সাদাকালো-নারীশক্তির বলিষ্ঠ প্রকাশই নারী নির্যাতন রোধ করতে পারে by আহমদ রফিক

শেষ পর্যন্ত লড়াইয়ে হার মেনে মৃত্যুর কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত সমর্পণের মধ্য দিয়েই প্রতিবাদ জানিয়ে গেলেন নির্যাতিত ভারতীয় তরুণী, যাঁকে নিয়ে ভারতীয় সমাজে বলতে গেলে একরকম আলোড়নই সৃষ্টি হয়েছে।
বিব্রত সেখানকার শাসনযন্ত্র- প্রধানমন্ত্রী থেকে ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী, এমনকি স্বয়ং রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। সংবাদসেবী মহলে হঠাৎ করেই ঝোড়ো হাওয়া, তেমনি ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়ও। সমাজ-সংস্কৃতি থেকে শাসনযন্ত্রের কপালে একটা বড় কালো চিহ্ন আঁকা হয়ে গেল অবক্ষয়, লজ্জা ও ব্যর্থতার।
নিশ্চিত করে বলা যাবে না, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীতে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠা এ ঢেউ কয়দিন তর্জন-গর্জন করবে? তবে অতীত ঘটনাবলির পরিণাম থেকে অনুমান করা যায়, কিছুদিনের মধ্যেই সবকিছু স্তব্ধ হয়ে যাবে। বিষয়টি নিয়ে আইন ও নিয়মকানুন তাদের রীতিনীতি অনুযায়ী চলতে চলতে এক সময় স্থবির হয়ে মুখ থুবড়ে পড়বে। আনুষ্ঠানিক বিচার, সাজা কবে হবে, কখন হবে, কতটা হবে- কেউ জানে না। আর এসব দেখে উদ্যোগী পুরুষ সিংহরা নতুন উৎসাহে তাদের কালো থাবা চালানোর অপচেষ্টায় আবার ব্যস্ত হয়ে উঠবে। উপমহাদেশের ছবিটা এ রকমই।
এমন ভাবার কারণ নেই যে এসব অপরাধ সংঘটনে বাংলাদেশ ধোয়া তুলসীপাতা, তার ভাবমূর্তি খুব পরিচ্ছন্ন। বরং প্রতিদিন কাগজের পাতায় হরেক রকম নারী নির্যাতনের খবর প্রকাশিত হতে দেখা যায়। শিশুকন্যা, কিশোরী-তরুণী বা গৃহবধূ- কেউই এ সামাজিক পাশবিকতা থেকে নিস্তার পায় না। বিশেষ করে পরিবেশ যখন এসব অপরাধের অনুকূল হয়ে ওঠে। প্রতিদিনের কাগজ থেকে খবরগুলো তুলে এনে সাজিয়ে দেখলে সমাজের বীভৎস চেহারাটা কালো অন্ধকারের মতো ফুটে উঠবে।
এই তো কয়েক দিন আগে ঢাকার দক্ষিণখানে ব্র্যাক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কর্মরত চিকিৎসক সাজিয়া আরেফিন তাঁর কর্মক্ষেত্রেই তাঁদের নিরাপত্তারক্ষীর হাতে খুন হন। খুনের নেপথ্য কারণ ওই নিরাপত্তারক্ষীর যৌন লালসা পূরণে তাঁর আপত্তি বা বাধা। নিরাপত্তার কী চমৎকার ব্যবস্থা! একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে, তাও আবার ব্র্যাকের মতো একটি স্বনামখ্যাত প্রতিষ্ঠান, যেখানে কর্মরত নারীর জীবনের নিরাপত্তা নেই। জানি না এই ভয়ংকর ঘটনার আইনি ব্যবস্থাদি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে।
কারণ ইতিপূর্বে নারী নির্যাতনের কিছু ঘটনার পরিণাম দেখে এমন সন্দেহই মনে দানা বাঁধে। একটি দৈনিকের খবরে প্রকাশ, সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের এক ভাইস চেয়ারম্যান স্কুলছাত্রীকে বার-কয় ধর্ষণ ও তিন-তিনবার অপহরণের চেষ্টার পরও তিনি বহাল তবিয়তে। পুলিশের ভাষ্য, তিনি পলাতক। সমাজে প্রবল প্রতাপশালী ও বিত্তবানদের অপরাধ করেও সহজে বিচার ও সাজার মুখোমুখি হতে হয় না। সেখানে অর্থের জোর, সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তি কাজ করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্থানীয় শক্তিগুলো ওই বিশেষ হিসাবেই চলে। তা ছাড়া দল এবং রাজনীতিও সেখানে তার প্রভাব রাখে।
