তৃণমূল থেকে কেন্দ্র কোথাও কোন্দল এড়ানো যাচ্ছে না- বিএনপি সমাচার by রাসেল রানা

 বিএনপির তৃণমূলে দল গোছানো কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়েছে। দলের অভ্যনত্মরীণ কোন্দলের কারণেই এমনটি হয়েছে বলে মনে করেন দলের নেতা-কর্মীরা। তবে তৃণমূল নেতাকর্মীদের দাবি, দলে কতর্ৃত্ব ও প্রভাব বিসত্মারকে কেন্দ্র করে নীতিনির্ধারকদের কোন্দলই তৃণমূলে কোন্দল বাড়াচ্ছে।
একই কারণে জাতীয় কাউন্সিলের আগে কমিটি করতে না পারা জেলা-উপজেলায় গত আড়াই মাসেও নতুন কমিটি করা সম্ভব হয়নি। নীতি-নির্ধারকদের কোন্দলে অনেক সিনিয়র নেতাই দলীয় কার্যক্রমে নিষ্ক্রীয় হয়ে পড়ছেন। সক্রিয় হচ্ছেন শুধু হাওয়া ভবন সংশিস্নষ্ট নেতারা। আর হাওয়া ভবন সংশিস্নষ্ট নেতাদের উৎসাহেই তৃণমূলে কমিটি না করেই তারেক রহমানের উদ্যোগে ২০০৫ সালে অনুষ্ঠিত বিএনপির ইউনিয়ন প্রতিনিধি সম্মেলন পর্যালোচনার নামে সারাদেশের তারেক অনুসারীদের ঐক্যবদ্ধ করা হচ্ছে, চলছে শুধু তারেক বন্দনা।
দলীয় সূত্র জানায়, গত নির্বাচনে ভরাডুবির পর দল পুনর্গঠনের ঘোষণা দেয় বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। এরই অংশ হিসেবে গত ৯ জুন সারাদেশের ৭৫টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ৭১টি জেলার আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। ঢাকা মহানগর, ঢাকা জেলাসহ বাকি চারটি জেলার কমিটি ঘোষণা না করার কারণ হিসেবে দলের পৰ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দলীয় কোন্দলের কথা জানানো হয়। উপজেলা ও পৌরসভা কমিটি গঠনের দায়িত্ব দেয়া হয় জেলা আহ্বায়কদের। কিন্তু জেলা আহ্বায়ক কমিটি নিয়ে দলের মধ্যে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়লে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কমিটি করতে ব্যর্থ হয় জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। পরবর্তীতে কয়েকদফা সময় বাড়ানো হলেও দেশের অনেক জেলা-উপজেলা- পৌরসভার কমিটি গঠন করা সম্ভব হয়নি। এমনকি অনেক জেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি। পরে জাতীয় কাউন্সিলের তারিখ নির্ধারণ করে অনত্মত জাতীয় কাউন্সিলের আগে কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। কিন্তু কাউন্সিলের আগের দিন সারাদেশে দলের কমিটি গঠনের তথ্যাদি জানাতে ডাকা এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, দেশের ৬৭ ভাগ জেলা-উপজেলায় কাউন্সিল সম্পন্ন হয়েছে। জাতীয় কাউন্সিলের পর দ্রম্নত বাকি জেলা-উপজেলার কমিটি গঠন করা হবে। এমতাবস্থায় গত ৮ ডিসেম্বর দলের জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিলের পর প্রায় আড়াই মাস পার হয়ে গেলেও বাকি জেলা-উপজেলায় কমিটি ঘোষণা করা হয়নি। এমনকি ৯ জুন ঘোষণা না করা চার জেলায় আজ পর্যনত্ম কমিটি গঠন হয়নি। তৃণমূলে কোন্দল