সহজ কথা- তুরস্ক-বাংলাদেশ সম্পর্ক by আলফাজ আনাম

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তুরস্ক এখন খুবই প্রভাবশালী দেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহে তুরস্কের এমন দৃশ্যমান ভূমিকা আর লক্ষ করা যায়নি।
ক্ষমতাসীন ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (একেপি) নেতৃত্বে ১২ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে তুরস্কের অর্থনীতি ও সামাজিক স্থিতিশীলতা যেমন সুদৃঢ় হয়েছে, তেমনি গতিশীল বিদেশনীতি দেশটিকে মর্যাদার আসনে বসিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী রজব তৈয়ব এরদোগানের নেতৃত্বে একে পার্টি  তৃতীয়বারের মতো দেশটি পরিচালনা করে আসছে। আরব গণজাগরণে তুরস্ক হয়ে উঠেছে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রোল মডেল। ফিলিস্তিন, লেবানন ও সর্বশেষ সিরিয়া ইস্যুতে দেশটি বেশ সোচ্চার ভূমিকা পালন করছে। মুসলিম বিশ্বের সাথে বিশেষ সম্পর্ক তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম মূলনীতি। ওআইসি মহাসচিব নির্বাচিত হয়েছেন তুরস্ক থেকে।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুলের একটি চিঠি এবং একটি তুর্কি প্রতিনিধিদলের সফরকে কেন্দ্র করে ঢাকা-আংকারা কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপড়েনের সৃষ্টি হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীরা প্রকাশ্যে তুরস্কের সমালোচনা করছেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে লেখা তুরস্কের প্রেসিডেন্টের চিঠিটি ১৭ ডিসেম্বর আঙ্কারা থেকে ঢাকায় পাঠানো হয়।

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী চিঠিতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট লিখেছেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অন্যদের সাথে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের বিচার চলছে। প্রায় ৯০ বছর বয়সী এই নেতা মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি বলে শোনা যাচ্ছে। তিনিসহ আরো বেশ কিছু বয়োজ্যেষ্ঠ ইসলামপন্থী নেতা বিচারের মুখোমুখি রয়েছেন, যা অত্যন্ত উদ্বেগের। চিঠিতে আরো বলা হয়েছে, যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়ার কারণে অর্থাৎ শীর্ষ ইসলামপন্থী নেতাদের শাস্তি দেয়া হলে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক আর্থসামাজিক অগ্রগতি ব্যাহত হতে পারে। এর ফলে সামাজিক অস্থিতিশীলতা ও রক্তপাতের আশঙ্কা রয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা আরো ুণœ হতে পারে। আবদুল্লাহ গুল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে ‘মা প্রদর্শন’ নীতি অনুসরণ ও গোলাম আযমসহ অন্য নেতাদের মৃত্যুদণ্ড রোধ করার বিষয়টি বিবেচনার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন।

এই চিঠি পাঠানোর পর গত ২০ ডিসেম্বর তুরস্কের আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত ১৪ সদস্যের একটি দল ঢাকা সফরে আসেন। এই প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী, আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, ডিফেন্স টিমের আইনজীবী, গোলাম আযমের বিপক্ষে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী ও মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতির সাথে সাক্ষাৎ করেন। প্রতিনিধিদলটি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন আমরা দেখতে এসেছি ট্রাইব্যুনালে ফেয়ার ট্রায়াল হচ্ছে কি না। আমরা দেখছি ট্রাইব্যুনাল আন্তর্জাতিক রুলস ও স্ট্যাটাস মেইনটেইন করছে কি না। আমরা তথ্য সংগ্রহ করছি। সংশ্লিষ্ট সব মহলের সাথে আলোচনার পর তুরস্ক সরকার ও আন্তর্জাতিক জুরিস্ট ইউনিয়নের কাছে আমরা এ বিষয়ে রিপোর্ট পেশ করব। প্রতিনিধিদল ঢাকা ছেড়ে যাবার পর সরকারের মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা তুরস্কের সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠেন। এর পরের দিন ঢাকায় তুরস্কের রাষ্ট্রদূত মেহমুত ভারকুল ইরকুলকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে সরকারের অসন্তুষ্টির কথা জানিয়ে দেয়া হয়। তুরস্কের এ তৎপরতাকে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ‘হস্তপে’ এমন মন্তব্যও করা হয়। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে  আংকারায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জুলফিকার রহমানকে তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়। তাকে তুরস্কের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন সে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ওমর অনহুন।

