প্রতিশোধ নিতে মোস্তফাকে কুপিয়ে হত্যা করে নাসির

মিরসরাইয়ে চাঞ্চল্যকর যুবলীগ নেতা গোলাম মোস্তফা হত্যাকান্ডে অন্যতম সাহায্যকারী মোহাম্মদ বাহার (২৭) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তারের পর বাহারকে আদালতে নেওয়া হলে সে চট্টগ্রাম সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শিফুল কুমার দে’র আদালতে ১৬৪ ধারা স্বীকারোক্তি জবানবন্দি দেয়। গত ১১ মে বৃহস্পতিবার দুপুরে বারইয়ারহাট পৌরবাজারের ইসলাম মার্কেটের সামনে থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে জোরারগঞ্জ থানা পুলিশ। মোঃ বাহার অলিনগর এলাকার মৃত সিরাজুল হকের ছেলে ও নিহত মোস্তফার প্রতিবেশী। সে পেশায় সিএনজি চালক। জানা গেছে, দেড়মাস পূর্বে নাসিরের সম্পতি দখল নিতে মোস্তাফা সহ কয়েকজন তার বাড়িতে গিয়ে হাতাহাতি করে। এতে করে নাসিরের মার হাত ভেঙ্গে যায় ও তার স্ত্রী আহত হয়। মাও স্ত্রীকে অপমান করার অপরাধে স্থানীয় শালিসী বৈঠকে মোস্তফাকে ৫২ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। রায়টি নাসিরের মনোপ্রুত হয়নি। সে সীদ্ধান্ত নেয় মোস্তফাকে হত্যা করার। হত্যাকান্ডে নাসির তার সিএনজি চালক বাহারের সহায়তায় মোস্তফাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে। মোস্তফা হত্যাকান্ডের মূল রহস্য উদঘাটন ও মামলার সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে সাংবাদিকদের সাথে জোরারগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুল কবির শনিবার সন্ধ্যায় নিজ কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিং করেন। ব্রিফিং জাহিদুল কবির বলেন, গোলাম মোস্তফাকে হত্যার পরদিন ৮ মে রাতে তার স্ত্রী মোছাম্মৎ নিলুফা ইয়াছমিন বাদি হয়ে করেরহাটের অলিনগর এলাকার নাসির উদ্দিন ও নুর মোহাম্মদের নাম উল্লেখ সহ কয়েকজনকে অজ্ঞাত আসামী করে একটি হত্যা মামলা (নং-১৪) দায়ের করেন। মামলার পর চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপারের নির্দেশে মিরসরাই সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার সহ আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করি।
ঘটনাস্থলের একটু দূরে লিচু বাগান থেকে মামলার আলামত হিসেবে সিগারেটের অবশিষ্ট অংশ, দশ টাকার রবি অপারেটরের ব্যবহৃত একটি এমবি কার্ড সহ কিছু আলামাত সংগ্রহ করি। ওখান থেকে ধারণা করি ঘটনার সাথে জড়িতরা অনেকক্ষণ এখানে অবস্থান করেছিলেন। ঘটনার একদিন পর মামলার অন্যতম আসামী নুর মোহাম্মদ কে আমরা গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হই। গ্রেপ্তারের পর তাকে আদালতে নেওয়া হলে আদালত তাকে জেল হাজতে প্রেরণ করে। এসময় আমরা তার সাত দিনের জন্য আদালতে রিমান্ড আবেদন করি। রিমান্ড আবেদনের শুনানি হয়েছে। বন্ধ থাকার কারণে কয়দিনের রিমান্ড হয়েছে তা জানা যায়নি। নুর মোহাম্মদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের তথ্য এবং প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা সিএনজি চালক বাহারকে গ্রেপ্তার করি। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে অকপটে হত্যাকান্ডে নাসিরকে সহযোগীতার বিষয়টি স্বীকার করেন। পরবর্তীতে ১২ মে চট্টগ্রাম সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শিফুল কুমার দে’র আদালতে ১৬৪ ধারায় বাহার স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি দেয়। এসময় নাসির বলেন, গোলাম মোস্তফার সাথে বিগত দেড় মাস আগে নাসিরের সম্পত্তি নিয়ে ঝগড়া হয়। নাসির পরিবার নিয়ে অলিনগর এলাকায় বন বিভাগের খাস সম্পত্তিতে বসবাস করতো। এসময় নিহত মোস্তফা ও করেরহাট বাজারের পল্লী চিকিৎসক জামাল নাসিরের মা এবং স্ত্রীকে মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। এতে নাসিরের মায়ের হাত ভেঙ্গে যায়। পরবর্তীতে করেরহাট