বিমানের দুর্দশার চালচিত্র by এ এম এম শওকত আলী

অনেক দিন ধরেই বিমানের আকাশে ওড়ার ক্ষমতা একবারে বন্ধ না হলেও বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। বিমান ১৯৭২ সাল থেকেই কাজ শুরু করে। তৎকালীন পিআইএর অল্প কিছু এফ-২৯ নিয়ে এর যাত্রা শুরু। নামকরণ করা হয়েছিল বলাকা। বলাকার ছবি এখনো বিমানের উড়োজাহাজে দৃশ্যমান একটি স্থিরচিত্র।
যাত্রা শুরুর পর কিছু সময়ের মধ্যে বিমান স্বল্পসংখ্যক আন্তর্জাতিক রুটে যাত্রীসেবা দিয়েছিল। ধীরে ধীরে বিমানের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়। তখন নির্ধারিত সময়ে যাত্রী পরিবহনে বিমান খ্যাতিও অর্জন করতে সক্ষম হয়। অর্জিত সুনাম বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ২০০৯ সালে বিমানের জন্য আরো কয়েকটি উড়োজাহাজ কেনার পরও একে গতিশীল করা সম্ভব হয়নি। ডিসি-১০ নামে কয়েকটি বিমান অতীতে কিনলেও গতিহীন অবস্থার অবসান হয়নি। কারণ অল্প কয়েক বছরে কারিগরি ত্রুটির জন্য এগুলোর পূর্ণ ব্যবহার সম্ভব হয়নি। এক বছরের বেশি সময় ধরে বিমানের বর্তমান দুর্দশার চিত্র মিডিয়া বারবার প্রকাশ করেছে। তা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে সক্ষম হয়নি।
বছর কয়েক আগে একটি সুশাসন বিষয়ক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা বিমানের সার্বিক দুর্দশার বিষয়টি প্রকাশ করেছিল। দুর্দশার কারণ চিহ্নিত করে প্রতিকারমূলক সুপারিশও এ গবেষণায় ছিল। সংস্থাটির আশা ছিল, গবেষণালব্ধ ফলাফল কর্তৃপক্ষ বিচার-বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। বিমানের কর্তৃপক্ষ কে বা কয়টি, সে বিষয়ও জনগণের কাছে অনেকটা অস্বচ্ছ। তবে ধারণা করা যায়, কর্তৃপক্ষ একাধিক। এক, বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ এর পরিচালনা পর্ষদ। বেসরকারি বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। এ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটি। সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদ। সংসদীয় গণতান্ত্রিক প্রথায় এর কোনো বিকল্প নেই। উন্নত দেশেও একই নিয়ম। তা সত্ত্বেও ওসব দেশের জাতীয় এয়ারলাইনসের পরিচালনা কাঠামোতে বেসরকারি অংশীদারি একটি স্বীকৃত প্রথা। এর সঙ্গে যোগ করা যায়, সম্পূর্ণ বেসরকারি এয়ারলাইনসের সঙ্গে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে জাতীয় এয়ারলাইনসকে কর্মক্ষম থাকতে হয়। অনেকের ধারণা, সম্পূর্ণ সরকারি মালিকানাধীন কোনো বাণিজ্যিক সংস্থা আংশিক বেসরকারীকরণ হলে ওই সংস্থার দক্ষতা ও আয় বৃদ্ধি পায়। অনেক দেশে তা হলেও বাংলাদেশে এখনো হয়নি। এর উজ্জ্বল উদাহরণ অধুনালুপ্ত বাংলাদেশ টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ বোর্ড (বিটিটিবি); যাকে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ অনুযায়ী মাত্র কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ টেলিকম কম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) হিসেবে রূপান্তর করা হয়। তবে সম্পূর্ণ মালিকানা হয় সরকারের। এ ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তন অনেকটা কসমেটিক। বিটিসিএলেরও এখন করুণ অবস্থা।
