সাক্ষাৎকার গ্রহণ :সুভাষ সাহা ও একরামুল হক শামীম-বর্তমান রাজনৈতিক কাঠামো তরুণদের আকৃষ্ট করছে না-সাক্ষাৎকার by ড. আলী রীয়াজ

সমকাল : বাংলাদেশে এ বছর নির্বাচনী বছর। এখানকার রাজনীতি কী রকম দাঁড়াবে? আলী রীয়াজ : বাংলাদেশ যে অনতিক্রম্য সংকটের মধ্যে পড়ে গেছে তা কিন্তু নয়। নির্বাচন করার জন্য একটা ব্যবস্থা তৈরি করা দরকার।
ক্ষমতাসীন দল মনে করেছিল, বাংলাদেশ এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া দলীয় সরকার নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে এবং সে ধরনের আস্থা তৈরি করতে পেরেছে। এর জন্য তারা পঞ্চদশ সংশোধনী করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করেছে। আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি অবস্থা ঠিক সেরকম নেই।
সমকাল : তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুটিতে কোন পথে সমাধান?
আলী রীয়াজ :তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে যে এক ধরনের সমস্যা ছিল তা এখন আর থাকার কোনো কারণ নেই। প্রায় এক বছরের বেশি সময় ধরে এটি নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। বিতর্কের পরে তিনটি নির্ভরযোগ্য জরিপ হয়েছে_ সমকালের, ডেইলি স্টারের এবং প্রথম আলোর। অন্যান্য বিষয় নিয়ে খানিকটা ভেরিয়েশন থাকলেও এই একটা বিষয় নিয়ে কোনো ভেরিয়েশন নেই। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ বলেছে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি-না তা নিয়ে তাদের মনে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। তারা মনে করেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করা দরকার। আমি ব্যক্তিগতভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে ছিলাম না। ১৯৯৬ সালে এটার বিরোধিতা করেছিলাম। আমি মনে করি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার দীর্ঘমেয়াদে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য ইতিবাচক না। এটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে দেয় না। আমি এটাও বলেছিলাম যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেভাবে বাতিল করা হয়েছে আমি তার বিরুদ্ধে। এপ্রিল মাসে আমি প্রস্তাব করেছিলাম, গণভোট করা হোক। সম্প্রতি ড. আকবর আলি খান সেটা বলেছেন। আমার কাছে মনে হয়, এখন গণভোট করার বাধ্যবাধকতা কমে গেছে। এই তিনটি জরিপের পর আমরা একটা ধারণা পেয়ে গেছি। এই মুহূর্তে কীভাবে সেটা করা যেতে পারে সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন। দলগতভাবে এটা বিএনপি দাবি করেছে, তা আমি ধর্তব্যের মধ্যে নিতে চাই না। একটা জরিপে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বিএনপির চেয়ে বেশি; কিন্তু সেই জরিপেও দেখা গেছে লোকজন তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাচ্ছে। তার মানে এটি দলীয় বিবেচনা থেকে ঘটেনি।
সমকাল :পত্রিকার জরিপগুলোকে কীভাবে দেখছেন?
আলী রীয়াজ : জরিপগুলো আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। এগুলো পেশাদারিত্বের লক্ষণ। যেসব গণমাধ্যম গ্রহণযোগ্য, লোকজন যাদের ওপর নির্ভর করে তারা পেশাদারিত্বের সঙ্গে এই কাজগুলো করছে। এটা ইতিবাচক দিক। আমি আশা করি, এটা কেবল বার্ষিক না করে বিশেষ করে এই শেষ বছরে তিন মাস, ছয় মাসের মধ্যে আবার করা হয়, তাহলে আমরা বুঝতে পারব কোনো পরিবর্তন হচ্ছে কি-না।
সমকাল : আমরা কি অনিশ্চয়তার পথে চলছি?
