারা। হিসাব সংরক্ষণও করেন না ঠিকমতো। কোনো রেকর্ড থাকে না। চালান না থাকলে রেয়াতি সুবিধা পাবেন না তারা। খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ের ব্যবসায় এ সমস্যা বেশি হবে। এতে করে আদায়ে জটিলতা তৈরি হবে। আর এতেই তৈরি হবে ভ্যাট আদায়ে বড় চ্যালেঞ্জ। রাজস্ব বোর্ড বলেছে, তারা তৈরি আছে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের একটি বড় অংশের এ আইন প্রতিপালনের বিষয়ে সক্ষমতার অভাব রয়েছে। ভ্যাট জটিলতা নিরসনের দায়িত্ব রাজস্ব বোর্ডের কাছে থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়ে ওঠেনি। বিষয়টি গড়িয়েছে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত। শেষ পর্যন্ত সম্মানজনক নিষ্পত্তির প্রত্যাশায় আছেন ব্যবসায়ী সমাজ। ভাবছেন, বাজেটে তাদের আশা পূরণ হবে। এর আগে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর আরোপিত ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয় প্রবল আন্দোলনের মুখে।
সে সময়ও এ সিদ্ধান্ত এসেছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। এবার ভ্যাট আইনে যে পরিবর্তন আনা হচ্ছে, তাও একই দফতরের পরামর্শে। ২০০৭ সাল থেকে নতুন ভ্যাট আইনের পরামর্শ দিয়ে আসছে আইএমএফ। কিন্তু সে সময় এতে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। শেষ পর্যন্ত ২০১২ সালে তৈরি করা হয় এ আইন। এর খসড়া চূড়ান্ত করতে সময় লাগে ১৮ মাস। তখন থেকেই ব্যবসায়ীরা এ আইনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আপত্তি তোলেন। এফবিসিসিআইয়ের অভিযোগ, কয়েক দফা বৈঠক হলেও তাদের সুপারিশ গ্রহণ করা হয়নি। এ আইনের একটা বড় অংশ আইএমএফ নিজের তত্ত্বাবধানে তৈরি করে দিয়েছিল। পৃথিবীর সব দেশে বাইরে তৈরি করা আইন প্রয়োগে জনদুর্ভোগ তৈরি হয়ে থাকে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বিএনপি ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় এসে প্রথম ভ্যাট আইন কার্যকর করে। সে সময় প্রবল আপত্তি থাকলেও ক্ষমতার প্রথম প্রান্তে এতে পাত্তা দেয়া হয়নি। আর বর্তমান সরকার নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর করতে চায় নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সময়, যে সময় জনতুষ্টির ভাবনা প্রাধান্য পেয়ে থাকে সরকারের নীতিনির্ধারকদের মাঝে। এ মেয়াদের হাসিনা সরকারের শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট পেশ করতে যাচ্ছেন আবুল মাল আবদুল মুহিত, যা তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ বাজেট হবে বলে মনে করছেন তিনি। তাই প্রত্যাশা, সেখানে জনস্বার্থ সুরক্ষার পাশাপাশি সুষম উন্নয়ন এজেন্ডা গুরুত্ব পাবে।
সাজ্জাদ আলম খান : সাংবাদিক
sirajgonjbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.