পদ্মা সেতু ॥ গোল্ডস্টেইন অর্থায়নে আশাবাদী- চলতি মাসেই বিশেষজ্ঞ প্যানেল প্রতিবেদন by হামিদ-উজ-জামান মামুন

পদ্মা সেতু নিয়ে এখন শুধুই অপেক্ষার পালা। সরকার এবং বিশ্বব্যাংক উভয় পক্ষই তাকিয়ে আছে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রতিবেদনের দিকে। এটি পাওয়ার পরই জানা যাবে দেশের সর্ববৃহৎ এ প্রকল্পের ভাগ্যে কি আছে।
তবে এই অপেক্ষার মধ্যে আশার কথা শোনালেন বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর এ্যালেন গোল্ডস্টেইন। তিনি বলেছেন, আশা করছি চলতি মাসেই প্রতিবেদন পাওয়া যাবে। বিশ্বব্যাংক এ প্রকল্পে অর্থায়ন করবে- এ ব্যাপারে আমি খুবই আশাবাদী। মঙ্গলবার গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট লার্নিং নেটওয়ার্ক শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক কর্মশালার উদ্বোধন শেষে তিনি সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ অফিসের একটি সূত্র জনকণ্ঠকে জানিয়েছে, শিঘ্রই প্রাথমিক প্রতিবেদন দেবে বিশেষজ্ঞ প্যানেল। প্রতিবেদন পেতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সংস্থাটি। ওই প্রতিবেদনে কি থাকবে অথবা সেটি বাংলাদেশের পক্ষে যাবে নাকি বিপক্ষে সে বিষয়ে এখনও কিছুই জানা সম্ভব হয়নি। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব আবুল কালাম আজাদ জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা অপেক্ষা করছি। এখন পর্যন্ত আমরা জানতে পারিনি কবে নাগাদ প্রাথমিক প্রতিবেদন পাওয়া যাবে। আশা করছি তাদের পর্যবেক্ষণ ভাল হবে। কেননা সরকার এখন পর্যন্ত অনেকগুলো ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। দুদক নিরপেক্ষভাবে কাজ করছে।
এ্যালেন গোল্ডস্টেইন বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে এরই মধ্যে অন্যান্য সহযোগীর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। এটি একটি প্রক্রিয়াগত ব্যাপার। শুধু ইয়েস নো বলার বিষয় নয়। বিশ্বব্যাংক যে এই প্রকল্পে অর্থায়ন করবে- এ ব্যাপারে আমি খুবই আশাবাদী। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির বিষয়ে দুদকের মামলার যে নথি পাঠানো হয়েছে তা এখন পর্যালোচনা করছে বিশেষজ্ঞ প্যানেল। প্যানেলের প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে বিষয়টির সমাধানের বিষয়ে একটা জায়গায় পৌঁছা যাবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিশ্বের অনেক দেশেই বছরের এ সময়টাতে ছুটি থাকে বলে এ কাজে একটু সময় লাগছে।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের এক মাসের ছুটি শেষে কাজে যোগদান নিয়ে আবারও ধূম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে। সোমবার পরিকল্পনা কমিশনে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পের এ্যানিমেশন ও পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ড. মসিউর রহমান। ফলে তিনি ছুটি শেষে আবারও অফিস শুরু করলেন কিনা তা নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। ছুটি শেষে আপনি কাজে যোগদান করছেন কিনা? ড. মসিউর রহমানকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংককে জিজ্ঞেস করুন। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকতো আমার মাথা অবশ করে দেয়নি, সবসময় আমার মাথা কাজ করে, তাই আমি কাজ করে যাচ্ছি। আপনারাই (সাংবাদিকরা) বলেছেন, বিশ্বব্যাংক বলেছে তুমি কাজ কর না। আমি এখন আপনাদের অনুরোধ করছি কাগজে লিখে দেন যেসব কাগজ আগে আমার বিরুদ্ধে লিখেছে তারা ভুল করেছে, বিশ্বব্যাংকও ভুল করেছে, এখন তাঁকে (মসিউর) দেশের সেবা করা থেকে দূরে রাখা ঠিক হবে না।
বিশ্বব্যাংকের শর্ত মেনে ছুটিতে যাওয়ার পর গত ১ নবেম্বর থেকে পুনরায় ড. মসিউর রহমান কাজে যোগ দিয়েছেন, এ খবরে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। এ প্রেক্ষিতে ৩ নবেম্বর তিনি বলেছিলেন, ‘আমি ছুটি শেষ করে কাজে যোগ দিয়েছি। কাল (৪ নবেম্বর) দুর্নীতি দমন কমিশনে যাব। দেশে ফিরে প্রধানমন্ত্রী যে সিদ্ধান্ত নিতে বলবেন সেই মোতাবেক কাজ করব।’ কিন্তু ওই সময় তাঁর কাজে যোগ দেয়ায় বিষয়টি মসিউর ছাড়া সরকারের দায়িত্বশীল অন্য কেউ স্বীকার করেননি।
তাঁকে আবারও ছুটিতে পাঠানো হয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম। কিন্তু কত দিনের ছুটিতে পাঠানো হয়েছে সে বিষয়টি স্পষ্ট করেননি তিনি। ওই সময় জানা গিয়েছিল তাঁকে এক মাসের ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। সে মেয়াদ শেষ হয়েছে ডিসেম্বরের ৩১ তারিখে। তারপর তাঁকে আবারও ছুটিতে পাঠানো হবে কিনা সে বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত নেয়নি সরকার।