আলী রীয়াজ : অনিশ্চয়তা তো অনেকটা কমে আসার কথা। কোন সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে। নির্বাচন করা নিয়ে কোনো পক্ষেরই সরকার, বিরোধী দল, সুশীল সমাজ, আমাদের ডেভেলপমেন্ট পার্টনার কারও মনে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই। এখন স্পষ্ট যে, অধিকাংশ লোক মনে করে তত্ত্বাবধায়ক একটা ব্যবস্থা। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার কাঠামো কেমন হবে, অতীতে যেমন ছিল তেমন হবে কি-না তা নিয়ে বরঞ্চ দ্রুত আলোচনা করা দরকার। এই আলোচনা করতে হলে আসলে দুই পক্ষকেই ছাড় দিতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সংবিধানের মধ্য থেকেই এই অনিশ্চয়তা মেটানো যাবে কি-না। সংবিধানের মধ্যেও কিছু সৃষ্টিশীল সমাধানের পথ কিন্তু আছে। ইতিবাচক দিক হচ্ছে, বিএনপি একেবারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবি করছে না। তারা এক ধরনের নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকার চাচ্ছে, যাতে করে নির্বাচনটা হতে পারে। ওই নিশ্চয়তা দূরীকরণে পদক্ষেপ সরকারকেই নিতে হবে। পার্লামেন্টে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। নির্বাচনের জন্য সংবিধানের পরিবর্তন হয় তারা সেটা করতে পারেন। কিন্তু আমি মনে করি, সংবিধান পরিবর্তন না করেও এক ধরনের নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা যায়। তার জন্য কিছুটা ক্রিয়েটিভ হতে হবে এবং দুই পক্ষকেই ছাড় দিতে হবে।
সমকাল :অধিকাংশ সময় দেখা গেছে বিদেশি ডোনার দেশগুলো শেষ পর্যন্ত নির্ধারকের ভূমিকা পালন করে। এ ক্ষেত্রেও কি তাদের সেই ভূমিকা পালন করতে হবে?
আলী রীয়াজ : বাংলাদেশের ডেভেলপমেন্ট পার্টনাররা যে ভূমিকা পালন করে সেই ভূমিকা পালন করার দায়িত্ব তাদের নয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, অচলাবস্থা এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণে তারা এই ভূমিকা পালন করে। অতীতেও তারা করেছে। বিশেষ করে ২০০৬ সালে আমরা দেখেছি তাদের প্রাণান্তকর চেষ্টা। সেটা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝিও রয়েছে, একেকজন একেকভাবে ব্যাখ্যা করেছে। আবার সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে ২০০৬ সালের মতো উদ্যোগী ভূমিকা ডোনাররা পালন করবে বলে আমি মনে করি না। সেটার দিকে যদি কেউ তাকিয়ে থাকেন, রাজনীতিক কিংবা সুশীল সমাজের, তাহলে তারা আসলে নিজস্ব দায়িত্ব পালন না করার অজুহাত খুঁজছেন। সেটা মোটেও কাঙ্ক্ষিত হতে পারে না। যদি শেষ পর্যন্ত অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বা বাধ্য হয়ে আন্তর্জাতিক সমাজের প্রতিনিধিদের এই প্রক্রিয়ার মধ্যে অংশগ্রহণ করতে হয়, আমার মনে হয় না সেটা শিগগিরই হবে। রাজনৈতিক সংকট যদি এমন পরিস্থিতির দিকে পেঁৗছায় যে আর কোনো উপায় নেই, তাহলে তখন তারা এর সঙ্গে যুক্ত হবে। সেই পরিস্থিতির সৃষ্টি হোক সেটা কারও কাছে কাঙ্ক্ষিত নয়। ওই পর্যন্ত যেতে হলে দেশের অর্থনীতির সংকট, দেশের সাধারণ মানুষের জীবনহানির আশঙ্কা ঘটবে। লক্ষ্য করে দেখুন, বিষয়টা কেবল রাজনৈতিক নয়। এটা আমরা কখনও কখনও ভুল করি। এ ধরনের রাজনৈতিক সংকট যখন তৈরি হয় তার কতগুলো সামাজিক প্রতিক্রিয়া আছে। গত তিন মাসে বাংলাদেশে গণধর্ষণের পরিমাণ যে হারে বেড়েছে তাকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে আলাদা করে যারা ভাবেন আমার মনে হয় তাদের বোঝার ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে। যখনই সমাজে ইমপিউনিটি তৈরি হয়, দায়মুক্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তার জন্য কেবল রাজনৈতিক ব্যক্তি, দল, সংগঠন, কর্মীরাই এর সুবিধা ভোগ করেন না। তখন সমাজের অন্যরা মনে করতে থাকে, আমিও এই দায়মুক্তি ব্যবস্থার মধ্যে। সরকার আসলে কিছু করতে পারবে না, পুলিশ প্রশাসন কিছু করবে না। এসব ক্ষতি আমাদের বহন করতে হয়। সেটা আমাদের জন্য ইতিবাচক নয়।
সমকাল :তার মানে কি এই সমাজ পুলিশ প্রশাসনের প্রতি অনাস্থার দিকে যাচ্ছে?
