সরকারের চার বছর-জনগণের চোখে নিজেকে দেখুন by আবু সাঈদ খান

সরকার যত চক্ষুষ্মান হোক না কেন, নিজেকে পুরোপুরি দেখতে পায় না। ক্ষমতায় থাকলে চক্ষুষ্মানও একচোখা হয়ে যায়। তখন নিজের ভুলত্রুটি আর চোখে পড়ে না। তাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের চোখে দেখার সংস্কৃতিই সর্বোত্তম পন্থা।
গণতান্ত্রিক চর্চার প্রক্রিয়ায় সভা, সেমিনার, গণমাধ্যমের অভিমতের পাশাপাশি জনমত জরিপ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। জরিপের মাধ্যমে চকিতে জনমতের সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ যেভাবে মিলিয়ে নেওয়া যায়, তেমনটি অন্য কোনোভাবে সম্ভব নয়।
সম্প্রতি বাংলাদেশে সরকার তথা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ওপর জরিপ পরিচালিত হচ্ছে। সরকারের চার বছর পূর্তিতে সমকালসহ কয়েকটি পত্রিকা জনমত জরিপ করেছে, যা এখন দেশজুড়ে আলোচিত। এ নিয়ে পক্ষে ও বিপক্ষে কথা হচ্ছে। সেটি হতেই পারে। তবে ফল পক্ষে গেলে জরিপ ভালো, বিপক্ষে গেলে অগ্রহণযোগ্য_ তা হতে পারে না। এ ক্ষেত্রে যুক্তিগ্রাহ্য সমালোচনা কাম্য। যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশিত, তা হলো জরিপের ফল বিপক্ষে গেলেও তা আমলে নেওয়ার সংস্কৃতি।
প্রশ্ন হচ্ছে, এবারের জরিপে জনমতের কতখানি প্রতিফলন ঘটেছে? কোনো জরিপই ১০০ ভাগ নির্ভুল হয় না। তবে তা যথাযথ প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হলে মোটা দাগে জনমতের প্রতিফলন ঘটে। সমকালের জরিপ প্রসঙ্গেও এমনটা দাবি করা যায়।
গ্রাম, শহর, নারী-পুরুষ, শ্রেণী-পেশার সমন্বয়ে ১৬ হাজার মানুষের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন-উত্তরের ভিত্তিতে যে অভিমত এসেছে, এর সঙ্গে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি, নাগরিক সমাজের আয়োজিত সভা-সেমিনার, বাস-ট্রেন-রেস্তোরাঁয় সাধারণ মানুষের কথাবার্তার পার্থক্য দেখছি না। অন্যদিকে দৈনিক প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারের পরিচালিত জরিপের সঙ্গেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাদৃশ্য রয়েছে সমকালের জরিপের। সে আলোকেই কতিপয় বিষয়ের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করব।
আমাদের মনে রাখা দরকার, যা দৃশ্যমান তার ভিত্তিতে জনমত তৈরি হয়। ঘটনার আড়ালের কোনো বিষয় জরিপে প্রতিফলিত হওয়ার কথা নয়। সেই বিবেচনায় সমকালের জরিপে উঠে আসা সরকারের প্রধান সাফল্য শিক্ষা খাত। এটি ছোট করে দেখার জো নেই যে, এ সরকারের আমলে শিক্ষাবষের প্রথম সপ্তাহেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়া হয়েছে, যা ইতিপূর্বে সম্ভব হয়নি। এর বাইরেও শিক্ষানীতিতে বহু ধারায় বিভক্ত শিক্ষা ব্যবস্থার সমন্বয়ের চেষ্টাও পরিলক্ষিত হয়েছে। তদুপরি শিক্ষামন্ত্রীর 'ক্লিন ইমেজ' মিলিয়ে শিক্ষা খাত সংশ্লিষ্ট প্রশ্নের উত্তরদাতাদের কাছে সাফল্যের দিক থেকে প্রথম অবস্থানে আছে। তবে অধিকাংশ উত্তরদাতা কিন্তু শিক্ষা খাতের চার বছরের সাফল্যে উৎফুল্ল নন। ৪৭ শতাংশের অভিমতই হচ্ছে মোটামুটি সন্তোষজনক। আরও প্রশ্ন যুক্ত করতে পারলে শিক্ষা খাতের ত্রুটিগুলোও বেরিয়ে আসত। শিক্ষার বহুমুখী ধারা, মানের নিম্নগামিতা, সিলেবাসের দুর্বলতা ইত্যাদি বেরিয়ে আসত। কিন্তু জরিপে পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে আনা সম্ভব নয়। উল্লেখ্য, কৃষি খাতের সাফল্য অর্জিত হলেও উত্তরদাতারা সে কৃতিত্ব সরকারকে দিতে নারাজ। কারণগুলো বোধগম্য। কৃষক উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছে না, সার-বীজসহ কৃষি উপকরণ সহজলভ্য হচ্ছে না_ কৃষির এসব সমস্যা সম্পর্কে জরিপে অংশগ্রহণকারীরা সচেতন থেকেছেন। তাই সরকারের কৃষিনীতি কৃষকের জন্য সহায়ক কিনা_ সে ক্ষেত্রে 'হ্যাঁ' (২৫ শতাংশ) এর চেয়ে 'কিছুটা সহায়ক' (৩৪ শতাংশ) এর অধিক এবং 'না' (৩৩ শতাংশ) প্রায় সমান। গ্রামীণ অর্থনীতি আগের চেয়ে ভালো কি-না, এ প্রশ্নেও 'হ্যাঁ' (২০ শতাংশ) এর চেয়ে 'কিছুটা ভালো' (৩৭ শতাংশ) বেশি এবং 'না' (৩৬ শতাংশ) প্রায় সমান।
সমুদ্র সীমানায় অধিকার অর্জনের মামলায় বিজয় এবং বিদ্যুৎ সরবরাহের উন্নতির বিষয়টি উত্তরদাতাদের চোখ এড়ায়নি। উত্তরদাতাদের অধিকাংশ উন্নতির বিষয়ে ইতিবাচক (হ্যাঁ ২৬ শতাংশ এবং কিছুটা ৫২ শতাংশ) মত দিয়েছেন। আমার জিজ্ঞাস্য, কুইক রেন্টালের প্রতিক্রিয়া বিষয়ক প্রশ্ন থাকলে কী উত্তর পাওয়া যেত? বিদ্যুতের দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধি ও কুইক রেন্টালে জ্বালানি সরবরাহ করার কারণে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়গুলো জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ফলে এ প্রশ্নে উত্তরদাতাদের সমর্থন মিলত না, তা আন্দাজ করা যায়।
জরিপে সরকারের যে সাফল্য উঠে এসেছে তার চেয়ে ঢের ব্যর্থতার খতিয়ান। সমকালের জরিপ অনুযায়ী প্রধান ব্যর্থতা দুর্নীতি। এ নিয়ে কি কোনো সংশয়ের সুযোগ আছে? টিআইবিসহ বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে যা উঠে এসেছে, তার সঙ্গে এই জরিপের মিল পরিলক্ষিত। জরিপে ৫৭ শতাংশ বলছে, বর্তমান সরকারের আমলে দুর্নীতি বেড়েছে।
পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, সোনালী ব্যাংক-হলমার্ক কেলেঙ্কারি ও দলীয় নেতাকর্মীদের টেন্ডারবাজি ইত্যাদি ইস্যুতে উত্তরদাতাদের অসন্তোষ সুস্পষ্ট। দ্রব্যমূল্য যে চার বছরে আরও অসহনীয় হয়ে উঠেছে_ সে চিত্রও জনমতে প্রতিফলিত হয়েছে। উত্তরদাতাদের অধিকাংশ (৪৭ শতাংশ) জানিয়ে দিয়েছেন, আগের তুলনায় তারা ভালো নেই।
এ জরিপ শুধু সরকারের ভূমিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়নি। বর্তমান সরকারের আমলে বিরোধী দলের ভূমিকাও এতে যাচাই করার চেষ্টা হয়েছে। বিরোধী দলের ভূমিকায় পুরোপুরি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে কম সংখ্যকই (১৬ শতাংশ)। তবে ৫০ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করছেন, বিরোধী দলের ভূমিকা কিছুটা সন্তোষজনক।
যে উত্তরদাতারা সরকারের ভূমিকায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন, তারাই আবার তুলনামূলক বিচারে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আস্থা (৪২ শতাংশ) রেখেছেন। অন্যদিকে বিরোধীদলীয় নেতার ভূমিকার প্রশংসা করেছেন ৩০ শতাংশ নর-নারী। ৪৫ শতাংশ জনগণের মতে, তিনি ভালো করছেন না।
স্বাভাবিক নিয়মে সরকারের ব্যর্থতার মুখে বিরোধী দলের প্রতি আস্থা বাড়ার কথা। কিন্তু কেন এর ব্যত্যয় ঘটছে? সমকালের জরিপের দুটি বিষয়ের ফল দেখলে এর উত্তর পাওয়া যায়। প্রথমত, দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্তদের দল থেকে বাদ না দিয়ে তাদের মুক্তির জন্যই আন্দোলন-সংগ্রাম করছে বিএনপি। দ্বিতীয়ত, অধিকাংশ (৫৫ শতাংশ) উত্তরদাতাই হরতালের বিরুদ্ধে। অথচ বিরোধী দল হরতালের পথেই এগোচ্ছে। তৃতীয়ত, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক ঐক্য সমর্থন করেন না উত্তরদাতাদের বড় অংশ (৬১ শতাংশ)। জামায়াতের রাজনীতির প্রতিও তাদের অবস্থান নেতিবাচক। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতি সমর্থন সর্বোচ্চ (৭৪ শতাংশ)।
