জেগে উঠতে চান আশরাফুল! by শাকিল আহমেদ মিরাজ

ক্রিকেটে ‘আশার ফুল’ হয়ে আবির্ভাব হয়েছিল মোহাম্মদ আশরাফুলের। ২০০১-এ শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো মর্যাদার টেস্ট ক্যাপ পরেই দুর্দান্ত সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে লাল-সবুজের দেশকে করেছিলেন গর্বিত।
সবচেয়ে কম বয়সে টেস্ট সেঞ্চুরির তালিকায় আজও জ্বলজ্বলে তাঁর নাম। কিন্তু ব্যাট হাতে শুরুর সেই উজ্জ্বলতা ধরে রাখতে পারেননি। যে ব্যাটিং ঝলকে বাংলাদেশের বড় সব জয়ের অগ্রসৈনিক হয়ে উঠেছিলেন, গত বেশ কিছুদিন সেই ব্যাটটা বড্ড ম্লান। কি আন্তর্জাতিক, কি ঘরোয়া ক্রিকেট তাঁর ব্যাটের করুণ চিত্র দেখে হিসেব মেলাতে কষ্ট হয় এই কি সেই আশরাফুল! দীর্ঘ সময় ঝিম মেরে থাকার পর নতুন বছরের শুরুতে হঠাৎ করে আড়মোড়া দিয়ে জেগে উঠেছেন আধুনিক বাংলাদেশী ক্রিকেটের স্বীকৃতসেরা প্রতিভাধর ব্যাটসম্যানটি। প্রথমবারের মতো আয়োজিত বাংলাদেশ ক্রিকেট লীগের (বিসিএল) দ্বিতীয় রাউন্ডে সেন্ট্রাল জোনের হয়ে নর্থের বিরুদ্ধে হাঁকালেন উদ্দীপনাদায়ী সেঞ্চুরি। হলেন ম্যাচসেরাও! এক ম্যাচে ভাল করার মানে ‘তিরিশ’ ম্যাচ ঘুমিয়ে থাকা ফের তেমনটাই হবে? প্রত্যাশিত প্রশ্ন! কিন্তু এবার ভক্তদের আশ্বস্ত করলেন, আশরাফুল জানালেন, আর ঘুমিয়ে নয় সব ব্যর্থতার গ্লানি পেছনে ফেলে এবার জেগে উঠতে চান তিনি। হতাশার সরল স্বীকারোক্তির পাশাপাশি জনকণ্ঠের মাধ্যমে দেশজুড়ে অগণিত ভক্তকে আগাম প্রত্যাশার কথাই শোনালেন তিনি।
শুরুতেই দীর্ঘদিন পর ফার্স্টক্লাস সেঞ্চুরির অনুভূতি জানাতে গিয়ে বললেন, ‘অনেক ভাল লাগছে, কারণ গত মৌসুমে মোটেই প্রত্যাশা মতো খেলতে পারিনি। ব্যাট হাতে কোন কিছুই আমার মনের মতো হয়নি। প্রচ- হতাশা কাজ করেছে। নতুন বছরের শুরুতে সেঞ্চুরি পেয়ে তাই কি যে ভাল লাগছে, বোঝাতে পারব না!’ সেঞ্চুরিটা তো আরও দীর্ঘ হতে পারত, বগুড়ার ড্র ম্যাচে সে সুযোগ ছিল। স্বীকার করে নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমারও তাই মনে হয় ইনিংসটা আরও দীর্ঘ হতে পারত। অন্তত দেড় শ’ বা তার বেশি হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু মাত্র ৮৮ রানে ৪ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর মেহরাব-মোশাররফকে নিয়ে দলের প্রত্যাশা মেটাতে পেরেও ভাল লেগেছে।’ টেস্টে ৫০ হলেই যেখানে যথেষ্ট সেখনে আপনার স্ট্রাইক রেট বরং বেশি ছিল। আরেকটু স্লো হলেও হতো এমন প্রশ্নে পুরোপুরি একমত হতে পারলেন না। বললেন, ‘আসলে সকালের পর উইকেট সহজ হয়ে এসেছিল। আমি আমার স্বভাবসুলভ ব্যাটিং করে বোর্ডে রান জমা করেছি। বল ব্যাটে আসায় স্ট্রাইক রেটটা বেড়েছে।’ সেঞ্চুরিকালে জুটি হিসেবে অপরপ্রান্তে মেহরাব হোসেন জুনিয়রকে পাওয়া সম্পর্কে বেশ ইতিবাচক মন্তব্য করেন। জানান, ‘ঘরোয়া ক্রিকেটে এর আগেও তাঁর সঙ্গে আমার অনেক জুটি হয়েছে। দীর্ঘ ভার্সনে দারুণ ছন্দে থাকা একজন ব্যাটসম্যান মেহরাব। তাঁর সঙ্গে আমার বোঝাপড়া চমৎকার। একটা বড় ইনিংস খেলতে অপরপ্রান্তে ভাল সাপোর্ট থাকা গুরুত্বপূর্ণ। মেহরাব ও আমার ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে। তিনি নিজেও সেঞ্চুরি পেয়েছেন। অনফিল্ডে পার্টনার হিসেবে মেহরাব ও অধিানয়ক মোশারফ হোসেন (রুবেল) দু’জনই চমৎকার।’
