তথ্যসেবা-বাংলাদেশে জ্ঞানের হাট by ফারুক উল ইসলাম

যেসব মানুষের কাছে সরবরাহ ও কর্মীদের পেঁৗছাটা জরুরি, তাদের কাছে শেষ পর্যন্ত কীভাবে পেঁৗছা যাবে তা নিয়ে এ পর্যন্ত অনেক লেখালেখি হয়েছে। উন্নয়নের জন্য যোগাযোগ ও জ্ঞান শেয়ার করার বেলায় এটা বিশেষভাবে সত্য।
উন্নয়নসেবী ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী ও শহুরে এলাকার লোকজনের ক্ষেত্রে এই জ্ঞান শেয়ার করাটা অপেক্ষাকৃত সহজ। কিন্তু গ্রামীণ বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীর (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত) কাছে পেঁৗছানো অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। তবে কয়েক বছর ধরে এটা অনুধাবনের জন্য 'প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন' কার্যকর রয়েছে।
মানুষের জীবিকার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ই-সেবা ও বহু ক্ষেত্রের অধিকতর তথ্য সুবিধা যাতে মানুষ পেতে পারে সেজন্য জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির সমর্থনে বাংলাদেশ সরকার সারাদেশে সাড়ে চার হাজারের মতো তথ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছে। এসব কেন্দ্র ইউনিয়ন পর্যায়ে এবং ভৌগোলিকভাবে উপ-আঞ্চলিক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এগুলো যদিও বিকেন্দ্রীকৃত তারপরও এসব কেন্দ্র তাদের চূড়ান্ত পর্যায় অর্থাৎ কমিউনিটি পর্যায়ে প্রত্যেক পরিবারে পেঁৗছতে এখনও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে।
জ্ঞানের হাট প্রতিষ্ঠা : এসব কেন্দ্রের মধ্যে ৩০টিতে আমরা জ্ঞানের হাট প্রতিষ্ঠা করেছি। সাধারণত স্থানীয় পরিষদ অফিসের অংশ একটি কক্ষে এসব কেন্দ্র অবস্থিত এবং এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকে একটি কমিটি। কমিটিতে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি, স্থানীয় টেকনিক্যাল ও প্রশাসনিক বিভাগ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডাররা যুক্ত থাকেন। যে উদ্যোক্তা পর্যাপ্ত আয় নিশ্চিত করতে পারেন তার দ্বারাই দৈনন্দিন ভিত্তিতে এটি সচল রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। তারা সাধারণত আইসিটি সেবা, ফটোকপি করা ও এ ধরনের কাজের মাধ্যমে লব্ধ আয় দিয়ে এটি সচল রাখেন।
কমিউনিটির কাছে সেবা পেঁৗছানোর জন্য প্রত্যেক হাটে ১২ জনের একটি নেটওয়ার্ক বা একই রকমভাবে সম্প্রসারণ কর্মী বাহিনী থাকে। তারা কৃষি, মৎস্যচাষ ও গবাদিপশু পালন সম্পর্কে সর্বোত্তম ধারণা ও ব্যবহারবিধি সম্পর্কে সমবেত আগ্রহী লোকজনকে অবহিত করেন। বিশেষত প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহারটাও তারাই জনগণকে শিক্ষা দেন। সম্প্রসারণ কর্মীরা আত্মনির্ভরশীল। কারণ তারা শস্য স্প্রে করা ও পশুকে প্রতিষেধক দেওয়ার মতো মূল্য সংযোজিত সেবা বিক্রি করে থাকেন। তৃণমূল পর্যায়ে জ্ঞানের এই শেয়ার করা ও কার্যকর ব্যবহার প্রকৃতপক্ষেই কাজ দেয়। উপকূলীয় সাতক্ষীরার