বাড়ছে। বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন, ঢাকায় ওয়ার্ড কমিশনার হত্যা এবং খালেদা জিয়ার প্রাণনাশের চেষ্টার প্রতিবাদে গত ১৮ ফেব্রম্নয়ারি দেশব্যাপী বিৰোভ সমাবেশের কর্মসূচীতে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় একাধিক গ্রম্নপকে পৃথক কর্মসূচী পালন করতে দেখা গেছে। অনেক জেলা-উপজেলায় কর্মসূচী পালনই হয়নি। এ ৰেত্রেও কারণ অভ্যনত্মরীণ কোন্দলই। একই কারণে এখনও স্থগিত হওয়া ২৩ জেলায় কমিটি হয়নি। জেলাগুলো হচ্ছে ঢাকা মহানগর, ঢাকা জেলা, মানিকগঞ্জ, বগুড়া, রংপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, বরগুনা, পটুয়াখালী, নড়াইল, সিলেট মহানগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বরিশাল মহানগর, বরিশাল দৰিণ জেলা, জামালপুর, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, গাজীপুর, রাজবাড়ী, মাদারীপুর ও নোয়াখালী। কমিটি না থাকায় এসব জেলায় দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রায় প্রতিদিনই দ্বন্দ্ব-সংঘাত হচ্ছে। একইভাবে দেশের বেশিরভাগ উপজেলা-পৌরসভায়ও পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই। তবে জেলা-উপজেলায় কোন্দলের দায়ভার নিতে নারাজ তৃণমূল নেতাকর্মীরা। তাঁদের মতে, দলের কতর্ৃত্ব ও প্রভাব বিসত্মারকে কেন্দ্র করে দলের নীতিনির্ধারকদের দ্বন্দ্বের কারণেই তৃণমূলে এ অবস্থা। দলের জাতীয় কাউন্সিলের দ্বিতীয় অধিবেশনেও তৃণমূল নেতাকর্মীরা এমন মতই চেয়ারপার্সনের কাছে তুলে ধরেন। ইতোমধ্যে বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে রাজধানীর ডেমরা এলাকার সাবেক এমপি দৌড় সালাউদ্দিনকে দল থেকে বহিষ্কার এবং দলের মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের দলীয় কার্যক্রম থেকে দূরে থাকার ঘটনায়। পাশাপাশি ঢাকা মহানগর কমিটি না থাকার পরও মহানগরের সাবেক সভাপতি সাদেক হোসেন খোকাকে অলিখিতভাবে দায়িত্ব পালন করতে বলা এবং এতে ৰুব্ধ হয়ে আরেক সাবেক সভাপতি মির্জা আব্বাসের অনুসারীদের মহানগরের গুরম্নত্বপূর্ণ কর্মসূচীতে অনুপস্থিত থাকাও দলীয় নীতি-নির্ধারকদের দ্বন্দ্বের বহিপর্্রকাশ বলেই মনে করেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে দলের মহাসচিবের দায়িত্ব দেয়ার পর থেকেই খোন্দকার দেলোয়ার গ্রম্নপিংয়ে জড়িয়ে পড়েন। দলে সংস্কারপন্থী বলে কিছু নেই_স্বয়ং খালেদা জিয়া এ ঘোষণা দেয়ার পরও এক পর্যায়ে গ্রম্নপিংকে 'সংস্কারপন্থী' আর 'খালেদাপন্থী' রং দেয়া হয়। সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়ে এই গ্রম্নপিং। এর জের ধরেই তৃণমূলে কোন্দলে বিপর্যসত্ম হয়ে পড়ে দলটি। যদিও দলের তৃণমূল নেতাকর্মীরা বার বার বলে আসছে, তৃণমূলে কোন সংস্কারপন্থী বা খালেদাপন্থী বলে কিছু নেই। সবাই খালেদাপন্থী। খালেদা জিয়াই দলের শক্তি ও ঐক্যের একমাত্র