ইসলামী সন্ত্রাসের আরেক স্বর্গরাজ্য সোমালিয়া অনুবাদ : by এনামুল হক

সোমালিয়া আজ ইসলামী সন্ত্রাসের আরেক স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। সেখানে শাবাব নামে এক ইসলামী গেরিলা বাহিনী মার্কিন সমর্থনপুষ্ট অন্তর্বর্তীকালীন সোমালী সরকারকে উৎখাতের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
এরা শত্রম্নর শিরশ্ছেদ, চোরের হাত কেটে ফেলা ও ভ্যাবিচারিণীকে পাথর ছুড়ে মারার মতো মধ্যযুগীয় নিষ্ঠুরতার জন্য পরিচিত। আল কায়েদার সহায়তায় এরা সোমালিয়াকে সারা বিশ্বের জিহাদীদের অধিকতর পছন্দের গন্তব্যে রূপানত্মরিত করতে সম হয়েছে। বলাবাহুল্য এই জিহাদীদের মধ্যে কিছু সংখ্যক আমেরিকান মুসলমানও রয়েছে। তাদের একজন ওমর হাম্মামি আলাবামায় জন্ম নিয়ে বেড়ে ওঠার পর আজ এই সোমালিয়ায় বিশ্বের সবচেয়ে নির্মম চরিত্রের ইসলামী জঙ্গী আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে।
আফ্রিকা শৃঙ্গে অবস্থিত বুমেরাং আকৃতির দেশ সোমালিয়া কিভাবে ইসলামী সন্ত্রাসের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হলো এবং কি করেই বা আমেরিকান মুসলমানরা তাতে অংশ নিতে পারল সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে সোমালিয়ার সাম্প্রতিক ইতিহাস নিয়ে দু'কথা বলে নেয়া ভাল।
১৯৯১ সাল থেকে গৃহযুদ্ধের আগুনে জ্বলছে সোমালিয়া। এর পাশাপাশি চলছে খরা ও দুর্ভিরে ধ্বংসলীলা। গৃহযুদ্ধ, খরা ও দুর্ভিরে হাত থেকে যেটুকু রা পেযেছিল সেটাও আবার লুট করে নিয়েছে যুদ্ধবাজ ও জলদসু্যরা। এমন অবস্থার মধ্যে জোরেশোরে উত্থান ঘটেছে ইসলামী জঙ্গীদের। আর এভাবেই নৈরাজ্য ও অরাজকতায় সোমালিয়া আজ বিশ্বের অন্যতম ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।
প্রায় আড়াই লাখ বর্গমাইলের দেশ সোমালিয়া। এর অধিকাংশ এলাকাই বিশুষ্ক। অধিবাসীরা তাদের সীমিত সম্পদ পানি ও চারণ ভূমির ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে সেই প্রাচীনকাল থেকে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। পাঁচটি প্রধান কান এই জনগোষ্ঠীকে একত্রে বেঁধে রেখেছে। কানগুলো আবার নানান শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত। জনসংখ্যার সিংহভাগ মুসলমান। কানভিত্তিক ভারসাম্যের ব্যবস্থা সমাজদেহটিকে অতিমাত্রায় নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল, কখনও নৈরাজ্য সৃষ্টি হতে দেয়নি।
ইউরোপীয়দের আগমনের পর সেই কানভিত্তিক ভারসাম্যের ব্যবস্থাটি ধসে পড়তে শুরম্ন করে। ব্রিটিশরা দেশটির উত্তরাংশে অপোকৃত নমনীয় হাতে এবং ইতালীয়রা দণিাংশে কঠোর হাতে শাসন করতে থাকে। ইতালীয়রা রাজধানী মোগাদিসুর যথেষ্ট শ্রীবৃদ্ধি ঘটালেও কান ব্যবস্থার রাজনীতিকরণ ঘটায়। বিরোধ নিষ্পত্তির স্থানীয় যেসব ব্যবস্থা ছিল তাদের হসত্মেেপ সেগুলো নিদারম্নণ তিগ্রসত্ম হয়।
