নির্জন, মাতাল হাওয়া স্বচ্ছ পানির নিচে সুচালো প্রবাল- ছেঁড়া দ্বীপ_ পর্যটনের আরেক আকর্ষণ

 বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। আর সেন্টমার্টিন থেকে ট্রলারে মাত্র আধা ঘণ্টা দূরত্বে ছেঁড়া দ্বীপ। একে গল্প কথার দ্বীপ বললেও বেশি বলা হবে না।
সেন্টমার্টিনের মতো এটিও নীল সমুদ্রবেষ্টিত প্রবাল দ্বীপ। তবে তফাতটা হলো দ্বীপে বেড়াতে যাওয়া বলতে গল্পে বা কল্পনায় যে ধরনের নির্জন, জনমানব শূন্য, পাগলা বাতাস, সৈকতে গড়ে ওঠা বিশেষ ধরনের গাছ আর নীল জলের চিত্র ফুটে ওঠে, এটা ঠিক তাই। পর্যটকদের জন্য এক ধরনের আনন্দ মিশ্রিত বিস্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেড় কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ছোট্ট ছেঁড়া দ্বীপ। সেন্টমার্টিনভিত্তিক পর্যটনের বিকাশ ঘটছে এ দ্বীপেও। সেন্টমার্টিন গেলে এ দ্বীপটিতে যেতে কেউ ভুল করেন না। আর কেউ ভুলটি করতে গেলেও এলাকাবাসী উপযাজক হয়ে পর্যটকদের এ সুন্দর স্থানের কথা মনে করিয়ে দেন। এলাকাবাসীর মতে, সেন্টমার্টিন ও ছেঁড়া দ্বীপকে আলাদা করার কোন উপায় নেই। সেন্টমার্টিনের উন্নয়ন, পরিকল্পিত পর্যটন শিল্প বিকাশ ছাড়া ছেঁড়া দ্বীপকে দেশ ও বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা কঠিন। সেন্টমার্টিন জেটিতে সারি সারি ট্রলার বাঁধা থাকে ভাড়ার জন্য। সাধারণত পর্যটকরাই ছেঁড়া দ্বীপে যাওয়ার জন্য ট্রলার ভাড়া করেন। জেটি থেকে রওনা দিয়ে আধা ঘণ্টার মধ্যেই পেঁৗছানো যায় স্বপ্নের ছেঁড়া দ্বীপে। তবে রোমাঞ্চপ্রিয় কেউ সমুদ্রে আরও সময় নিয়ে বৃত্তাকারভাবে দ্বীপটি ঘুরতে চাইলে সময় লাগবে দুই ঘণ্টা। এতে আসা-যাওয়াসহ ট্রলার রিজার্ভ করলে ভাড়াও পড়বে তিনগুণ বেশি। দুই হাজার টাকা। স্বচ্ছ পানির নিচে প্রবালের কারণে কখনও কখনও তীরে ভিড়তে পারে না ট্রলার। অল্প খানিকটা জায়গা পার হতে হয় ডিঙ্গি নৌকায় চড়ে। তবে ঘন প্রবালের কারণে খালি পায়ে তীরে নামা যায় না। সুচালো প্রবালে খালি পায়ে আঘাত লাগে। এ নিয়ে পর্যটকরা রসিকতা করে বলেন, তীরের এই প্রবাল শুধু সৌন্দর্য বাড়াচ্ছে না, পর্যটক নিয়ন্ত্রণও করছে। ছেঁড়া দ্বীপের যে নৈসর্গিক সৌন্দর্য তা এক ঝটকায় সামাল দিতে পারবেন না অনেকে। তীরে নেমেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে দৌড় শুরম্ন করতে পারেন। তেমন পরিস্থিতি না ঘটিয়ে পর্যটকদের আত্মস্থ হতে সময় দেয় তীরের প্রবাল।