বড়লাখি গ্রামের বাবুর আলী সম্প্রসারণ কর্মী আবদুল আহাদের পরামর্শ ও সাহায্যে উপকৃত হয়েছেন। তার একটি ছাগল খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। তিনি আহাদের কাছ থেকে ক্রিমির ট্যাবলেট, পাউডার ও ভিটামিন ইনজেকশন পান। এতে ছাগলটির স্বাস্থ্যের লক্ষণীয় উন্নতি হয় এবং এটি আবার খাওয়া শুরু করে। একইভাবে চিংড়িচাষি ঝাপা গ্রামের বিশ্বজিৎ মণ্ডল মৎস্যচাষ সম্পর্কিত গ্রামীণ সম্প্রসারণ কর্মীর কাছ থেকে টোব্যাকো পাউডারকে জৈব পোকামাকড়ের ওষুধ হিসেবে চিংড়ি খামারে প্রয়োগের মাধ্যমে সেখানে শামুকের প্রকোপ নিয়ন্ত্রণের কৌশল জেনে ও প্রয়োগ করে উপকার পেয়েছেন। ওই সম্প্রসারণ কর্মীটি আতুলিয়া ইউনিয়নের জ্ঞানের হাট থেকে এ সম্পর্কে জ্ঞাত হন।
আগ্রহোদ্দীপক বিষয় হলো, আমরা সরকারি সম্প্রসারণ কর্মীদের কমিউনিটির একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে পেঁৗছানোর বিষয়ে সাহায্য করছি। যাতে তারা প্রকৃত চাষিদের কাছে পেঁৗছতে ও এই জ্ঞান লাভ করে উপকৃত হতে পারেন তার জন্য আমরা তাদের একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে পেঁৗছায় সাহায্য করছি। আমাদের এই সহায়তা বড় ধীরগতির আমলাতন্ত্রকে অধিকতর সক্রিয় ও গরিবদের চাহিদা পূরণে সাড়া দেওয়ার উপযোগী করতে অবদান রাখছে।
প্রথমদিকে কিছু সম্প্রসারণ কর্মকর্তা এই সেবার ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন এবং একে তারা তাদের কাজের পক্ষে হুমকি বলে বিবেচনা করেছিলেন। কিন্তু এখন তারা নিজেরাই স্বীকার করছেন, এতে আরও মূল্য যুক্ত হচ্ছে এবং এটা তাদের কাজের বৃহত্তর প্রভাব সৃষ্টিতে সহায়তা করবে।
জ্ঞান শেয়ার করার প্রকল্প নিয়ে দাতাদের শঙ্কা : প্রকল্প সম্প্রসারণের জন্য আমরা তহবিল জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছি। আমরা এটিকে ৩০টি থেকে সাড়ে চার হাজারে সম্প্রসারিত করতে চাই। এমনকি চলতি ব্যয় আয় থেকে নির্বাহ করা যাবে, তবে স্থানীয় কমিটি প্রতিষ্ঠা ও এগুলোসহ সম্প্রসারণ কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং তাদের প্রয়োজনীয় জ্ঞান সমৃদ্ধ করার জন্য আমাদের এখনও অর্থের প্রয়োজন রয়েছে।
দাতারা বোধহয় জ্ঞান শেয়ার করার প্রকল্প সম্পর্কে উৎকণ্ঠিত; কারণ তারা হয়তো মনে করেন না যে এটা টেকসই হবে অথবা এ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন ও এটা পরিমাপ করাও কঠিন বলে তারা ভাবেন। কিন্তু জ্ঞান শেয়ার করার চেয়ে আর কীই-বা অধিকতর টেকসই হবে? কাউকে কিছু শিক্ষা দিলে তবেই না নির্দিষ্ট বিষয় সস্পর্কে সে জানবে।
একটি আন্তর্জাতিক কর্মসূচিতে ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় একই ধরনের অভিজ্ঞতা হচ্ছে। নেপালে আমাদের কর্মীরা যথেষ্ট ব্যবহারিক কৌশলসম্পন্ন নন। তারা তাৎক্ষণিকভাবে মানুষের প্রশ্নের জবাব দিতে পারেন না। অনেক প্রশ্ন নিয়ে তারা এর জবাবের জন্য বিশেষজ্ঞদের শরণাপন্ন হন। এর কিছু প্রশ্নের জবাব জাতীয় রেডিওর মাধ্যমে দেওয়া হয়। প্রশ্নগুলোর উত্তর বিশেষজ্ঞের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে একজন রেকর্ড করে। এসব উত্তর ল্যাপটপে করে কমিউনিটির কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।
