বিমান ৭ ঘণ্টা অচল মন্ত্রীর আশ্বাসে ধর্মঘট প্রত্যাহার by আজাদ সুলায়মান

 সাত ঘণ্টা বিমান অচল থাকার পর মন্ত্রীর আশ্বাসে ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু ততক্ষণে সর্বনাশ যা হয়েছে-তা টের পেল গোটা এভিয়েশন ওয়ার্ল্ড। মঙ্গলবার সকালে ডাকা নজিরবিহীন এ ধর্মঘটে শাহ্জালাল বিমানবন্দর একেবারেই অচল হয়ে পড়ে।
এতে চট্টগ্রামের হজরত শাহ আমানত ও সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দরও ছিল অচল। হাজার হাজার যাত্রী বিমানবন্দরে চরম দুর্ভোগের শিকার হয়। দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে দেশে ফিরে আরও কয়েক ঘণ্টা ফ্লাইটের ভেতরেই অবরুদ্ধ থাকায় অসুস্থ হয়ে পড়ে অনেক শিশু ও বয়োবৃদ্ধ যাত্রী। একপর্যায়ে যাত্রীরা কাস্টমস হলে ভাংচুর চালায়। বিক্ষুব্ধ এক যাত্রী তাঁর অসুস্থ শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে মন্ত্রীর সামনেই চিৎকার করে বলতে থাকেন, আমার এ ক্ষতির জন্য আপনারা সবাই দায়ী। কেন আপনারা আমাদের এত বিপদে ফেলেছেন।
দুপুরে বিমানমন্ত্রী ফারুক খান ও স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবীর নানক আনুষ্ঠানিকভাবে আন্দোলনরত বিমানকর্মীদের সঙ্গে যৌথভাবে কর্মসূচী প্রতাহারের ঘোষণা দিলেও রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বিমানবন্দরে ছিল যাত্রীদের জট। বিমানকর্মীদের এসব দাবি নিয়ে রাতে জরুরী ভিত্তিতে ডাকা বোর্ডসভায় বেশ গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হয় এবং দাবিগুলো ১৫ দিনের মধ্যে বাস্তবায়নের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। সিবিএ নেতা মশিকুর রহমান জনকণ্ঠকে সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, আর যদি দাবি মানা নিয়ে কর্তৃপক্ষ কোন প্রহসন করে, তাহলে ফের ডাকা হবে আরও কঠোর ধর্মঘট।
সাত দফা দাবিতে মঙ্গলবার ভোর ৬টা থেকে লাগাতার ধর্মঘট ডাকে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের শ্রমিক-কর্মচারীরা। এতে শিডিউলে থাকা এমন ১৮টি ফ্লাইট আটকে যায়। ঠিক অবতরণের ক্ষেত্রেও ১২ উড়োজাহাজ লাগেজসহ অন্যান্য পণ্য নামাতে ব্যর্থ হয়। উড্ডয়নগামী উড়োজাহাজের শত শত যাত্রীকে বিমানের ভেতরেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয়। ঠিক তেমনি বিমানবন্দর টার্মিনালেও হাজার হাজার যাত্রী ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকতে বাধ্য হন। দুপুর দেড়টার দিকে যখন বিমান চলাচল শুরু হয় তখন দেশের প্রধান বিমানবন্দরে ভয়াবহ বিমানজট লেগে যায়। একের পর এক উড়োজাহাজ ছাড়তে গিয়ে বেকায়দায় পড়ে বিমান কর্তৃপক্ষ ও বিমানবন্দরের অভিভাবক বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। শিডিউল ফ্লাইটের বিমান ছাড়াও আটকে থাকা ১৮ ফ্লাইট একযোগে বিমানবন্দর ছাড়তে গিয়ে জট লেগে যায়। রাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বিমানবন্দরে উড়োজাহাজের জট খোলেনি। বিমানের এক পরিচালক বলেন, সাত ঘণ্টায় আটকে থাকা কাজ কয়েক মিনিটে সমাধান করা সম্ভব নয়। জট ছাড়াতে প্রাণান্ত চেষ্টা করা হচ্ছে। রাতে বোর্ড মিটিং শেষ হওয়ার আগপর্যন্ত কর্মীরা রয়েছে সংশয়ে।
বিমানবন্দরের পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, শাহজালালে প্রতিদিন কমপক্ষে ৭০ বিমান ওঠানামা করে। সারাদিন ধরে এসব উড়োজাহাজ উড্ডয়ন ও অবতরণ করায় বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ সহজেই সবকিছু সামলাতে পারে। কিন্তু মঙ্গলবার গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ও যাত্রীসেবায় নিযুক্ত বিমানের ৭শ’ কর্মী কাজে যোগ না দেয়ায় বিমানবন্দরে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়। এমনিতেই বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং বিভাগে লোকবল খুবই অপর্যাপ্ত। এরপর যদি এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে সেই পরিস্থিতি মোকাবেলা করা কঠিন হয়ে যায়। তিনি বলেন, মূলত একযোগে ১৮ উড়োজাহাজ ছাড়া এবং সেই শিডিউলের অন্য ফ্লাইট ছাড়তে গিয়ে বিমানবন্দরে জট লেগে যায়। জট সামলাতে সন্ধ্যা লেগে যায়।