বাজারে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের উপস্থিতে শালিস বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। শালিসে নাসিরের মা ও স্ত্রীকে মারধর করায় গোলাম মোস্তফাকে ৫২ হাজার টাকা জরিমান করা হয়। কিন্তু নাসির রায়টি মেনে নিতে পারেনি। পরবর্তীতে নাসির তার জায়গাটি বিক্রি করে অনত্র চলে যায়। নাসির গোলাম মোস্তফা ও ডাক্তার জামালকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেয়। পরে নাসির তার মায়ের অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য যেকোন উপায়ে গোলাম মোস্তফাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। সে মাঝে মাঝে আমাকে ফোন দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে বলে জানাতো। মোস্তফাকে হত্যা করার জন্য সে আমাকে গোলাম মোস্তফা কখন বাড়ি ফিরে, কখন বের হয় তার খোঁজ খবর রাখতে বলে। ঘটনার দিন বিকেলে আমি নাসির সহ বারইয়ারহাট পৌর মাছ বাজার থেকে ২৫০ টাকা দিয়ে গাছের হাতলওয়ালা একটি দা (ধারালো আস্ত্র) কিনে নিয়ে আমার কাছে রাখি। সকালে মোস্তফা বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর থেকেই নিজের সিএনজি নিয়ে চালক বেশে পিছু নিই। মোস্তফা কখন কোথায় কি করছিলেন নাছির উদ্দিনকে তার আপডেট মোবাইলে জানাই। তবে দিনের বেলায় হত্যার উপযুক্ত সময় না পাওয়ায় বিকেল বেলা পূর্বের ওই পরিকল্পনা বাদ দিয়ে রাতের উপযুক্ত সময়কে বেচে নতুনভাবে হত্যার পরিকল্পনা করি। পরবর্তীতে ঘটনারদিন ৭মে রবিবার রাত সাড়ে নয়টার পর থেকেই আমি সিএনজিতে করে নাসিরকে নিয়ে মোস্তফার বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে লিচু বাগানে মোস্তফার ফেরার অপেক্ষা করি। এসময় নাসির আমাকে বলে মোস্তফাকে আজ রাতেই হত্যা করবে।
একথা শুনে আমার খারাপ লেগে উঠে। তাই নাসিরকে না জানিয়ে আমি সিএনজি নিয়ে বাড়ি চলে যায়। রাত সাড়ে বার টার দিকে মোস্তফা করেরহাট থেকে মটরসাইকেল যোগে নিজ বাড়ির আঙ্গিনায় পৌছালে মোটর সাইকেল থেকে নামার সময় পেছন দিক থেকে মোস্তফার গাড়ে কোপ দেয় নাসির। পরে মোস্তফার মৃত্যু নিশ্চিত হলে নাসির আমাকে রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে ফোন দেয় কাম (কাজ) হই গেছে। সে আমাকে সিএনজি নিয়ে তাকে আনতে যেতে বলে। আমি তাকে যেতে পারবোন বলে নাসিরকে নিজের মতো করে চলে যেতে বলি। তখন নাসির আমাকে হুমকি দিয়ে বলে ‘খুনের ঘটনা শুধু তুই আর আমি জানি; আর কেউ জানেনা। ঘটনা যদি কেউ জানে তোরও মোস্তফার মতো একই অবস্থা হবে।’ ওসি জাহিদুল কবির আরো বলেন, নাসির একজন মাদকাসক্ত। সে নিয়মিত গাঁজা সেবন করতো। মায়ের অপমান ও জায়গা দখল করতে চাওয়ায় সে মূলত হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত দা আমরা ঘটনাস্থলের একটু দূরে লিচু বাগানের একটি ক্যানেল (খাদ) থেকে উদ্ধার করি। আমরা নাসিরকে গ্রেপ্তারের চেষ্ঠা অব্যাহত রেখেছি। শীগ্রই তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে। নাসিরকে গ্রেপ্তারের পর এঘটনায় প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে কেউ জড়িত কিনা তা জানা যাবে। নাসির সীমান্তের ওপার থেকে অবৈধভাবে মাদক, মসলা, কাপড় সহ বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রীর ব্যবসা করতো। ব্রিফিংয়ে এসময় জোরারগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) আনোয়ার হোসেন, সেকেন্ড অফিসার বিপুল দেবনাথ উপস্থিত ছিলেন।
প্রসঙ্গত : গত ৭ মে রাত ১টার সময় উপজেলার করেরহাট ইউনিয়নের দক্ষিণ অলিনগর এলাকায় এক যুবলীগ নেতা গোলাম মোস্তফাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে রেখে যায় সন্ত্রাসীরা। ঘটনার পরদিন রাতে তার স্ত্রী বাদি হয়ে নাসির উদ্দিন ও নুর মোহাম্মদকে আসামী করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

No comments

Powered by Blogger.