প্রবাল পেরিয়ে কিছুটা হাঁটলেই সমতল ভূমি। সমুদ্র সৈকত যেমন হয়, তেমন। এর পর কোথাও প্রবাল, কোথাও সৈকত, কোথাও প্রবাল সত্মূপ হয়ে জলের কাছে ব-অৰরের আকার ধারণ করে অপরূপ দৃশ্য তৈরি করেছে। এক কোনায় দাঁড়ালে দেড় কিলোমিটারের জনমানব শূন্য দ্বীপটি একবারেই চোখে সাঁটা যায়। নীল আকাশ, নীল জলের সঙ্গে টিয়া রঙের গাছ-প্রকৃতির সৌন্দর্য ভা-ারের সবটুকুই যেন উজাড় করে দেয়া হয়েছে ছেঁড়া দ্বীপকে। মন উদাস করা পাগলা বাতাস সমুদ্রের গর্জনের সঙ্গে মিলেমিশে এক মোহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করে। এলাকাবাসীর মতে, সেন্টমার্টিনের একটি ৰুদ্র সংস্করণ বলা যেতে পারে ছেঁড়া দ্বীপকে। বরং প্রকৃতির যেসব সৌন্দর্য সেন্টমার্টিনে নেই, তাও আছে ছেঁড়া দ্বীপে। এত সুন্দর দ্বীপে কেন বসতি নেই? ছেঁড়া দ্বীপে দাঁড়িয়ে এ প্রশ্নটি ঘুরপাক খায় সব পর্যটকের মনে। এর জবাব হলো একমাত্র খাওয়ার পানি না থাকায় সেখানে কোন বসতি গড়ে ওঠেনি। দ্বীপে সুপেয় পানির সত্মর নেই। চারপাশে অথৈ পানি থাকলেও মানুষের খাওয়ার উপযোগী পানি নেই। যত গভীরেই খোঁড়া হোক না কেন উঠে আসে শুধু নোনা জল। তবে নবেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যনত্ম এ পাঁচ মাস পর্যটকদের জন্য অস্থায়ীভাবে হাতেগোনা ভ্রাম্যমাণ হকারের দেখা মেলে। এরা সবাই সেন্টমার্টিনের বাসিন্দা। উপার্জনের জন্য খাওয়ার পানি হাঁড়ি বা বোতলে ভরে সঙ্গে নিয়ে এসে ছেঁড়া দ্বীপে ওঠেন। তেমনই এক হকার মধ্য বয়সী আব্দুর রহমান। শুধু ডাব বিক্রি করেন তিনি। জনকণ্ঠকে জানালেন, প্রতিদিন সকালে আসেন। চলে যান সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গেই। টাকা বাঁচাতে ট্রলারে না উঠে বিকল্প পথে আসা-যাওয়া করেন। বললেন, এক ঘণ্টা হেঁটে অল্প কিছুটা পথ ডিঙি নৌকায় করে চলে যান সেন্টমার্টিনে। এলাকাবাসী হওয়ায় নৌকার ভাড়া দিতে হয় না।
তবে আব্দুর রহমানের চেয়ে ব্যবসার দিক দিয়ে আরও একটু এগিয়ে আল হোসাইন আলী। তিনি ছন আর বেড়া দিয়ে পাশাপাশি দুটো ঘর করে রেখেছেন। খোলা ঘরটিতে রেখেছেন ডাব, পানি, কোমল পানীয়, বিস্কুটসহ শুকনো খাবার। অপর ঘরটি পর্যটকদের বিশ্রামের জন্য। মেঝেতে সারি করে কয়েকটি বিছানা পেতে রেখেছেন। সে ঘরের নাম দিয়েছেন 'বার্ব-ই-কিউ।' ভাড়া নেন কত জিজ্ঞেস করতেই এক গাল হেসে বললেন, 'খুশি হইয়া যে যা দেয়।' জানালেন, পানির অভাবে এক নাগারে বেশিদিন থাকতে পারেন না। তিনি বা তার স্ত্রী পর্যটন মৌসুমে দু'-একদিন পর পর সেন্টমার্টিনে গিয়ে খাবার পানি নিয়ে আসেন। হোসাইন আলী প্রচারের প্রয়োজনে পর্যটকদের কাছে তাঁর ভুলেভরা ভিজিটিং কার্ডটি ধরিয়ে দিতে কখনও ভুল করেন না। হকারদের মধ্যে দু'জনকে দেখা গেছে বড় চিংড়ি ও কাঁকড়া নিয়ে বসে থাকতে। জিইয়ে রাখেন। পর্যটকরা চাওয়া মাত্র ভেজে খাওয়ান। তবে দর কষাকষি না করলে ঠকতে হয়। একেকটি চিংড়ির দাম হাঁকা হয় ৪শ' টাকা।

No comments

Powered by Blogger.