১৯৬০ সালে ঔপনিবেশিক শক্তি চলে যায়। সোমালী জনগণকে জাতীয়তাবাদী চেতনা গ্রাস করে নেয়। এক ঐক্যবদ্ধ দেশে পরিণত হবার ল্যে উত্তর ও দণিাংশ অর্থাৎ সোমালিল্যান্ড ও সোমালিয়া একটি কনফেডারেশনভুক্ত হয়। কিন্তু ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো কান ব্যবস্থা বিভাজনের যে ব্যবস্থা করেছিল তার ফলে অচিরে জাতীয়তাবাদের ল্যও নস্যাত হয়ে যায়। মতার েেত্র এক ধরনের শূন্যতা সৃষ্টি হয়। সেই শূন্যতা পূরণে ১৯৬৯ সালে এগিয়ে আসেন একনায়ক জেনারেল মোহাম্মদ সিয়াদ বারী। দারোদ কানের সদস্য জেনারেল বারী চাতুর্য ও নিষ্ঠুরতার সঙ্গে দেশ শাসন করলেও তার আমলে দেশে স্থিতিশীলতা ছিল। তিনি প্রকাশ্যে কানগুলোতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন, বষর্ীয়ানদের বিচারিক মতা কেড়ে নেন এবং উপজাতীয় ব্যবস্থার জায়গায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অগ্রসর হন। কিনত্মু আড়ালে আড়ালে তিনি বিভেদ করে শাসন করার নীতি চালিয়ে যান। এতে কানগুলোর মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। এর পাশাপাশি তিনি একবার রাশিয়া ও অন্যবার আমেরিকার সঙ্গে মাখামাখি করে সোমালিয়ার প্রধান ফসল হিসাবে অস্ত্রের বিশাল ভা-ার গড়ে তোলেন। ইথিওপিয়ার সঙ্গে অবিবেচনা প্রসূত যুদ্ধের কারণে সিয়াদ বারীর অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে। এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে হাবিয়ে কানের মিলিশিয়ারা ১৯৯১ সালে তাকে মোগাদিসু থেকে বিতাড়িত করে। তারপর থেকে সোমালিয়ায় যে অস্থিরতার যুগ শুরম্ন হয় তা এখনও চলছে। এই অস্থিরতার মধ্যে উত্তরের সোমালিল্যান্ড আলাদা হয়ে গেছে।
গৃহযুদ্ধ চলাকালে উগ্র ইসলামপন্থীরা ২০০৬ সালে সোমালিয়ার মতায় আসে। সাংগঠনিকভাবে ওটা ছিল ইসলামী আদালত ইউনিয়নের (আইসিইউ) সরকার। এটি আসলে শরিয়া আদালতগুলোর একটি জোট। সোমালিয়ার নিয়ন্ত্রণ দখলের জন্য এরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। মতায় আসার পর আইসিইউ সরকার ব্যাপক র্যাডিকেল পথ অবলম্বন করে এবং সোমালী খিলাফত প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা ঘোষণা দেয়। এই ঘোষণার পরিপ্রেেিত আমেরিকার সমর্থনে ইথিওপিয়া সে বছরের শেষ দিকে সোমালিয়া আক্রমণ করে ইসলামী সরকারকে হটিয়ে অনত্মর্বতর্ী ফেডারেল সরকারকে (টিএফজি) মতায় বসায়। এই সরকারের প্রতি জাতিসংঘসহ ব্যাপক আনত্মর্জাতিক মহলের সমর্থন আছে। মধ্যপন্থী ইসলামীদের নেতৃত্বাধীন এই সরকার বড়ই ভঙ্গুর। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ইথিওপীয় বাহিনী সোমালিয়া থেকে চলে গেলে সে দেশের পরিস্থিতি আরও জটিল ও অরাজক আকার ধারণ করে। সরকারের দুর্বলতার সুযোগে জঙ্গী ইসলামীরা এখন মতা দখলের হিংস্র লড়াইয়ে লিপ্ত।