এক কথায়, স্বাধীন বাংলাদেশের সমাজটা দূষিতই শুধু নয়, অন্যায়-অনাচারের পুঁজ-রক্তে মাখামাখি হয়ে বীভৎস রূপ ধারণ করেছে। সুস্থ মূল্যবোধহীন সমাজ নানা মাত্রায় দূষিত ও ব্যাধিত-সংক্রমিত। বেশ কিছুদিন ধরে আমরা লক্ষ করছি, স্কুলছাত্রী বা অছাত্রী কিশোরীদের ওপর বিত্তবান পরিবারের নষ্ট হয়ে যাওয়া বা মাদকাসক্ত সন্তানদের হামলা এবং পরিণামে ওই নির্যাতিতদের মৃত্যু বা লজ্জায়-অপমানে ওই সব কিশোরীর আত্মহনন, যা প্রায়ই কাগজে মুখরোচক খবর হয়ে দাঁড়ায়। এসব ঘটনাকে 'ইভ টিজিং' সরস শিরোনামে উপাদেয় করে তোলা হয়। সমাজ এসব ঘটনা নিয়ে মাথা ঘামায় না। প্রচলিত আইনি ব্যবস্থা এদের জন্য যথেষ্ট নয়।
এসব নিয়ে লেখালেখি কম হয়নি গত কয়েক দশকে, এখনো হচ্ছে। কিন্তু সমাজ ও শাসনযন্ত্র খুব একটা নড়েচড়ে বসছে না। স্বভাবতই ঘটনা ঘটেই চলছে। এত সংগঠন, এত রাজনৈতিক দল- তবু সমাজের এত বড় একটি ক্ষত সারানোর বা এই সামাজিক পাপ নিরসনে কোনো ধরনের উদ্যোগ কেউ নিচ্ছে না, নিতে দেখা যাচ্ছে না। অথচ সমাজ বদলের কত চমকপ্রদ স্লোগান আমরা শুনতে পাই।
ভারতীয় উপমহাদেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্র পাকিস্তানের সামাজিক অবস্থা এ দিক থেকে ভিন্ন কিছু নয়। শুধু ধর্মান্ধতা, ফতোয়াবাজি বা সামাজিক মূল্যবোধের ঘাটতিই এর একমাত্র কারণ নয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা সেখানে অনেক শক্তিশালী। আর উপজাতীয় অঞ্চল বা তালেবান শাসিত এলাকা হলে তো কথাই নেই। সে ক্ষেত্রে পুরুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছাই প্রথম ও শেষ কথা। গত কয়েক দশকে আফগানিস্তান ও সংলগ্ন অঞ্চলের তালেবানি শাসন বা স্থানীয় রক্ষণশীল শাসন তা দেখিয়ে দিয়েছে।
তাদের চোখে নারী ভোগের সামগ্রী। পুরুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার খেলার পুতুল। সেই সঙ্গে তার দ্বিতীয় পরিচয় পূর্বোক্ত সূত্রে তাদের সন্তানের জন্মদাত্রী এবং ঘর-সংসার যথাযথভাবে দেখভাল করে রাখার দায়িত্বে নিয়োজিত সর্বক্ষণের শ্রমকর্মী। এ কাজে তার লেখাপড়ার তো কোনো প্রয়োজন পড়ে না। তাই সোয়াতের মালালা ইউসুফজাই কেন স্কুলে যাবে পড়ালেখা করতে? কোনো দরকার নেই। অবাধ্য হলে গুলি খেয়ে মরতে হবে।
(দুই)
ছয় দশক পেরিয়ে গেছে, ভারতীয় উপমহাদেশ বিদেশি শাসন থেকে মুক্তি পেয়েছে। চার দশক হয়ে গেল পাকিস্তানি কব্জা থেকে পূর্ব বঙ্গের মুক্তি 'বাংলাদেশ' নাম নিয়ে। এ তিন রাষ্ট্র একুশ শতকের আধুনিক যুগে প্রবেশ করেছে। এগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি খুব একটা খারাপ নয়। তার চেয়েও বড় কথা, আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও শিক্ষার স্পর্শ লেগেছে সমাজে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সমাজে মানবিক ও আধুনিক মূল্যবোধের কতটা বিকাশ ঘটেছে, সে হিসাব নিতে গেলে আমাদের অনেক জবাবদিহির মুখে পড়তে হয়।
কে জবাব দিতে পারবে, দিনদুপুরে রাজধানী দিল্লির রাজপথে চলন্ত বাসে কিছু মনুষ্য নামধারীর পিশাচ-নৃত্য কিভাবে সম্ভব? তুলনীয় এমন আরো কিছু ঘটনা প্রমাণ করে, আধুনিকতার পালকধারী সমাজের এতটুকু স্বাস্থ্য বদল ঘটেনি। এর পচন, এর ক্ষত বেড়েই চলেছে। তার চেয়েও বড় কথা, সে সম্বন্ধে সমাজের এলিট শ্রেণীর অসচেতনতা ও অবহেলা। কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতি অমনোযোগ। সমাজ বদল তো দুরঅস্ত- সময়োপযোগী আইন প্রণয়নের কোনো ইচ্ছা তাদের নেই, যাতে নারীর জন্য নূ্যনতম সামাজিক নিরাপত্তা, ব্যক্তিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়।
