যার কলম ছিল যথার্থই অসি by আবদুল মতিন

১৯৮৯ সালে আমার রচিত 'স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি' বইটির প্রকাশনা অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে আমি ঢাকায় গিয়েছিলাম। ১৯৬০ সাল থেকে লন্ডনে বসবাস করার ফলে ঢাকার বিদগ্ধ সমাজের অনেকের সঙ্গে আমার সরাসরি যোগাযোগ ছিল না।
প্রকাশনা অনুষ্ঠানে ৪-৫ জন আলোচকের উপস্থিতি আমার কাম্য ছিল। আমি দৈনিক সংবাদ অফিসে গিয়ে সন্তোষ গুপ্তের সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী ছিলেন, তাও আমার জানা ছিল না। পরে জেনেছিলাম ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বর মাসে সন্তোষ গুপ্তের বাড়িতে কমিউনিস্ট পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মীদের গোপন বৈঠক চলাকালে সরদার ফজলুল করিমসহ আরও অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছিল। দেশ বিভাগের আগে সন্তোষ গুপ্ত কলকাতায় আইজি প্রিজন অফিসে চাকরিরত ছিলেন। দেশ বিভাগের পর 'অপসন' দিয়ে ঢাকায় আসার পর তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে চাকরিচ্যুত হন। এরপর তাকে বহুবার কারাবাস করতে হয়। ঢাকার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তার লেখা রাজনৈতিক নিবন্ধ পড়ে তার বিদগ্ধ মনের পরিচয় পেয়েছিলাম। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করার পর তার রচিত রাজনৈতিক নিবন্ধনগুলো থেকে বাঙালি জাতীয়তা ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের প্রতি তার আনুগত্য সহজেই বোঝা যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে তিনি তার কলমকে অসি হিসেবে ব্যবহার করতেন। বঙ্গবন্ধুকে সামরিক ক্যুর মাধ্যমে হত্যা করে ক্ষমতা দখলকারী জেনারেল জিয়া এবং পরবর্তীকালে জেনারেল এরশাদ ও তাদের তল্পিবাহকদের মুখোশ উন্মোচন করা তার জীবনের ব্রত হিসেবে তিনি গ্রহণ করেন। তাকে আমার বইটির প্রকাশনা অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে যোগদানের আমন্ত্রণ জানালাম। তিনি সানন্দে রাজি হলেন। কয়েকদিন পর দৈনিক সংবাদে তার এক লেখায় তিনি বলেন, 'স্বাধীনতা সংগ্রাম সশস্ত্র রূপ নেওয়ার পর যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয় এবং গুণগত পরিবর্তন দেখা দেয়, তারই পটভূমিতে প্রবাসী বাঙালি কর্মকাণ্ড গ্রন্থটিতে তুলে ধরা হয়েছে। ...যারা স্বেচ্ছায় এবং স্বার্থপ্রণোদিত ইতিহাস বিকৃত করে চলেছেন, এই গ্রন্থটি তাদের চিনিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে পাঠককে সাহায্য করবে।
স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ হয়েছে দু'যুগও হয়নি। এ যুদ্ধ যারা প্রত্যক্ষ করেছেন, সক্রিয় অংশ নিয়েছেন নানাভাবে এবং যুদ্ধের আগুনের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন সমগ্র জাতি, সয়েছে দুর্ভোগ আর লাঞ্ছনা, বর্তমানে তাদেরই একটা অংশ ঘটনাকে অতিরঞ্জিত, বিকৃত কিংবা সম্পূর্ণ সুপরিকল্পিত তথ্য আবিষ্কার করে ইতিহাস বিকৃত করার চক্রান্তে লিপ্ত। তখন স্বাভাবিকভাবেই বর্তমান প্রজন্ম সংশয়াচ্ছন্ন ও বিভ্রান্ত। এই গ্রন্থটি সেই সংশয়ের কুয়াশা ছিন্ন করবে।
গবেষণার ক্ষেত্রেই এটি শুধু মূল্যবান গ্রন্থ নয়, একটি আত্মবিস্মৃত জাতির জাগরণের জন্যও বইটির মূল্য অপরিসীম।' (দৈনিক সংবাদ, ২২ জুন ১৯৮৯)
১৯৯০'র দশকের মাঝামাঝি দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়, 'দি অটোবায়োগ্রাফি অব অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান'-এর যুক্তরাজ্যবাসী বাঙালি লেখক নীরদ চৌধুরীর কয়েকজন সাহিত্যপ্রেমিক ভক্ত তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশ্যে 'নীরদ চৌধুরী অনুশীলন সমিতি' গঠন করার ঘোষণা প্রকাশ করেছেন। আমার 'স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি' বইটিতে মুক্তিযুদ্ধকালে ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণকারী নীরদ বাবুর বাংলাদেশবিরোধিতার খবর সন্তোষ গুপ্ত পড়েছিলেন। তাকে আমি বললাম, নীরদ বাবুর বাংলাদেশ বিরোধিতা ও পাকিস্তান প্রেম সম্পর্কে লন্ডনের দি টাইমসে প্রকাশিত একটি চিঠি উদ্ধৃত করে তার বাঙালি ভক্তদের চোখ খুলে দেওয়ার জন্য আমি একটি প্রবন্ধ লিখতে চাই। তিনি বললেন, আগামীকাল লেখাটি নিয়ে এলে ছাপানোর ব্যবস্থা করবেন। লেখাটি সন্তোষ গুপ্তের সহযোগিতায় দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত হওয়ার পর নীরদ বাবুর বাঙালি ভক্তরা প্রস্তাবিত সমিতি গঠন করা থেকে বিরত থাকেন।
বাংলাদেশের শিল্পকলা সম্পর্কিত সমালোচনার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন একজন পথিকৃৎ। তার শিল্পের কথা ও বাংলাদেশের চিত্রকলা :শিল্পী ও শিল্পরূপ_ গ্রন্থ দুটি আমার হাতে এসেছে। যে কোনো সংস্কৃতিমনা ব্যক্তির গ্রন্থ দুটি পাঠ করা অত্যন্ত জরুরি বলে আমি মনে করি। সন্তোষদাকে জন্মদিনে শুভেচ্ছা।

আবদুল মতিন : লন্ডন প্রবাসী
কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.