কতদিন পর এমন ভাল খেললেন, মনে করতে পারছেন কঠিন বাস্তব প্রশ্নে হতাশা লুকালেন না আশরাফুল। বললেন, ‘ওই যে বললাম গত মৌসুমটা আমার খুবই বাজে কেটেছে। ২০১২-১৩ ন্যাশনাল লীগের ১১ ইনিংসে ন্যূনতম একটা ফিফটিও ছিল না। বিশ্বাস করবেন, ভাবতে খারাপ লাগে যে, এই সেঞ্চুরির আগের শেষ ১০ ইনিংসের মধ্য আমার সর্বোচ্চ ইনিংস ছিল মাত্র ২২ রানের! গত বছর ইংল্যান্ডের মাইনর ক্রিকেটে (কেন্ট) একটি সেঞ্চুরি করেছিলাম। কিন্তু প্রথম শ্রেণী ধরলে দীর্ঘ সময় ২০১১ সালে চট্টগ্রামের সেই ১১৯ রানের ইনিংস!’ ব্যর্থতার সেই সময়গুলো কেমন লাগত? ‘জাতীয় লীগে কয়েকটা ইনিংস খারাপ করার পর হয়ত অনেক চাপ নিয়ে ফেলেছিলাম। মাঝে মাঝে নিজেরই মনে হতো ব্যাটিং করতেই পারি না, সবকিছু ভুলে গেছি। আত্মবিশ্বাস একদমই কমে গিয়েছিল। কী যে হয়েছিল, আমি নিজেই যেন বুঝতে পারছিলাম না!’ এত কঠিন অবস্থার মধ্যে এমন গুরুত্বপূর্ণ লীগে খেললেন এবং সেঞ্চুরি পেলেন... ‘আসলে খুব খারাপ লেগেছে। মানসিকভাবে এতটাই বিধ্বস্ত ছিলাম যে আমি তো বগুড়ার ম্যাচটাতে খেলতেই চাইনি! নিজেকে অপরাধী বলে মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল দলের বোঝা হয়ে অন্য একজনের জায়গা নষ্ট করছি। তাই ভেতরে ভেতরে ঠিক করে ফেলেছিলাম যে ফ্র্যাঞ্জাইজিতে আর খেলব না। একেবারে বিপিএলের সময় মাঠে নেমে ধুমধারাক্কা ব্যাটিং করব। কিন্তু সেন্ট্রালের ম্যানেজার সানোয়ার ভাই অন্তত একটা ম্যাচ খেলতে বললেন, কোচ বাবুল ভাইও অনুরোধ করলেন। হ্যামস্ট্রিং ইনজুরিতে পড়া অধিনায়ক মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ বলল, দোস্ত আমি খেলতে পারছি না। তুই থাকলে টিমের ছেলেরা বাড়তি সাহস পাবে।’ তার মানে বগুড়ার সেঞ্চুরিটাকে আপনার ক্যারিয়ারের অন্যতম একটা ঘটনাই বলতে হবে একমত পোষণ করে আশরাফুল বলেন, ‘অবশ্যই, সবচেয়ে বড় কথা ইনিংসটাও খুব সুন্দর ছিল। মনের মতো। ২৩টি চার মেরেছি, ২টি কেবল পেছন দিয়ে। বাকিগুলো সব ফ্রন্টফুটে, সামনে দিয়ে। সবকিছুই হয়েছে আমার মতো, ভাল খেললে যেমন খেলি। অনেক কাভার ড্রাইভও খেলেছি। সুমন ভাই (নির্বাচক হাবিবুল বাসার সুমন) এসে বললেন, তুই তো চার-পাঁচ বছর আগের মতো ব্যাটিং করলি রে! আমারও তাই মনে হয়েছে। আসলে ভাল খেললে নিজেই বোঝা যায়।’ কথাগুলো বলতে বলতেই হতাশা উধাও হযে কণ্ঠ থেকে প্রত্যাশার ঝাঁজ বেরোল নিজেকে ফিরে পাওয়া এই ঢাকার লোকাল ক্রিকেটারের। সুযোগ বুঝে প্রশ্নটাও চলে এলো। জাতীয় দল, দেশের অগণিত ভক্তের চোখ এখনও বাংলাদেশের জার্সিতে সেই পুরনো আশরাফুলকে দেখতে উদগ্রীব তাদের সে চাওয়া কি পূরণ হবে? ব্যর্থতা স্বীকারের পাশাপাশি আশার কথাও শোনালেন তিনি। বললেন, ‘আমার নিজেরও তো কষ্ট লাগে। মানুষ যে ক্রিকেটার আশরাফুলকে কতটা ভালবাসে, সেটা আমি বুঝতে পারি। এই যেমন বগুড়ার ইনিংসটার একটা ঘটনাই দেখুন স্কোরার আমার রান যখন লিখেছে ১২, গ্যালারি থেকে দর্শক চিৎকার করে বলেছে ১২ নয়, ১৩ হবে। এর অর্থ তারা মনে মনে আমার প্রতিটি রানই গুনে রাখছিল। ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রাম, দেশে-বিদেশে যেখানে যাই সবাই বলে তারা আমাকে কতটা মিস করে। সত্যি গত কয়েক বছর আমি এই ভালবাসার মূল্য দিতে পারিনি। তবে সময় ফুরিয়ে যায়নি। এই সেঞ্চুরিটি আমাকে নতুনভাবে উজ্জীবিত করছে। খুব অল্প বয়সে ক্রিকেটে এসেছি, তাই এখনও সামনে সময় আছে। ফর্ম-ফিটনেস ধরে রেখে পরবর্তী প্রতিটি ম্যাচেই ভাল খেলতে চাই। মানুষের ভালবাসার প্রতিদান দিতে আমি নিজেও অধীর হয়ে আছি। নতুন বছরেই পারব ইনশাল্লাহ। আমার জন্য দোয়া করবেন।’

No comments

Powered by Blogger.