আলী রীয়াজ : এটাকে এখন আর আমি ভবিষ্যৎ বলে মনে করি না। কার্যত বাস্তব পরিস্থিতি হচ্ছে, বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা নেই। পুলিশ, আদালত, নির্বাচন কমিশন, পিএসসি, দুর্নীতি কমিশন এসব প্রতিষ্ঠান আসলে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য থাকে না। অথচ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা জনগণের কাছে। এখন আর কোনো প্রতিষ্ঠানই দায়বদ্ধ নয়, কোনো প্রতিষ্ঠানই বিতর্কের ঊধর্ে্ব নয়। তাহলে হঠাৎ করে পার্লামেন্ট বিতর্কের ঊধর্ে্ব থাকবে আর সব প্রতিষ্ঠান বিতর্কিত থাকবে এটা তো হতে পারে না।
সমকাল :আমাদের সংবিধানে ন্যায়পাল নিয়োগ দেওয়ার বিধান রয়েছে। ন্যায়পাল নিয়োগ দিলে সমস্যার কতটুকু সমাধান হতে পারে?
আলী রীয়াজ : খুব সামান্য। আদৌ হবে কি-না তা নিয়ে আমার সংশয় আছে। একজনকে ন্যায়পাল নিয়োগের মধ্য দিয়ে কিছুই তৈরি করা যাবে না। দুর্নীতি কমিশন সঠিকভাবে কাজ করতে পারত। কিংবা নির্বাচন কমিশন কাজ করতে পারত। এখন নির্বাচন কমিশন বিতর্কিত হয়ে পড়ছে। অথচ নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের প্রক্রিয়া অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে ভিন্ন ছিল। এত কিছুর পর ন্যায়পালের মতো একটি মাত্র প্রতিষ্ঠান করে বড় কী কাজ হবে?
সমকাল : যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আপনার মতামত কী?
আলী রীয়াজ :যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে এ দেশের মানুষের দায়, এ জাতির দায়। ৪০ বছর আমরা বিচার করতে পারিনি এটা আমাদের জন্য লজ্জার বিষয়। এ সরকার এ উদ্যোগটা নিয়েছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের মার্চ মাসে এ উদ্যোগ নিয়েছে। আরও দ্রুততার সঙ্গে উদ্যোগ নিলে ভালো হতো। শুরু করার পর ক্ষেত্রবিশেষে স্বচ্ছতার অভাব, ক্ষেত্রবিশেষে রাজনৈতিক বিবেচনা, ক্ষেত্রবিশেষে পদ্ধতিগত ত্রুটি আমরা লক্ষ্য করেছি। এসব বিষয়ে সরকার কিছু কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু সব পদক্ষেপ আমার কাছে যথেষ্ট মনে হয়নি। তার অর্থ কি এই যে, আমি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করছি? অবশ্যই না। আমি মনে করি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া খুবই জরুরি। কেননা এই জাতি হচ্ছে ভিকটিম। যারা অভিযুক্ত হয়েছেন তাদের অধিকার আমাদের নিশ্চিত করতে হবে, সেটা আইনের শাসনের কারণেই প্রয়োজন। পাশাপাশি এটাও আমাদের মনে রাখতে হবে, ভিকটিমের জাস্টিসও নিশ্চিত করতে হবে। জাতি হিসেবে আমি ভিকটিম হয়েছিলাম। ভিকটিমদের জাস্টিস ডেলিভার করার ক্ষেত্রে যাতে আমি জাতি হিসেবে গর্ব করে বলতে পারি তা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশের প্রত্যেকেই যেন গর্বের সঙ্গে বলতে পারে, ৪০ বছর পরেও আমরা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করেছি। জাতি হিসেবে ভিকটিম হওয়ার পরেও ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে আমরা পিছপা হইনি।
সমকাল : দণ্ড হয়ে গেলে কোনো অস্থিরতা কি হতে পারে?