সকালে সরেজমিনে বিমানবন্দরে গিয়ে দেখা যায়, জেট এয়ার ও এয়ার ইন্ডিয়ার দুটি ফ্লাইট দিল্লী থেকে শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করে। কিন্তু এ দুটি ফ্লাইটের যাত্রীদের লাগেজ নামানো ও উড়োজাহাজ থেকে বাসে করে বিমানবন্দর টার্মিনালে আনা সম্ভব হয়নি। এ কারণে যাত্রীরা চরম দুর্ভোগে পড়েন। এর পর পরই শাহ্জালালে এমিরেটস, কাতার, গালফ, ইতিহাদসহ দেশী-বিদেশী এয়ারলাইন্স অবতরণ করতে থাকে। বিমানের ট্রান্সপোর্ট বিভাগও কাজ না করায় এ সময় শত শত যাত্রী উড়োজাহাজের ভেতরে বসে থাকতে বাধ্য হন। দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে যাত্রীরা যখন জাহাজের ভেতরেই অবরুদ্ধ ছিলেন তখন তাদের বলা হয় বিমানবন্দরে চলছে ধর্মঘট। কতক্ষণ চলবে বলা মুশকিল। এ সময় রানওয়ে ঘুরতে দেখা যায় সৌদিয়া এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজ। আর গালফ এয়ারের একটি ফ্লাইট অবতরণ করার পর রানওয়েতেই যাত্রীদের অফলোড করা হয়। পরে তারা লাগেজ রেখে হেঁটে চলে আসেন বিমানবন্দরের ভেতরে।
বেলা সাড়ে দশটায় বিমানবন্দরে পৌঁছেন মন্ত্রী ফারুক খান। তিনি প্রথমে ভিআইপি লাউঞ্জে বসে পরিস্থিতি সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। তিনিও প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেননি ধর্মঘটীরা এত সহজেই বিপর্যয় ডেকে আনতে সক্ষম হবে। অবস্থা আঁচ করতে পেরে ফারুক খান ছুটে যান অভ্যন্তরীণ টার্মিনালের ভিআইপি লাউঞ্জে। সেখানে ডাকা হয় আন্দোলনের প্রধান নেতা সিবিএ সভাপতি ও বিমান শ্রমিকলীগ নেতা মশিকুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক মন্তাছার রহমানকে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রণালয়ের সচিব খোরশেদ আলম, এমডি মোসাদ্দিক আহমেদ সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মাহমুদ হোসেন, পরিচালক স্কোয়াড্রন লিডার মাজহারুল হক, পরিচালক শাহনেওয়াজ, পরিচালক রজপতি সরকার ও পরিচালক আসাদুজ্জামান। অনেকটা রুদ্ধদ্বার বৈঠকের মতোই আলোচনার শুরুর পরই সেখানে হাজির হন স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবীর নানক।
জাহাঙ্গীর কবীর নানক আনুষ্ঠানিকভাবে মশিকুরের কাছে জানতে চান দাবিগুলো সম্পর্কে। মশিকুর জানান, তার বিরুদ্ধে দায়ের করা দুটি বিভাগীয় মামলা ও একটি পুলিশী মামলা প্রত্যাহার, আহার ভাতা, পোশাক ভাতা ও এয়ারলাইন্সের অর্গানোগ্রাম বাস্তবায়নসহ সাত দফা দাবিতে শ্রমিক-কর্মচারীরা এ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন। তারা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার জন্য বার বার আকুতি-মিনতি করার পরও তাতে সাড়া মেলেনি। ফলে তাদের বাধ্য হয়েই ধর্মঘট ডাকতে হয়েছে। সোমবার ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসাদ্দেক আহমেদকে এয়ারলাইন্সের প্রধান কার্যালয় বলাকায় প্রায় ১২ ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখার পরও তারা আলোচনার ন্যূনতম সাড়া দেননি। উপরন্তু চরম অবহেলা করা হয়েছে।
মশিকুরের বক্তব্য শোনার পর জাহাঙ্গীর কবীর নানক এমডির দিকে তাকিয়ে অনেকটা ক্ষোভের সঙ্গেই বলতে থাকেন, এসব দাবি তো যৌক্তিক। কেন আপনারা এতটা অবহেলা করছেন। আপনারা কি এদের মানুষ মনে করেন না? এদের সঙ্গে আলোচনা করেই তো এ সমস্যার সমাধান করা যেত।
নানকের কথা শুনে মাথা নিচু করে মৌনতা থাকেন এমডি মোসাদ্দিক আহমেদ। অন্যান্য পরিচালকও তখন মাথা নিচু করে তাদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন।
এতে নানক আবার বলতে থাকেন, আপনারা কেন তুচ্ছ কারণে ছেলেদের ধর্মঘটের দিকে ঠেলে দিলেন। বিমান পরিচালকরা কেউ কথা বলার সাহস না পাওয়ায় মন্ত্রী ফারুক খান তাদের পক্ষে উত্তর দেন তাদের করার কিছু নেই। তাদের ক্ষমতাও নেই। বোর্ড যদি না করে তাহলে ম্যানেজমেন্ট করবে কী?
