সুরমা নদীতে হাঁটুজল by সাব্বির আহমদ

যে সুরমায় একদিন ছিল উত্তাল ঢেউ ও খরস্রোত সেই সুরমার দুই ধারে এখন বিস্তীর্ণ তীর। জেগেছে বালুর চর। নদীর সে গভীরতাও নেই, এখন সেখানে হাঁটুজল আর নেই সেই খরস্রোতও।
তবে এটি বাংলাদেশের দীর্ঘতম নদী বলে পরিচিত স্রোতস্বিনী সুরমার শুকনো মৌসুমের চিত্র। কারণ, শুকনো মৌসুম এলেই এ সুরমা তার স্রোত হারায়, নদীর বুক চিরে বের হয় বালুচর।
বরাক নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে সুরমা নদী এদেশে ঢুকে মোট ৬৬৯ কিলোমিটার ভ্রমণ করেছে। সিলেট শহর থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে আমলশীদে সীমান্ত। ভারতের আসাম থেকে বরাক ডানদিকে ইংরেজি বর্ণ ইউ এর মতো বাঁক নিয়ে নাম ধরেছে সুরমা। সোজা পশ্চিম দিকে চলে যাওয়া প্রবাহটি কুশিয়ারা। সুরমা নদী সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মেঘনায় মিশেছে।

নদীর উৎসমুখ সিলেটের জকিগঞ্জের আমলশীদেও এখন বালুর চরে ভরাট হয়ে গেছে।

জকিগঞ্জ সীমান্তের সুরমা নদী এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পানি প্রবাহ বন্ধ হওয়ায় বাংলাদেশের দীর্ঘতম নদী ও এক সময়ের প্রমত্তা সুরমায় জেগেছে অর্ধশতাধিক চর। সংকুচিত হয়ে আসছে কুশিয়ারা নদীও।

আমলশীদে বালির বাঁধের কারণে পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে মৃত অবস্থায় সুরমা পড়ে থাকার বিষয়টি শুক্রবার বাংলানিউজকে নিশ্চিত করেছেন সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ। এ কারণে অসংখ্য চর জেগে নদী শুকিয়ে গেছে। নদীখননের একটি পরিকল্পনা রয়েছে, তবে সুরমা নদীর সিলেট অংশে খনন প্রক্রিয়া এখনও শুরু হয়নি বলে জানান তিনি।

তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ বাংলানিউজকে বলেন, বরাক-সুরমা-কুশিয়ারার তিন নদীর মোহনায় এখন বিশাল বালির বাঁধ পড়েছে। সরু খালের মতো জায়গা দিয়ে কিছুটা পানি পাচ্ছে কুশিয়ারা আর বালির বাঁধ একেবারে বন্ধ করে দিয়েছে সুরমার পানি প্রবাহ।

তিন নদীর মোহনার কাছাকাছি বাড়ি ষাটোর্ধ্ব আব্দুস সালামের। তিনি জানালেন, তার জীবোদ্দশায় এই প্রথম বালির বাঁধে সুরমার পানি প্রবাহ বন্ধ হওয়ার দৃশ্য দেখলেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বরাক নদী দিয়ে ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পলিমাটি ও ক্রমাগত নদী ভাঙ্গনের ফলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

ফলে বরাকের পানি বালির বাঁধ টপকে সুরমায় মিশতে না পেরে ইউ অংশের মধ্যে আটকে আছে। যে কারণে জকিগঞ্জের আমলশীদে থেকে কানাইঘাট উপজেলার লোভাছড়া পর্যন্ত সুরমা নদীর ৩২ কিলোমিটার এলাকায় ৩২টিরও বেশি চর জেগেছে।

ওই সব স্থানে নৌকা ছাড়াই হেঁটে পার হচ্ছেন লোকজন। একদিকে নদী ভাঙ্গন, অন্যদিকে জেগে ওঠা চর নিয়ে দুশ্চিন্তায় দুই তীরের হাজারো মানুষ। তাদের জীবন ও জীবিকার অন্যতম উৎস নদী।  নৌ-পথ বন্ধ হয়ে পড়ায় বিড়ম্বনার শিকার তারাও।

জানা গেছে, ভারত বরাকের বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি ছোট বাঁধের মাধ্যমে পানি প্রবাহে বিঘ্ন সৃষ্টি করার ফলে এমনটি হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে সুরমা-কুশিয়ারার বিস্তৃত এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হতে পারে। পানির তীব্র সংকটে এ অঞ্চলে বড় ধরনের বিপর্যয়ও নেমে আসতে পারে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, উজানে পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত সুরমা নদীর পানি প্রবাহ গত এক যুগে ৮৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।

জানা গেছে, ২০০৬ সালের ৬ অক্টোবর জকিগঞ্জে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) মতামতের ভিত্তিতে সীমান্তবর্তী সুরমা-কুশিয়ারা নদীর সার্ভে ও মডেল স্টাডির ড্রেজিং করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পাশাপশি বরাকের ভারত অংশে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করার কথা ছিল।

এরই অংশ হিসেবে প্রাথমিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে কুশিয়ারা নদীতে পাইলট প্রকল্পের ড্রেজিং কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু সুরমা নদীতে এখনও খনন কাজ শুরু হয়নি।

পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সুরমা নদীতে এখন ড্রেজিং করা ছাড়া উপায় নেই। এ বিষয়ে জয়েন্ট রিভার কমিশনে বেশ কিছু বৈঠক হলেও কার্যকরী উদ্যোগ পিছিয়ে পড়েছে।

No comments

Powered by Blogger.