বিদেশে পলাতক ছয় খুনী অবস্থান পাল্টাচ্ছে বার বার

সোহেল রহমান মৃতু্যভয়ে ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছে পলাতক ছয় খুনী। ফাঁসির দড়ি থেকে বাঁচার কৌশল হিসাবে বিদেশের মাটিতে বার বার অবস্থান পরিবর্তন করছে ধূর্ত খুনীর দল। মৃতু্যদ- কার্যকরের পর গণ মানুষের ধিক্কারে বিব্রত অবস্থায় রয়েছে খুনীর আত্মীয়স্বজনরা।
শোক তো দূরের কথা নিজেদের দুভের্াগের জন্য উল্টো ঘাতকদের দায়ী করছে তাদের পরিবারের সদস্যরা। তাদের আশঙ্কা খুনীদের ফাঁসি হলেও তাদের মুক্তি নেই। ঘাতকদের পাপের ফল হিসেবে জাতির এই ঘৃণা তাদের বয়ে বেড়াতে হবে সারাজীবন। সূত্র জানায়, বিদেশে পলাতক ছয় খুনীর মধ্যে কানাডায় আশ্রয় নেয়া খুনী নুর চৌধুরী দেশে ফেরত আনার পথে অনেক দূর এগিয়েছে সরকার। স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি চেয়ে করা তার আবেদন ইতোমধ্যে তিনবার বাতিল করে দিয়েছে সরকার। অবৈধভাবে বসবাসের অভিযোগে গত ডিসেম্বরে তাঁর পাসপোর্ট বাতিল করে অটোয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসে জমা দিয়েছে সেখানকার আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনী। বর্তমানে তার পাসপোর্ট বাংলাদেশ মিশনের জিম্মায় রয়েছে। নুর চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গত ডিসেম্বর মাসে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ কানাডা সফর করেন। সেখানে বাংলাদেশের হাইকমিশনার ইয়াকুব আলী সর্বণিক বিষয়টি তদারকি করছেন বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে। সূত্র জানায়, কানাডার প্রচলিত আইন অনুযায়ী খুনী নুর চৌধুরী তার স্থায়ী বসবাসের আবেদন খারিজের বিরম্নদ্ধে শেষবারের মতো আরেকটি আপীল করতে পারবেন। এই আপীলটি বাতিল হলেই তাকে কানাডা থেকে বহিষ্কার করে বাংলাদেশের হাতে তুলে দেয়া হবে। সূত্র জানায়, কানাডা থেকে নুর চৌধুরীকে বহিষ্কার করা হলেও তাকে ফিরিয়ে আনতে বন্দিবিনিময় চূক্তির কোন প্রয়োজন হবে না। নিয়ম অনুযায়ী তাকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দেয়া হবে। এর আগে একই কায়দায় মৃতুদ- কার্যকর হওয়া খুনী একেএম মহিউদ্দিনকেও যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত আনা হয়েছিল। সূত্র জানায়, একের পর এক আবেদন খারিজ ও পাঁচ খুনীর মৃতু্যদ- কার্যকরের পর আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে নুর চৌধুরী। দ- থেকে বাঁচতে নানা কৌশল অবলম্বন করছে। ঘনিষ্ঠজনদের মাধ্যমে নিজের অবস্থান সম্পর্কে বিভ্রানত্মি ছড়াচ্ছে। এর আগে তার লন্ডনে অবস্থানের বিষয়টিও এই কৌশলের অংশ হিসেবে ফলাও করে প্রচার করা হয়।
সূত্র জানায়, বর্তমান সরকার মতা গ্রহণের পর বিদেশে পলাতক খুনীদের গ্রেফতারে ইন্টারপোলের মাধ্যমে পুনরায় গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করা হয়। এর আগে বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের আমলে ইন্টারপোলের গ্রেফতারী পরোয়ানা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।
শরিফুল হক ডালিম কখনও পাকিসত্মান আবার কখনও হংকংয়ে অবস্থান করছে। এই খুনী বর্তমানে পাকিসত্মানের পাসপোর্ট ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করছে। তবে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় সে পাকিসত্মানী স্থায়ী বসতি গড়ে তুলেছেন বলে জানা গেছে। আব্দুল মাজেদ চৌধুরী ও রিসালদার মোসলেহউদ্দিন ভারতে অবস্থান করছে। দুই খুনীকে গ্রেফতারের জন্য পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ কয়েকবার অভিযান চালিয়েও ব্যর্থ হয়। মাজেদ কখনও থাইল্যান্ডে অবস্থান করে বলে জানা গেছে। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সন্ত্রাসী ও সাজাপ্রাপ্ত অপরাধী বিনিময় চুক্তি স্বারিত হয়েছে। এই দুই খুনী ভারতে অবস্থান করলে তাদের ফিরিয়ে আনা অনেকটাই সহজ হবে বলে সূত্র জানিয়েছে। অন্যতম খুনী আব্দুর রশিদ লিবিয়া ও বেলজিয়ামে অবস্থান করছে। তবে পাকিসত্মান ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে তার অবাধ যাতায়াত রয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের প্রায় পুরোটা সময় সে পাকিসত্মানে ছিল বলে জানা গেছে। এমনকি ঘৃণিত এই খুনী সে সময় বাংলাদেশে আসে বলেও প্রচার মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। সূত্র জানিয়েছে, লিবিয়ায় অবস্থানেকালে রশিদ মাদক ও অস্ত্র চোলাচালান ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। সিসিলি দ্বীপের মাফিয়া ডনদের আসত্মানায়ও তার অবাধ যাতায়াত রয়েছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার মতা গ্রহণের পর দেশ থেকে পালিয়ে যায় এই খুনী। এর আগে একই বছরের ১৫ ফেব্রম্নয়ারি অনুষ্ঠিত কলঙ্কিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাকে বিজয়ী করে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার আসনে বসায় তৎকালীন বিএনপি সরকার। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর খুনীদের খোঁজে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত টাস্কফোর্সের সদস্যরা রশিদকে ধরতে লিবিয়া যায়। পথে মাল্টায় টাস্কফোর্সের দুই সদস্য রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান ও এনএসআই এর তৎকালীন প্রধান মশিউর রহমানকে হত্যার জন্য খুনী ভাড়া করে ঘাতক রশিদ। খুনীদের একজন আজিজ পাশা পলাতক অবস্থায় ২০০১ সালে জিম্বাবুইয়েতে মারা যায়। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার তাকে চাকরি থেকে বরখাসত্ম করলেও ২০০২ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার তার চাকরিকালীন সকল সুযোগ সুবিধা পুনর্বহাল করে।
জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে থাকা নুর চৌধুরী সেখানকার আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর নজরদারিতে রয়েছে। গত জুলাই মাসে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার মৃতু্যদ-প্রাপ্ত পলাতক আসামি রাশেদ চৌধুরীর ব্যাপারে ইন্টারপোলের মাধ্যমে বাংলাদেশকে তথ্য জানায় যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে উলেস্নখ করা হয়, ওয়াশিংটনে অবস্থানকারী রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী বসবাসের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছে। তার ব্যাপারে বাংলাদেশের অবস্থান জানানোর অনুরোধ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধের জবাবে রাশেদ চৌধুরীর অবস্থান নির্ণয় এবং তাকে গ্রেফতারের অনুরোধ করা হয়। পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প থেকে যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সার্ভিসের কাছেও একই বার্তা পাঠানো হয়। রাশেদ চৌধুরী এখনও যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছে কিনা সে ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের কাছে নিশ্চিত কোন তথ্য নেই। তবে যুক্তরাষ্ট্রে কোন খুনী অবস্থান করলে তাকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দিতে সরকারের উর্ধতন পর্যায় থেকে সেদেশের সরকারের কাছে কয়েকবার অনুরোধ করা হয়েছে। খুনীদের রায় কার্যকর করার উদ্যোগ গ্রহণের পর রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্র থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে বলে জানা গেছে।