কথা রেকর্ড করা জিম্বাবুয়েতে কাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমরা কমিউনিটির মধ্যে এমপি৩ প্লেয়ারে পডকাস্ট নিয়ে যাই। আমরা এই ডিজিটাল সম্প্রসারণ শুরু করেছি এবং এখন এটা যাতে মন্ত্রণালয়ের সম্প্রসারণ সার্ভিস গ্রহণ ও সম্প্রসারণ করে সে চেষ্টা করছি। এটা স্থানীয় জ্ঞান বিক্রেতাদের কাজ, যারা ফিল্ডে গিয়ে কাজ করেন, কমিউনিটির সঙ্গে কথা বলেন, পডকাস্ট চালান ও পরে আরও মতামত ও প্রশ্ন নিয়ে আসেন। জ্ঞান বিক্রেতাদের যাতায়াত খরচ মেটানোর বিষয়টি স্থায়ী করা একটা চালেঞ্জ। আমরা এ ধরনের কাজে অন্যান্য সংস্থা থেকেও লোকজন নিতে চাই।
আমাদের কাজ যে সবসময় সফল হয় তা নয়। সুদানে জ্ঞানকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার এক উদ্যোগ প্রতিষ্ঠার ব্যয় অপেক্ষাকৃত বেশি হওয়ার কারণে এবং যে কমিউনিটিকে সেবাটি দেওয়া হবে তার আকার ছোট হওয়ায় এটি ভালো চলেনি। তারা আবার তৃণমূল পর্যায়ে পেঁৗছার পন্থাও অনুসরণ করেনি। অথচ সাফল্য পাওয়ার জন্য এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাদের যথাযথ প্রযুক্তি চাহিদাও সংকীর্ণ। অথচ নেপালে 'রিড লাইব্রেরি'গুলো একই ছাদের তলায় জনস্বাস্থ্য ও মাইক্রো ফাইন্যান্সের ব্যাপারেও তথ্যসেবা অফার করে থাকে।
উলি্লখিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে উন্নয়নের ক্ষেত্রে যারা কাজ করছেন তারা প্রধান যে তিনটি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছেন, সেগুলো হলো : প্রত্যন্ত ও অনগ্রসর এলাকায় বসবাসকারী মানুষের সঙ্গে জ্ঞান শেয়ার করা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যে আরও অধিক সম্পদের প্রয়োজন তার জন্য আমরা কীভাবে দাতাদের সাহায্য পেতে পারি। এই অর্থ বিশেষভাবে তৃণমূল পর্যায়ে পেঁৗছার জন্য আবশ্যক এবং সেটা ব্যয়বহুলও বটে।
আমরা কীভাবে জ্ঞান শেয়ার করার ফলাফল পরিমাপ অধিকতর ভালোভাবে সম্পন্ন করতে পারি, যেটা প্রথাগত সেবা প্রকল্প পরিমাপের মতো হবে না।
আমরা কীভাবে একটা কার্যকর জ্ঞানকেন্দ্র পেতে পারি, যেখানে একটি স্থানেই দরিদ্র্র জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজনীয় সব তথ্যসেবাই থাকবে। এতে মানুষের নানা জায়গায় ঘোরার দরকার পড়বে না।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, গরিব মানুষের কাছে জ্ঞান পেঁৗছে দেওয়া দারিদ্র্য দূরীকরণের অন্যতম উত্তম পথ। তবে সেটি শেষ পর্যন্ত অর্জন করাটাই আসল চ্যালেঞ্জ।

ড. ফারুক উল ইসলাম :বাংলাদেশে 'অর্গানাইজেশন্যাল ডেভেলপমেন্ট ফর প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন'-এর প্রধান; লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকা থেকে ভাষান্তরিত

No comments

Powered by Blogger.