বিগত মাসে মিডিয়ায় বিমানের বর্তমান অক্ষমতা সম্পর্কে কিছু সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। সম্পাদকীয়ও লেখা হয়। প্রসঙ্গ ছিল বিমানের জন্য নতুন উড়োজাহাজ ক্রয়। সম্পাদকীয় মন্তব্যে দেখা যায়, একমাত্র উড়োজাহাজের সংখ্যা বৃদ্ধি করেই বিমানকে সম্পূর্ণ সচল করা সম্ভব হবে না। এ কথা স্বীকৃত যে বর্তমানে প্রয়োজনের তুলনায় বিমানে উড়োজাহাজ নেই। এ কারণেই ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একটি কম্পানি থেকে সরকারি গ্যারান্টি দিয়ে চারটি আধুনিক উড়োজাহাজ কেনার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, ডিসি-১০ ব্র্যান্ডের কয়েকটি উড়োজাহাজ অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই আকাশে ওড়ার ক্ষমতা হারায়। কেন এবং কী কারণে এ ধরনের বিপর্যয় হয়েছিল, তা অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। উল্লেখ্য, বিগত ২৬ ডিসেম্বরের একটি দৈনিকের সংবাদে বিমানের বর্তমান দুর্দশার চালচিত্র প্রকাশ করা হয়। এ সংবাদে বিমানের বর্তমান প্রায় অচল অবস্থার বিষয়ে একাধিক বিষয়ে তথ্য ও বিশ্লেষণ প্রদান করা হয়।
সংবাদমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, বিমান কিছুদিন আগে পাঁচটি আন্তর্জাতিক রুটে যাওয়া বন্ধ করতে বাধ্য হয়। কারণ ছিল হজ মৌসুমে হজযাত্রীদের সৌদি আরবে নিয়ে যাওয়া এবং নিয়ে আসা। প্রতিবছর হজ মৌসুমে বিষয়টি তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি করে। যেহেতু বিমান সম্পূর্ণ সরকারি মালিকানাধীন সেহেতু সরকারের সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন করা বিমানের জন্য বাধ্যতামূলক। কিন্তু এসব বিষয়ে বিকল্প সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনো আগাম উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় না। বিকল্প হিসেবে বিদেশ থেকে অন্য উড়োজাহাজ লিজেও অতীতে আনা হয়েছিল, যদিও এ ছিল অনেকটা খাজনার চেয়ে বাজনা বেশির মতো। সার্বিক বিচারে বলা যায়, সিদ্ধান্ত গ্রহণে রাজনৈতিক প্রভাব থাকলে বিমানের অভ্যন্তরীণ কর্তৃপক্ষ সে সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন করে। কিন্তু এ জন্য বিমানের যে আর্থিক ক্ষতি হবে সে বিষয়টি কোনো গুরুত্ব পায় না।
২০১১-১২ অর্থবছরে বিমানের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। তবে এর সবটাই যে অপেক্ষাকৃত কম ভাড়ায় হজযাত্রীদের সেবার কারণে হয়েছে, তা বলা যাবে না। অতীতে মিডিয়ায় এ কথাও বলা হয়েছে যে বিগত ৪০ বছরে বিমান কখনো লাভের মুখ দেখতে সক্ষম হয়নি। এ তথ্য সঠিক না-ও হতে পারে। কারণ ২০০৯ সালে শোনা গিয়েছিল, বিমান কিছু লাভ করেছে। পক্ষান্তরে বিমানের লাভ-ক্ষতির তথ্যাদি অনেকাংশে বিভ্রান্তিকর। এক সময় বলা হয়, বিমানের ক্ষতির পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকা। হজ মৌসুমের পর প্রকাশিত খবরে জানা যায়, বিমান ৮০ কোটি টাকা লাভ করেছে। অর্থাৎ নিট ক্ষতির পরিমাণ ৪২০ কোটি টাকা; যদি এসব তথ্য সঠিক হয়। কয়েক দিন আগে একটি বাংলা দৈনিকে বলা হয়, বিমানের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে মোট ক্ষতির পরিমাণ ৬৩২ কোটি টাকা। তাহলে মাত্র একটি মৌসুমের ৮০ কোটি টাকা লাভের হিসাব দেওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর।
যাত্রী পরিবহন ছাড়াও ক্ষতির অন্যান্য উৎসও চিহ্নিত করার প্রয়োজন রয়েছে। অপচয় ও দুর্নীতি এর মধ্যে অন্যতম। যাত্রীসেবা মানসম্পন্ন না হলে যাত্রীসংখ্যাও হ্রাস পাবে। বিমান যদি ধারাবাহিকভাবে লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সচল থাকত তাহলে নিজস্ব লভ্যাংশ দিয়েই প্রয়োজনীয় উড়োজাহাজ ক্রয় করতে সক্ষম হতো। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। হজ মৌসুমে যে ৮০ কোটি টাকা লাভের কথা বলা হয়েছে, তার জন্য পাঁচটি আন্তর্জাতিক রুটে চলাচল বন্ধ বা সাময়িকভাবে স্থগিত করার ফলে ভবিষ্যতে আর্থিক অবস্থা কী হবে, তা ভেবে দেখা হয়নি। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া যায় যে যুক্তরাষ্ট্রের চারটি নতুন উড়োজাহাজ সংগ্রহ করা সম্ভব হয় তাহলেই সব সমস্যার সমাধান হবে, সে বিষয়েও সন্দেহ আছে।