প্রতীক। তাদের অভিযোগ, দলের নীতিনির্ধারকরাই নিজেদের প্রয়োজনে এ কোন্দল সৃষ্টি এবং জিইয়ে রেখেছে। ঢাকা জেলা বিএনপির শীর্ষ একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, দীর্ঘদিন ধরে দেশের সবচেয়ে গুরম্নত্বপূর্ণ দু'টি ইউনিট ঢাকা মহানগর এবং ঢাকা জেলার কমিটি না থাকার দায়ভার কিছুতেই দলের নীতিনির্ধারকরা এড়াতে পারেন না। জাতীয় কাউন্সিলের আগেই সাদেক হোসেন খোকাকে সভাপতি করে ঢাকা মহানগর কমিটি চূড়ানত্ম হলেও আব্বাস অনুসারীদের বাধার মুখে তা ঘোষণা করা যায়নি। এ ৰেত্রে আব্বাসের পৰে সবচেয়ে জোরালো ভূমিকা পালন করেন খোন্দকার দেলোয়ার । খোন্দকার দেলোয়ার এ সময় চেয়ারপার্সনকে জানান, মহানগরের নেতৃত্ব নিয়ে যেহেতু কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়, সেহেতু জাতীয় কাউন্সিলে একজনকে গুরম্নত্বপূর্ণ পদে এনে অপরজনকে মহানগরের দায়িত্ব দিলে সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধান হবে। খালেদা জিয়াও মহাসচিবের যুক্তি মেনে নেন। ফলশ্রম্নতিতে জাতীয় কাউন্সিলে মির্জা আব্বাসকে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সদস্য পদে নিয়োগ দেয়া হয়। আর সাদেক হোসেন খোকাকে অপেৰাকৃত কম গুরম্নত্বপূর্ণ পদ ভাইস চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেয়া হয়। জাতীয় কাউন্সিলের পরই আলোচনায় চলে আসে মহানগর কমিটি। বিশেষ করে সরকারের বিরম্নদ্ধে বিভিন্ন কর্মসূচী পালনের ৰেত্রে মহানগর কমিটির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন দলের হাইকমান্ড। এ পর্যায়ে খোকাকে সভাপতি মানতে আবারও আপত্তি জানান দলের মহাসচিব ও আব্বাস অনুসারীরা। গত ২৭ জানুয়ারি মহানগর বিএনপির উদ্যোগে রাজধানীর মুক্তাঙ্গনে প্রতিবাদ সমাবেশ করার নির্দেশ দেন চেয়ারপার্সন। একই সঙ্গে তিনি আব্বাস অনুসারীদের এ সমাবেশে যোগ দিতে বলেন। কিনত্মু আব্বাস অনুসারীরা চেয়ারপার্সনের নির্দেশ অমান্য করে থানায় থানায় বিৰোভ মিছিলের পৃথক কর্মসুচী ঘোষণা করে। কর্মসূচীর আগের দিন বিষয়টি জানতে পেরে গভীর রাতে খালেদা জিয়া আব্বাস গ্রম্নপের নেতা দৌড় সালাউদ্দিনকে থানায় থানায় বিৰোভ মিছিলের কর্মসূচী বাতিল করে মুক্তাঙ্গনের সমাবেশে যোগ দেয়ার নির্দেশ দেন। এবারও চেয়ারপার্সনের নির্দেশ অমান্য করে আব্বাস অনুসারীরা। কর্মসূচীর দিন তারা মুক্তাঙ্গনের সমাবেশে যোগ না দিয়ে মহানগরের কয়েকটি থানায় বিৰোভ মিছিল করার চেষ্টা করে। এ তথ্য নিশ্চিত হয়ে পরের দিনই বিএনপি চেয়ারপার্সন দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে দৌড় সালাউদ্দিনকে দল থেকে বহিস্কার করে। এ নিয়ে দলের মহাসচিবের সঙ্গে চেয়ারপার্সনের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এই দূরত্ব থেকেই মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেন দলীয় কার্যক্রম থেকে দূরে সরে যান। প্রায় দুই