আলী রীয়াজ : অস্থিরতার আশঙ্কাকে আমি ছোট করে দেখছি না। তার জন্য সরকারের প্রস্তুতি থাকা দরকার। প্রস্তুতি বলতে আমি রাজপথে মোকাবেলার প্রস্তুতিকে বোঝাচ্ছি না। প্রস্তুতি বলতে এ নিয়ে যে কোনো প্রশ্ন উঠলে যাতে স্বচ্ছ এবং গ্রহণযোগ্য উত্তর দেওয়া যায়। অস্থিরতার আশঙ্কা আছে। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারের প্রস্তুতি আমার কাছে দুর্বল বলে মনে হয়। যারা বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত তাদের নিরাপত্তা দেওয়া, সাইবার সিকিউরিটি নিশ্চিত করা। সবই তো লজিসটিক্যাল প্রস্তুতি। এতে কোথায় যেন ঘাটতি দেখতে পাই। সে জন্যই আমার ভয় হয়।
সমকাল : যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব বিচারকে কীভাবে দেখছে বলে আপনার মনে হয়?
আলী রীয়াজ : যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি আমি যতটুকু বুঝতে পারি যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে নয়। কিছু পদ্ধতিগত বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র কিছু কিছু প্রশ্ন তুলেছে। সেটা কিন্তু তারা পাবলিকলি করে না। যতদূর সম্ভব সরকারের কাছে অভিহিত করার চেষ্টা করে। এগুলো পাবলিক ডিসকাশনের চেয়ে ডিপ্লোমেটিক লেভেলে মোকাবেলা করা দরকার।
সমকাল : রায় হয়ে গেলে বিএনপি-জামায়াত ঐক্যের মধ্যে কোনো প্রভাব পড়বে?
আলী রীয়াজ : আমার মনে হয় না কোনো প্রভাব পড়বে। বিএনপি এবং জামায়াতের ঐক্যকে আমি যেভাবে দেখি সেটা হচ্ছে তুলনামূলকভাবে তারা আদর্শিক দিক থেকে অনেক কাছাকাছি। অবশ্যই এক আদর্শের দল মনে করি না। দুটি দলের মধ্যেই বেশ কিছু পার্থক্য আছে, কিছু কিছু পার্থক্যকে আমার কাছে মৌলিক মনে হয়। কিন্তু এটাকে এখন আর আমি রাজনৈতিক সুবিধার ঐক্যও মনে করি না। এক সময় রাজনৈতিক সুবিধার কারণে এই ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকতে পারে, নির্বাচনী অঙ্ক সেখানে কাজ করতে পারে। কিন্তু বছরের পর বছর একসঙ্গে কাজ করার মধ্য দিয়ে তারা আসলে অনেক অর্থেই কাছাকাছি এসেছে। অনেক ক্ষেত্রেই এই ঐক্য আদর্শিক।
সমকাল : পদ্মা সেতুর অর্থায়ন কি হতে পারে?
আলী রীয়াজ : পদ্মা সেতুর অর্থায়নের সম্ভাবনাকে আমি ছোট করে দেখি না। যেসব কারণে সরকারের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে তা দুর্নীতির সংজ্ঞায়ন প্রসঙ্গে। সরকারের ধারণা, অর্থের হাতবদলই দুর্নীতি, এর বাইরে কোনো দুর্নীতি নেই। কিন্তু বিশ্বজুড়েই দুর্নীতির সংজ্ঞা পরিবর্তিত হয়েছে। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটেই বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ ছিল দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে। এখন ওই সব বিষয়ে দূরত্ব কমেছে এবং কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে পদ্মা সেতু এই মেয়াদে হবে কি-না সেটা প্রশ্ন হতে পারে। সাধারণত সরকারের মেয়াদের শেষ বছরে বড় কোনো প্রকল্প হয় না।
সমকাল : কিন্তু আমাদের এখানে তো উল্টো ব্যাপার ঘটে। শেষ বছরে বড় বড় প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়।
আলী রীয়াজ : উদ্বোধন করা হয়, কিন্তু কাজ হয় না। আমাদের এখানে এসব উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে ভোট তৈরি করার চেষ্টা করা হয়। এটা খানিকটা দক্ষিণ এশীয় সংস্কৃতি।