দুর্র্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান জানান, বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দলের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে, চিঠি আদান- প্রদান হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পরই দায়ীদের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তারা তাদের বক্তব্য সময় মতো জানাবে। মঙ্গলবার অনানুষ্ঠানিক ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, আমরা স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও পূর্ণাঙ্গ অনুসন্ধান প্রতিবেদন করেছি। তার ভিত্তিতে এজাহার বিশেষজ্ঞ দলকে পাঠানো হয়েছে। প্যানেলের ভিত্তিতে বক্তব্য দেবে। কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে বলেও জানান গোলাম রহমান। কানাডিয়ান নাগরিক তিন আসামির বিষয়ে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের পরই পদ্মা সেতু মামলার তিন আসামি রমেশ সাহ, ইসমাইল ও কেভিন ওয়ালেসের বিষয়ে আইনী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে পদ্মা সেতুর তদন্ত নিয়ে আগ বাড়িয়ে কিছু বলা যাবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি। এটা স্পর্শকাতর বিষয়। বিশ্বব্যাংককে আমরা যে এজাহার পাঠিয়েছি তার বিপরীতে বিশ্বব্যাংকে রিপোর্ট পাঠানোর কথা রয়েছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) একটি সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রাথমিক প্রতিবেদন কি হবে তা নিয়ে পুরোপুরি শঙ্কামুক্ত নয় ইআরডি। কেননা বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ মতে প্রধান আসামি সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের নাম বাদ দেয়া হয়েছে। এ কারণে তদন্তের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে কিছুটা প্রশ্ন তোলার সুযোগ রয়েছে। প্রতিবেদন পেতে বিশ্বব্যাংকে তদবির করতে অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ওয়াশিংটন যাচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে ইআরডির ওই সূত্রটি জানিয়েছে, এ ধরনের কোন পদক্ষেপ সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হচ্ছে না। কেননা তা করা হলে ইআরডির মাধ্যমে করা হতো। সরকার এখন শুধু প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষাই করছে।
দীর্ঘদিন ছুটি শেষে বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর এ্যালেন গোল্ডস্টেইন রবিবার ঢাকায় কাজে যোগ দিয়েছেন। ওই দিন বিকেলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে অনির্ধারিত এক বৈঠকে মিলিত হন। এ সময় ইআরডির অতিরিক্ত সচিব আরস্তু খান উপস্থিত ছিলেন। এ বৈঠকে পদ্মা সেতুর বিষয়ে কোন কথা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে আবুল কালাম আজাদ জনকণ্ঠকে বলেন, ছুটি শেষে কাজে যোগদানের পরই তিনি রুটিনওয়ার্ক হিসেবে ইআরডিতে আসেন। পদ্মা সেতুর বিষয়ে তেমন কোন অগ্রগতি জানাতে পারেননি তিনি। তারাও অপেক্ষা করছেন প্রতিবেদনের জন্য।
এর আগে ডিসেম্বর মাসে সর্বশেষ বিবৃতিতে বাংলাদেশে নিযুক্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর এ্যালেন গোল্ডস্টেইন বলেছিলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলার নথি পর্যবেক্ষণ করে বিশেষজ্ঞ প্যানেল প্রতিবেদন দেবে। তারপরই অর্থায়নের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। পদ্মা সেতুতে কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে মামলা করার পরদিন বিবৃতি দেয় বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিস। বিবিৃতিতে এ্যালেন গোল্ডস্টেইন বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে বিশেষজ্ঞ প্যানেল। দুর্নীতি দমন কমিশনের করা মামলার ফার্স্ট ইনফরমেশন রিপোর্ট (এফআইআর) পর্যালোচনার পর প্যানেল একটি প্রতিবেদন দেবে। পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের বিষয়টি প্যানেলের ওই প্রতিবেদনের ওপরই নির্ভর করবে।
সূত্র জানায়, লুইস গ্যাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পোর নেতৃত্বে গত ১ ডিসেম্বর দ্বিতীয়বার ঢাকা সফরে আসে বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক প্যানেল। ৩ ডিসেম্বর ও ৫ ডিসেম্বর দুদকের সঙ্গে বৈঠক করে প্যানেলের সদস্যরা। তিন দফা বৈঠক শেষে আবুল হোসেনকে মামলার আসামি করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে একমত হতে পারেনি দুই পক্ষ।
এ প্রেক্ষিতে ৫ ডিসেম্বর বৈঠক শুরুর মাত্র ৪০ মিনিট পর বৈঠক থেকে বের হয়ে যান বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্যসহ বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা। পরে বিশেষজ্ঞ প্যানেল রাজধানীর মিন্টো রোডে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বাসায় যায়। সেখানে বৈঠক শেষে সন্ধ্যা পৌনে সাতটায় বিশেষজ্ঞ প্যানেল পুনরায় দুদকে ফিরে আসে। অর্থমন্ত্রীর বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তারা সাংবাদিকদের এড়িয়ে যান। এদিন দ্বিতীয় দফায় অল্প সময়ের জন্য দুদকে বৈঠক শেষ করে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেল। বেরিয়ে যাওয়ার সময় ওকাম্পো বলেন, খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। এখন আমরা চলে যাচ্ছি। এই প্যানেলের ঢাকা ত্যাগ করার ৩৪ দিন পেরিয়ে গেলেও এখনও কোন প্রতিবেদন দেয়া হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.