সপ্তাহ বারডেম হাসপাতালে ভর্তি থেকে গত ৭ ফেব্রম্নয়ারি তিনি সিঙ্গাপুরে যান। খোকা-আব্বাস দ্বন্দ্বের পাশপাশি চেয়ারপার্সন- মহাসচিবের দ্বন্দ্বের বিষয় উলেস্নখ করে মহানগর বিএনপির এক নেতা জানান, দলের নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে দ্বন্দ্বের বিষয়টির সত্যতা প্রমাণে উলিস্নখিত ঘটনাগুলোই যথেষ্ট। এসব ঘটনা থেকেই স্পষ্ট হয় যে, প্রকাশ্যে কেউ মুখ না খুললেও ভেতরে ভেতরে নীতি-নির্ধারকদের দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছেছে।
দলীয় সূত্র আরও জানায়, নির্বাচনের পর থেকে তারেক অনুসারী নেতারা কিছুটা চুপচাপ থাকলেও জাতীয় কাউন্সিলে তারেক রহমান দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবার পরে তাঁরা নতুন উদ্দীপনায় দলকে নিয়ন্ত্রণে নিতে উঠেপড়ে লেগেছে। আর তারেককে ভাইস চেয়ারম্যান করার মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়াও তারেক অনুসারীদেরই উৎসাহিত করেছেন বলে দাবি করেছেন তারেক অনুসারীরা। তবে তারেক অনুসারী নেতারা, যাদের অধিকাংশই দুর্নীতিবাজ হিসেবে পরিচিত, দল তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার আভাস বুঝতে পেরেই দলের অনেক সিনিয়র নেতা রাজনীতি থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছেন। এমনকি জাতীয় কাউন্সিলের পর ঘোষিত স্থায়ী কমিটির উনিশ সদস্যের মধ্যে অনেকেই নিষ্ক্রীয় হয়ে পড়েছেন। এই নিষ্ক্রীয় নেতাদের দলের গুরম্নত্বপূর্ণ কর্মসূচীতেও অংশ নিতে দেখা যায় না। আবার কেউ কেউ হঠাৎ দু'একটি কর্মসূচীতে অংশ নেন। ভাইস চেয়ারম্যানদের মধ্যে অধিকাংশই কোন কর্মসূচীতে অংশ নেন না। সূত্র জানায়, সিনিয়র অনেক নেতা নিষ্ক্রীয় হয়ে পড়লেও তারেক অনুসারীরা অধিক সক্রিয় হচ্ছেন। ইতোমধ্যে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মির্জা ফখরম্নল ইসলাম আলমগীর বিদেশ সফরে গিয়ে দলের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তারেক রহমানের সঙ্গে আলোচনা করে এসেছেন। এছাড়া তারেক রহমানও বিদেশ থেকেই ফোনে তার অনুসারীদের দিক-নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। আর এ রকম নির্দেশনার আলোকেই তৃনমূলে কমিটি গঠনের প্রতি গুরম্নত্ব না দিয়ে তারেক রহমানের ইউনিয়ন প্রতিনিধি সম্মেলনের পর্যালোচনা করতে উদ্যোগী হয়েছে তারেক অনুসারীরা। এসব পর্যালোচনা সভা শুধু তারেক বন্দনা করার জন্যই আয়োজন করা হয়েছে বলে সূত্র দাবি করেছে। এসব বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্যের কাছে জানতে চাইলে তারা তারেকের বিষয়ে কথা বলাকে স্পর্শকাতর উলেস্নখ করে কথা বলতে রাজি হননি। তবে তাঁরা জানান, যে কোন রাজনৈতিক দলের ৰেত্রেই তৃণমূল নেতাকর্মীরা হলো প্রাণ। কাজেই তৃণমূলে দলকে না গুছিয়ে কোনভাবেই দলকে সংগঠিত ও শক্তিশালী করা সম্ভব নয়।

No comments

Powered by Blogger.