২০১২ সালের ১৫ মে বিমান কর্তৃপক্ষ পরিচালনা পর্ষদে সংস্থার তহবিলের অবস্থা সম্পর্কে তথ্য দিয়েছিল। এতে নিট বকেয়া দেখানো হয়েছে ১০০৩.৪৭ কোটি টাকা। একই সঙ্গে বিভিন্ন সংস্থার কাছে বিমানের পাওনা মাত্র ২৫৭ কোটি ১১ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১৭৭.৯৬ কোটি টাকাই বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সির কাছে পাওনা। পক্ষান্তরে পদ্মা অয়েল কম্পানিসহ বিভিন্ন সংস্থায় বিমানের দেনা হলো সর্বমোট ২৩১১.২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে সর্ববৃহৎ পাওনাদার হলো পদ্মা অয়েল কম্পানি- ৫৬৯.৪৪ কোটি টাকা। সার্বিকভাবে বলা যায়, বিমান দেনাগ্রস্ত। এ দেনা আদৌ শোধ করা সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে একাধিক প্রশ্ন জড়িত। যে পাঁচটি আন্তর্জাতিক রুটে বিমান চলাচল বন্ধ করা হয়েছে, সেসব রুটের অতীতে লব্ধ বাজারের অংশ (Market Share) কি বিমান সহজে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে? কারণ একবার যাত্রীদের আস্থা ক্ষুণ্ন হলে তা অতি অল্প সময়ে পুনরায় অর্জন করা যায় না। এ ছাড়া রয়েছে সময়মতো যাত্রা ও ফেরত আসার বিষয়। এ ক্ষেত্রে বিমানের অবস্থা যে করুণ, তা কারো অজানা নয়। এ পরিস্থিতি যে উড়োজাহাজের সংখ্যা কম বলে হয়, সে বিষয়টিও সঠিক নয়। বিমানের বিভিন্ন ইউনিটের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলাবোধের অভাব ও সমন্বয়হীনতাও এর জন্য দায়ী। ক্ষেত্রবিশেষে ভিআইপি বা ভিভিআইপি যাত্রীরাও এর জন্য দায়ী। মাঝেমধ্যে এর উদাহরণ মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়েছে। তবে এ জন্য বিমানকে এককভাবে দায়ী করা সংগত হবে না।
নতুন বিমান সংগ্রহ করেই তা সহজে নিজস্ব পাইলট দিয়ে চালু করা সম্ভব হয় না। কারণ ভিন্ন কম্পানির বিমান চালানোর জন্য বিদ্যমান পাইলটদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়। প্রশিক্ষণ শেষে পরীক্ষায় উত্তীর্ণও হতে হয়। এ কারণে অতীতে দেখা গেছে, প্রাথমিক পর্যায়ে বিদেশি দক্ষ পাইলট দিয়ে কিছুদিন সেবা চালু করা হয়। এ কারণে বিদ্যমান পাইলটদের প্রথম থেকেই এর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ অত্যাবশ্যক। পত্রিকান্তরে জানা যায়, বিমান কর্তৃপক্ষ সার্বিকভাবে পাইলটদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য পরীক্ষার ব্যবস্থা নিয়েছিল। পরীক্ষার ফল সন্তোষজনক না হলে পরবর্তী পদোন্নতি দেওয়া হবে না। দক্ষতা বৃদ্ধির এমন একটি ভালো সিদ্ধান্ত পাইলট সমিতির একাংশ মেনে নেয়নি। তারা ধর্মঘট করেছিল। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়। অন্য দেশেও পাইলটরা বিভিন্ন দাবিতে ধর্মঘট করেন। কিন্তু এর জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয় না। এ ছাড়া রয়েছে নিম্ন বেতনভুক কর্মীদের ধর্মঘট। শৃঙ্খলাভঙ্গ করলেও বিদ্যমান আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের উপায় নেই। কারণ এরা সব সময়ই ক্ষমতাসীন দলের আশীর্বাদপুষ্ট।

লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.