আমিই বাংলাদেশ বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে মানুষের সম্মিলিত ও ব্যক্তিগত চেষ্টায়। বাংলাদেশ মানে শুধু নেতিবাচক খবর নয়। দেশে ও বিদেশে নিজের কাজ দিয়ে যাঁরা দেশের মুখ উজ্জ্বল করছেন, তাঁদের কথা নিয়ে আমাদের এই আয়োজন যুক্তরাষ্ট্রে বিষমুক্ত খাবার ও তাহের খান by মোছাব্বের হোসেন

যুক্তরাষ্ট্রের কোনো খাবারদাবার যখন বাজারে আসে, তা যে কঠিনভাবে মাননিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এসেছে, এ কথা কমবেশি সবাই জানেন। মান নিয়ন্ত্রণ করে খাবার বাজারজাত করার যে অনুমোদন দেওয়া হয়, সেই প্রক্রিয়ায় যুক্ত আছেন একজন বাংলাদেশি, তাহের খান।
তিনি যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য গবেষণা ও মাননিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে একজন মূল্যায়নকারী বিজ্ঞানী (টকসিকোলোজিস্ট) হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। পাশাপাশি খাদ্য নিয়ে গবেষণাও করেন তিনি।
শুধু তা-ই নয়, এফডিএর জন্য খাদ্য গবেষণার নির্দেশিকাও লিখেছেন তাহের খান। বিভিন্ন বছরে এফডিএর সেরা মূল্যায়নকারী বিজ্ঞানী হিসেবে পেয়েছেন নয়টি পদক। তাঁর লেখা শতাধিক নিবন্ধ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন মর্যাদাপূর্ণ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
১৯৯১ সাালের দিকে ট্রাস্ককিগি বিশ্ববিদ্যালয়ে খাবারে পারদের প্রভাব নিয়ে গবেষণায় তাহের খান বের করেছিলেন যে গর্ভবতী নারী যদি পারদযুক্ত খাবার খান, তাহলে এর প্রভাব পড়ে তাঁর সন্তানের ওপর। এতে সন্তান বিকলাঙ্গ, প্রতিবন্ধী বা অন্য কোনো সমস্যা নিয়ে জন্মাতে পারে। তাঁর এই গবেষণার পর গোটা আমেরিকায় এ বিষয়ে সচেতনতা বেড়ে যায়।
সম্প্রতি ঢাকায় বেড়াতে এসেছিলেন তাহের খান। প্রথম আলোকে তিনি বললেন, পারদযুক্ত খাবারের গবেষণাটি সে সময় ফুড অ্যান্ড কেমিক্যাল টকসিকোলাস জার্নালে প্রকাশিত হলে খাবারের সঙ্গে যাতে এটি না যায়, সে ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। তাহের খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে ১৯৮১ সালে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। পরিবেশবিজ্ঞানে পড়েছেন সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কে। আর রাসায়নিক ব্যবস্থাপনায় পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন নিউ জার্সির রাটগার্স ইউনিভার্সিটি থেকে। এ সময় খাদ্যে রাসায়নিকের ব্যবহার ও ক্ষতিকর দিক থেকে বাঁচার উপায় নিয়ে গবেষণা করেছেন তিনি।
২০০০ সালে তাহের খান যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামার ট্রাস্ককিগি ইউনিভার্সিটিতে বায়োমেডিক্যাল সায়েন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ছিলেন। তখন এফডিএতে চাকরির জন্য আবেদন করেন তিনি। তাহের খান বলেন, ‘ওই সময় এফডিএর নাম শুনলেই ভয় পেতাম, কত বড় প্রতিষ্ঠান, কত গুরুত্বপূর্ণ কাজ! বিশ্বের বাঘা বাঘা প্রতিষ্ঠানের মেধাবীরা চাকরি করেন। প্রায় ৭০ জন একসঙ্গে পরীক্ষা দিই।’ লিখিত পরীক্ষায় সবাইকে পেছনে ফেলে সেখানে চাকরি পান তাহের খান। কারণ, সেবার মাত্র একজন বিজ্ঞানীকেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএতে বিভিন্ন গবেষণায় অর্জিত জ্ঞান বাংলাদেশে কাজে লাগাতে চান তিনি। বললেন, ‘ফরমালিন ব্যবহার না করেই যে খাদ্য সংরক্ষণ করা যায়, সে বিষয়ে গবেষণা করেছি। এ ছাড়া খাবার ও প্রসাধনীতে রং ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরেছি বিভিন্ন লেখায়। সেসব বাংলাদেশের কাজে লাগতে পারে।’
তাহের খানের জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার খাগাতুয়া গ্রামে, ১৯৫৩ সালে। তাঁর বড় ভাই আবদুস সাত্তার খানও একজন বিজ্ঞানী। কাজ করেছেন নাসাসহ বিশ্বখ্যাত অনেক প্রতিষ্ঠানে। বড় ভাইকেই আদর্শ মানেন তিনি। বললেন, ‘আমার বয়স যখন নয় মাস, তখন বাবা মারা যান। আমাদের তিন ভাইকে নিয়ে মা আয়শা বেগম দিশেহারা হয়ে পড়েন। বড় ভাই আবদুর রহিম খান লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে গৃহশিক্ষকতা করতে থাকেন। তিনি সব সময় চাইতেন আমরা দুই ভাই যেন মানুষের মতো মানুষ হই।’ তাহের খানের স্ত্রী কানিজ ফাতেমাও এফডিএর একজন গবেষক। তাঁদের এক ছেলে ও এক মেয়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের খাবার সরবরাহকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের খাবারের মান মূল্যায়নের কাজ করেন বাংলাদেশের তাহের খান। বাজারে একটি প্রতিষ্ঠান খাবার পুনরুৎপাদন করতে চাইলে সেটি করতে পারবে কি না, খাবারের গায়ে কোন মোড়ক লাগবে—এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার একজন কর্তাব্যক্তি তিনি।
বাংলাদেশে খাবারে ফরমালিনের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে তাহের খান শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘১০০ বছর আগে এটি আমেরিকায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফরমালিনের ব্যবহারে ক্যানসারসহ বিভিন্ন বড় রোগ হতে পারে। ফরমালিন ব্যবহার না করেও খাদ্য সংরক্ষণ করা যায়। যুক্তরাষ্ট্রে খাবারে ভেজালের কথা চিন্তাই করা যায় না। বাংলাদেশ সরকার যদি আগ্রহী হয়, তাহলে এফডিএর সহযোগিতা নিতে পারে। মার্কিন সরকারের মাধ্যমে আমিও বিভিন্ন পরামর্শ দিতে চাই।’

No comments

Powered by Blogger.