কেবল সমকালের জরিপে নয়, প্রথম আলোর জরিপেও সরকারের দুর্নীতি, দলীয়করণ ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে অধিকাংশ উত্তরদাতার অসন্তোষ প্রতিফলিত। অন্যদিকে বিরোধীদলীয় নেত্রীর প্রতি আস্থা কমেছে। এসব কারণে বিরোধী দলের প্রতি আস্থা বাড়ছে না। কিন্তু এতে সরকারেরও পুলকিত হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, জননিরাপত্তাহীনতায় জনগণ সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ। জনরোষ বাড়ছে। দলীয় নেতাকর্মীদের দুর্নীতিতে সংশ্লিষ্টতা, দখলবাজি-টেন্ডারবাজির কারণে তা আরও তীব্র হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে মানুষ কোথায় যাবে? তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক শক্তির উত্থান কি ঘটছে? প্রথম আলোর জরিপে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির কিঞ্চিৎ আলামত রয়েছে, যা আমার কাছে গুরুত্ববহ কিছু মনে হয় না। এই সমর্থন আসলে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলের প্রতি ক্ষোভ থেকে সৃষ্ট। চূড়ান্ত বিচারে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অতীতের কেচ্ছা-কাহিনী প্রকাশ পেলে তিনি আর কল্কে পাবেন না। তবে পরিস্থিতিতে এটি প্রতীয়মান যে, নতুন রাজনীতির ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। আদর্শবাদী কোনো দল-মোর্চা এগিয়ে এসে এই শূন্যতা পূরণ করতে পারে।
সব জরিপেই জনগণের উৎকণ্ঠার বিষয় হচ্ছে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা। এ ক্ষেত্রে সরকারের আচরণও সমর্থনযোগ্য নয় বলে ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোর জরিপেও অভিমত এসেছে। সমকালের জরিপে উত্তরদাতারা আশঙ্কা করছেন, দেশে সংঘাতের মধ্য দিয়ে ১/১১-এর মতো কিছু ঘটে যেতে পারে। আসলে এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কেবল উত্তরদাতাদের নয়, সমগ্র জাতির। সবাই বিবাদ অবসানে রাজনৈতিক সমঝোতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করছেন। সমকালের জরিপ থেকে বেরিয়ে এসেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষেই অধিকাংশের মত। ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোর জরিপেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষেই মত এসেছে।
আদালতের দোহাই পেড়ে সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে যে ভ্রান্তিবিলাসে পা দিয়েছে, তা দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির জন্যই হুমকি। বল এখন সরকারের কোর্টে। বর্তমান সরকার উদার গণতান্ত্রিক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসবে, বিরোধী দলকে আলোচনার টেবিলে নেবে_ জাতি সেটিই প্রত্যাশা করে।
বলা আবশ্যক, সমঝোতার ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প অন্য কোনো ফর্মুলা প্রস্তাবিত হলেও কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচনের অবকাশ নেই। তাই যে কোনো আঙ্গিকেই দলনিরপেক্ষ কিংবা সর্বদলীয় সরকার ব্যবস্থার বিষয়টি এ ক্ষেত্রে বিবেচনাযোগ্য।
জনমত জরিপে বিন্দুর মধ্যে সিন্ধুরই প্রকাশ ঘটেছে। ফুটে উঠেছে সরকারের চার বছরের চিত্র, সম্ভাবনা ও সংকটের ক্ষেত্রগুলো। এই জরিপ থেকে সরকার ও বিরোধী দল জনমনের অভিপ্রায় বুঝতে সচেষ্ট হলে তা হবে সবার জন্য মঙ্গলজনক।

আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com

No comments

Powered by Blogger.