অন্যের অন্দরমহল ছেড়ে নিজ সমাজের দিকে তাকালে মাথা হেঁট হতে বাধ্য। কয়েক দিন আগে একটি কাগজে নারী নির্যাতনের কিছু ধারাবাহিক ঘটনা প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে দেখা গেছে, ঘরে-বাইরে নারী কিভাবে নির্যাতনের শিকার হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপরাধী শাস্তির বাইরে থেকে যাচ্ছে। তাতে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাফিলতি ও দুর্নীতি। অন্যদিকে বিত্তের প্রভাব ও আইনি দুর্বলতা। অনেক সময় নির্যাতিতাই লাঞ্ছনার শিকার। এর কারণ যেমন সামাজিক রক্ষণশীলতা, গ্রামীণ ফতোয়াবাজি, তেমনি সামাজিক দায়দায়িত্বের অভাব। সমাজে আধুনিক চেতনার অভাব। কথাটা প্রায়ই শুনি সমাজসেবী জামিল আখতার বীনু প্রমুখের কণ্ঠে। ভাবতে পারা যায়- গত চার বছরে যৌন নির্যাতনের শিকার প্রায় তিন হাজার নারী ও শিশু! নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছে ৫০০ জনকে। একই কারণে আত্মহত্যার সংখ্যাও কম নয়। এ বছর ধর্ষণের ঘটনা প্রায় এক হাজার- এ হিসাব মানবাধিকার সংগঠনের। কিন্তু পুলিশের হিসাবে এ সংখ্যা বর্তমান (২০১২) বছরে প্রায় তিন হাজার। এর মধ্যে আদিবাসী নারীর সংখ্যাও কম নয়। এসব পরিসংখ্যান দেখে কেউ হয়তো আঁতকে উঠে বলে বসবেন, 'আমরা কি জঙ্গলে বাস করছি? না, জঙ্গলে নয়, আমরা সভ্য শিক্ষিত-অশিক্ষিত মানব সমাজেই বাস করছি। তাই এসব ঘটছে সভ্যতা ও শিক্ষা সত্ত্বেও। জঙ্গলে পশুদের মধ্যে এসব ঘটে না। আমরা সভ্য, সংস্কৃতিবান মানুষ কি তাহলে পশুর চেয়ে অধম?
হয়তো তা-ই। আর সে জন্যই দিনের পর দিন বর্বর ঘটনাগুলো নির্বিবাদে ঘটতে পারছে। আমরাও দিব্যি হাত-পা গুটিয়ে বসে আছি। কত ছোটখাটো ঘটনার প্রতিবাদে আমরা পথে নেমে পড়ি। আন্দোলনে সবকিছু অচল করে দিতে পারি এবং দিইও। কিন্তু এ ব্যাপারে আজ পর্যন্ত কোনো লাগাতার আন্দোলন হয়েছে কি? দাবি উঠেছে কি অপরাধীর কঠোর শাস্তির জন্য আইন প্রণয়নের? না, হয়নি। এটা রাজনীতিকদের জন্যও কোনো ইস্যু নয়। কারণ এতে করে দলের কোনো স্বার্থ অর্জিত হবে না। বছরে কয়েক হাজার করে নারী নির্যাতিত হলে কী আসে যায়। সমাজের নিয়ন্ত্রণ পুরুষের হাতেই থাকছে এবং থাকবে।
তাই আহ্বান জানাই নারী শক্তির প্রতি- জেগে উঠুন, প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তুলুন। প্রায় ১০০ বছর আগে রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন জেগে ওঠার যে আহ্বান জানিয়েছিলেন, সেই বলিষ্ঠ আহ্বান নতুন করে নারী সমাজে আলোড়ন তৈরি করুক বলিষ্ঠ প্রতিবাদে। অবশ্যই এ যাত্রায় সঙ্গী হবে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, মানবিক বোধে ঋদ্ধ পুরুষ সমাজ, যারা ভাবে নারী-পুরুষের সমন্বিত যাত্রায়ই সমাজের অগ্রগতি।
আনুষ্ঠানিক মহিলা সমিতি নয়, লক্ষ্য অর্জনে অর্থাৎ আত্মমর্যাদা ও অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার মতো সাহসী সংঘই পারে নারী সমাজের প্রতি আক্রমণ প্রতিহত করতে। ঢাকায় একদা দীপালি সংঘসহ বেশ কয়েকটি বিপ্লবী নারী সমিতি গড়ে উঠেছিল, আজ সেগুলোর পুনরুজ্জীবন দরকার। আত্মশক্তির বিকাশ ও বলিষ্ঠ প্রকাশ না ঘটাতে পারলে দানবশক্তির হাত থেকে নারীর মুক্তি নেই। হোক তা ভারতে, পাকিস্তানে বা বাংলাদেশে।
লেখক : কবি, গবেষক ও কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.