এই অবস্থায় সোমালিয়া আজ সত্যিকার অর্থেই এক ব্যর্থ রাষ্ট্র। সেখানে সবকিছুই ধসে পড়েছে। উত্তরের পৃথক রাষ্ট্র সোমালিল্যান্ডে বহুলাংশে শানত্মি বিরাজ করলেও দেিণর সোমালিয়ায় গৃহযুদ্ধ। খরা ও দুর্ভি েআজ ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছে। ১০ লাখের বেশি লোক বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে রাজধানী মোগাদিসুর উপকণ্ঠে ত্রাণ শিবিরগুলিতে আশ্রয় নিয়েছে। মোগাদিসুরে জনসংখ্যা ২০০৭ সালের গোড়ার দিকে যা ছিল আজ তা অর্ধেকের বেশি হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে নগরীতে সাড়ে ৭ লাখ লোক রয়ে গেছে। এদের অনেকেই দরিদ্রের মধ্যে দরিদ্রতম। জনগোষ্ঠীর সিংহভাগের কাজ নেই, উপার্জন নেই, বাড়িঘর নেই। তারা স্রেফ মানবিক সাহায্যের ওপর নির্ভর করে আছে। মোগাদিসু এক সময় এক বর্ধিষ্ণু নগরী ছিল। ব্যাংক, গির্জা, বিলাসবহুল হোটেল, শপিং মলে লোক গমগম করত। আজ সেটা এক ধ্বংসনগরী। বিধ্বসত্ম দালানকোঠা কোনভাবে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে বিকেল পাঁচটার পর বাইরের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায়। গোটা রাজধানী তখন এক ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়। সন্ধ্যায় মোগাদিসুর রাসত্মায় কাউকে দেখা গেলে বুঝতে হবে সে দারম্নণ হঠকারিতায় আক্রানত্ম। নগরীর সর্ববৃহৎ হাসপাতাল মেদিনায় প্রতিদিন অসংখ্য আহত ব্যক্তির আগমন ঘটে, যাদের বেশিরভাগ ইসলামী সন্ত্রাসী হামলার শিকার।

আল শাবাব ও হিজবুল ইসলাম
সোমালিয়ায় ইসলামী সন্ত্রাসীরা মূলত দুটি সংগঠনের অনত্মর্গত। একটি আল শাবাব এবং অন্যটি হিজবুল ইসলাম। এই দুটি সংগঠন মধ্য ও দণিাঞ্চলের অধিকাংশ ভূখ- ইতোমধ্যে দখল করে নিয়েছে। এখন তাদের চাপ রাজধানীর ওপর। ২০০৯ সালের জুন মাস পর্যনত্ম মোগাদিসুর ১৮টি জেলার মধ্যে মাত্র ৭টি জেলা সরকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল।
আল শাবাব গোড়াতে ছিল ইসলামী আদালত ইউনিয়নের যুব মিলিশিয়া সংগঠন। এরা অনেক বেশি সহিংসপ্রবণ। আল কায়েদার সঙ্গে এদের যোগাযোগ আছে। আল শাবাবের ল্য হলো দেশটিকে পুনরম্নদ্ধার করা ও ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করা। আল শাবাব বেশিরভাগ অস্ত্রশস্ত্র সীমানত্মের ওপারে কেনিয়া থেকে কিনে নেয়। ইরিত্রিয়ার কাছ থেকেও তারা ভারি অস্ত্র ও গোলাবারম্নদ সংগ্রহ করে থাকে। তবে স্থলপথে এগুলো সংগ্রহ করা আগে সম্ভব ছিল না। দেিণর উপকূলীয় শহর কিসমায়ু শাবাব বাহিনী দখল করে নেয়ায় অস্ত্র সংগ্রহের পথ অনেক সুগম হয়েছে।
শাবাব শব্দের আরবী অর্থ যুব। আল কায়েদার সঙ্গে এদের যে শুধু যোগাযোগ আছে তাই নয়, আল কায়েদা জঙ্গীদের এরা আশ্রয়ও দিয়ে থাকে। তাদের জিহাদের আশু টার্গেট খ্রীস্টানপ্রধান দেশ ও দীর্ঘদিনের শত্রম্ন ইথিওপিয়া। শাবাবের জঙ্গীদের সিংহভাগ সোমালী।
(ক্রমশ)
সূত্র : নিউইয়র্ক টাইমস অনলাইন/ন্যাশনাল জিওগ্রাফি

No comments

Powered by Blogger.