দুভের্াগের জন্য খুনীদের দায়ী করছে আত্মীয়স্বজন
বুধবার রাতে মৃতুদ- কার্যকর হওয়া পাঁচ খুনীর আত্মীয়স্বজনও অনুশোচনায় তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের অনেকেই খুনীদের দাফন কাজেও অংশ নেয়নি। পথে পথে খুনীদের বহনকারী কফিনে মানুষের জুতা নিপে আর ধিক্কার অনুশোচনার আগুন জ্বালিয়েছে তাদের মনেও। ল্যান্সার একেএম মহিউদ্দিনের দাফন কাজে অংশ নেয়নি তার স্ত্রী, পুত্র, ভাই কিংবা পরিবারের কোন সদস্য। পরিবারের সদস্যরা ঢাকায় থাকলেও তারা কেউই দাফন কাজে অংশ নিতে গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীতে যায়নি। চাচাত ভাই শহিদুল ইসলাম এই ঘাতকের লাশ গ্রহণ করে দাফন করে। এর আগে ঢাকা থেকে পটুয়াখালী পর্যনত্ম যাত্রাপথে কফিনে জুতা নিপে করে মানুষ খুনীর প্রতি ঘৃণার বহির্প্রকাশ ঘটায়। এমনকি ুব্ধ নিজ গ্রামের মানুষও তাদের গ্রামে খুনীর লাশ দাফন করতে চায়নি। শেষ পর্যনত্ম প্রাশাসনের হসত্মেেপ অনেকটা গোপনে দাফন কাজ সম্পন্ন করা হয়। খুনী সৈয়দ ফারম্নক রহমানের লাশ দাফন করতে তার মা ও এক বোন ছাড়া পরিবারের কোন সদস্য অংশ নেয়নি। তার স্ত্রী ও পুত্র-কন্যারা বিদেশ থাকলেও ফাঁসির আগে একটি বারের জন্যও জেলখানায় তারা তাকে দেখতে আসেনি। শোক দূরের কথা নিজেদের দুভের্াগের জন্য ঘাতক আর্টিলারি মহিউদ্দিনকে দোষারোপ করছে তার পরিবারের সদস্যরা। এর আগে ১৫ আগস্টের কালরাতে নিহত শেখ ফজলুল হক মনির পুত্র ব্যারিস্টার ফজলে নুর তাপসের ওপর বোমা হামলার দায়ে মহিউদ্দিনের দুই পুত্র বর্তমানে কারাগারে আটক রয়েছে। তার জানাজা ও দাফনে স্ত্রী ও নিকটাত্মীয়দের কেউ অংশ নেয়নি বলে জানা গেছে।

No comments

Powered by Blogger.