সমকাল :আপনি সামাজিক যোগাযোগ সাইট ফেসবুকে নিয়মিত। তরুণ প্রজন্ম ফেসবুকে অনেক সক্রিয়। তরুণ প্রজন্ম রাজনীতি নিয়ে কী ভাবছে, রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ড নিয়ে কী লিখছে? আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
আলী রীয়াজ : আমার প্রচুর বন্ধু আছে যাদের অধিকাংশ বাংলাদেশের এবং বয়সে কম। আমি আসলে ফেসবুককে বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীদের চিন্তাভাবনা বোঝার জন্য ব্যবহার করি। এখন বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক কাঠামো তরুণ-তরুণীরা ঠিক তার মধ্যে কমফোর্টেবল বোধ করে না। কেননা বাংলাদেশ নিয়ে তাদের যেসব প্রত্যাশা এবং বাংলাদেশের মধ্যে তারা যে সম্ভাবনা দেখতে পান তা ধারণ করার মতো এখানকার রাজনৈতিক কাঠামোকে তারা মনে করেন না। কাঠামোগত সমস্যা একটা তৈরি হয়েছে। এখানকার বিরাজমান রাজনৈতিক কাঠামো এবং দলগুলোর কাঠামো আসলে তরুণ-তরুণীদের আকৃষ্ট করতে পারছে না। দ্বিতীয়ত, যা আমার কাছে মনে হয়েছে তরুণ-তরুণীরা আসলে বিভিন্নভাবে যুক্ত। ষাটের, সত্তরের, আশির এমনকি নব্বইয়ের দশকের রাজনীতি বলতে আমরা যেমনটা বুঝতাম তেমন করে রাজনীতিতে তারা দেখে না। রাজনৈতিক সক্রিয়তার বিভিন্ন পর্যায় আছে, প্রক্রিয়া আছে। বিভিন্ন সোশ্যাল ইস্যুতে তরুণ-তরুণীরা প্রতিবাদ করতে চায়, কিন্তু তখন স্ট্রাকচার খুঁজে পায় না। ফলে ফেসবুকেই হয়তো তারা এক ধরনের ক্ষোভ, বিক্ষোভ, আহাজারি লিখে প্রকাশ করে। শেষ পর্যন্ত কিছু হয়, কিছু হয় না। আমার ধারণা, ভবিষ্যতে এ ধরনের ইস্যুতে কাঠামো তৈরি হবে। সেটা শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক কাঠামোকে পরিবর্তন করতে পারবে কি-না জানি না। আমি এটা মোটেও বিশ্বাস করি না যে, বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীরা রাজনীতির ব্যাপারে অনুৎসাহী। রাজনীতির ব্যাপারে তাদের ধারণার পরিবর্তন হয়েছে। সেটা আমরা বুঝতে পারছি না। দল করে না বলেই আমরা ধরে নিচ্ছি, এরা বোধহয় রাজনীতিতে উৎসাহী না। সামাজিক আন্দোলন হচ্ছে রাজনীতির ধারণা, অর্থনীতির ব্যাপারে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা তাদের কাছে রাজনৈতিক ধারণা। শুধু প্রতিক্রিয়া নয়, সামনের দিকে তাকানো সেই ধারণার অংশ। যাতে করে একই ধরনের সমস্যা সামনে না হয়। এগুলো আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আসলে বিবেচনাতেই নিতে পারছেন না। তারা অত্যন্ত বেশি মাত্রায় অতীতের কাঠামোতে আটকে গেছেন। কাঠামোটা যেহেতু তরুণ-তরুণীদের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না, ভবিষ্যতে তারা নতুন কাঠামো তৈরি করবে কি-না সেটা তাদের ব্যাপার। আমি সবসময় তরুণ-তরুণীদের বলি, এখন থেকে ২৫ বছরের পরের বাংলাদেশ তাদের। সেটা নিয়ে তাদেরই আসলে কাজ করতে হবে। সম্ভাবনা যা আছে তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব তরুণ প্রজন্মের। সেটা তাদের স্বার্থেই দরকার। আমি বলব, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এক ধরনের সচেতনতা তৈরি হয়েছে। তারা বুঝতে পেরেছে, ২৫ বছরের পরের বাংলাদেশ তাদের বাংলাদেশ।

No comments

Powered by Blogger.