এ সময় নানক আরও ক্ষুব্ধ হয়ে বলতে থাকেন, বোর্ড কেন এদের ব্যাপারে এত উদাসীন? কেন বার বার এসব আন্দোলন? বোর্ড কি জবাবদিহিতার উর্ধে? বোর্ডে যারা আছে তারা কারা? তাদের ব্যাপারে খোঁজ নিতে হবে।
তিনি তখন উপস্থিত গোয়েন্দাদের উদ্দেশে বলতে থাকেন, আপনারা কি এ বোর্ড সম্পর্কে প্রকৃত খবর প্রধানমন্ত্রীকে দেন না? বোর্ডে কারা আছেন তারা কি বিএনপি না জামায়াতপন্থী তা খতিয়ে দেখতে হবে।
এরপর বিমানমন্ত্রী ফারুক খান বলেন, রাতেই জরুরী বোর্ডসভায় এসব দাবি নিয়ে আলোচনা হবে। এবার অবশ্যই এসব দাবি মানার ব্যবস্থা করা হবে।
এরপর দু’মন্ত্রীই মশিকুরকে ধর্মঘট প্রত্যাহার করে কাজে যোগদান করার নির্দেশ দেন।
কিন্তু আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত ধর্মঘট চলবে বলে উত্তর দেন মশিকুর। তারপর ফারুক খানও কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠেন, দুজন মন্ত্রী আশ্বাস দেয়ার পরও তোমাদের বিশ্বাস হচ্ছে না কেন।
তখন মশিকুর বেশ বিনীত স্বরে জবাব দেন-এর আগেও আপনার আশ্বাসে কর্মসূচী প্রত্যাহার করেছিলাম। বার বার এসব দাবি নিয়ে আপনাদের কাছে গিয়েছি। সচিবের কাছে গিয়েছি। কিন্তু তারপর বোর্ড আপনাদের কাউকে সম্মান করেনি। কাজেই এবার লিখিত দিতে হবে।
প্রায় দু’ঘণ্টা আলোচনার পর উপরের তলায় দুই মন্ত্রী ও দুই সিবিএ নেতার সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে দশ মিনিটের আলোচনায় তাঁরা একটা মীমাংসায় উপনীত হন। সাত দফা দাবি মানার অঙ্গীকার তাৎক্ষণিক একটি সাদা কাগজে লিখে এমডি মোসাদ্দিক তাতে স্বাক্ষর করেন। সেটা নিয়ে তাঁরা সবাই বাইরে আন্দোলনরত বিমান কর্মীদের সামনে যান। সেখানে উভয়পক্ষই সর্বসম্মতি ক্রমে দাবি মানার ঘোষণা দেয়। তারপরই ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলে কাজে যোগ দেন সবাই। এরপর মশিকুর ও মন্তাছারকে নিয়ে দুই মন্ত্রী সাংবাদিকদের সামনে সংক্ষিপ্ত প্রেস ব্রিফিংয়ে দাবি মানার প্রেক্ষিতে ধর্মঘট প্রত্যাহারের কথা জানান।
এ সময় মন্ত্রীদ্বয় ধর্মঘটের দরুন যাত্রীদের যে ক্ষতি ও ভোগান্তি হয়েছে তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। তবে রাতভর শ্রমিকরা কাজ করে তা পুষিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হবে বলেও জানান ফারুক খান।
এ সময় বিমানমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে আমরা একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি। তাদের কিছু দাবি মঙ্গলবার অনুমোদনের জন্য বোর্ডসভায় উত্থাপন করা হবে। বাকি দাবিগুলো পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.