সরকারের আইনমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বারবার বলছেন, আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের বিচার আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী স্বচ্ছ ও রাজনৈতিক কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া হচ্ছে। যদি তা-ই হয়ে থাকে তাহলে বিচার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে আসা তুর্কি প্রতিনিধিদলের বিরুদ্ধে প্রচারণার উদ্দেশ্য কী? সরকার কেন বিদেশী প্রতিনিধিদল আসতে ভয় পাচ্ছে। আর্শ্চযজনক ব্যাপার হচ্ছে প্রতিনিধিদলের সাথে সরকারের একাধিক মন্ত্রী বৈঠক করেছেন, আবার তাদের ঢাকা আসার সমালোচনা করা হচ্ছে। আমরা এর আগে দেখেছি বিদেশী আইনজীবী আসার ক্ষেত্রেও অনুমতি না দিয়ে বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। সরকারের এ ধরনের আচরণে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠবেÑ যদি বিচারকার্যক্রম আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী হয়ে থাকে তাহলে বিদেশীদের আসতে বাধা কেন? বরং যত বেশি বিদেশীরা পর্যবেক্ষণে আসবেন, এই বিচারের গ্রহণযোগ্যতা তত বাড়বে। কিন্তু সরকার যখন বিচারকার্যক্রম আন্তর্জাতিক মহলের আড়ালে রাখতে চায়, তখন এই বিচার নিয়ে প্রশ্ন আরো বেশি উঠবে।

একইভাবে তুরস্কের প্রেসিডেন্টের চিঠি নিয়ে সরকার যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তাও বিস্ময়কর। স্কাইপ কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর বিচারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এখন ব্যাপক লেখালেখি চলছে। বলা হয় দুনিয়া এখন হাতের মুঠোয়। আমরা গ্লোবাল ভিলেজের বাসিন্দা। এখন কোন দেশে কী হয়, বিরোধী রাজনৈতিক দলের সাথে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা কী ধরনের আচরণ করেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বিচারের নামে স্বৈরাশাসকেরা কিভাবে বিরোধী দল দমন করেন, তা জানা কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশে প্রধান বিরোধী দলসহ বিভিন্ন পর্যায় থেকে এই উদ্বেগ বহুবার প্রকাশ করা হয়েছে। অস্বচ্ছ ও প্রশ্নবিদ্ধ বিচার যে সামাজিক অস্থিতিশীলতা ও রক্তপাতের ঘটনার সৃষ্টি করতে পারে, তাও অস্বীকার করার উপায় নেই।

সরকারের উচিত স্বচ্ছপ্রক্রিয়ায় বিচার নিশ্চিতের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মহলের এই উদ্বেগ নিরসনের উদ্যোগ নেয়া। কিন্তু সে ধরনের কোনো উদ্যোগের পরিবর্তে আমরা দেখছি সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বিষোদগারমূলক বক্তব্য রাখতে। সরকার সমর্থক ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গুলের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছে কামাল আতাতুর্কের ধর্মনিরপে তুরস্কের বিরোধিতা করে। তাঁর দল মুসলিম ব্রাদারহুড অন্যান্য মৌলবাদী সন্ত্রাসী দলের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত, যারা মনে করে ইসলামের নামে রাজনৈতিক প্রতিপকে হত্যা করা বৈধ।

তুরস্কের রাজনৈতিক ইতিহাস, একে পার্টির উত্থান কিংবা আবদুল্লাহ গুল সম্পর্কে এই সংগঠনটি কতটা অভিহিত আমরা জানি না। ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল বা খেয়ে না খেয়ে ইসলামের বিরোধিতা করা যাদের লক্ষ্য, তারা এমন বিবৃতি দেবেন তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু এই সংগঠনটির নামের সাথে নির্মূল শব্দটি প্রমাণ হয় এটি একটি হিংস্র ও ফ্যাসিবাদী সংগঠন। রাজনৈতিক নেতৃত্ব সম্পর্কে তাদের জানা শোনার কোনো আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না।

আবদুল্লাহ গুল ২০০৭ সাল থেকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়ে আসছেন। এর আগে তিনি তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। অর্থনীতি বিষয়ে ইস্তাম্বুল ও লন্ডনে লেখাপড়া করেছেন। ১৯৮৩ সালে ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন।  অর্থনীতিবিদ হিসেবে কাজ করেছেন ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক জেদ্দায়। ছাত্রজীবনে ন্যাশনাল টার্কিশ স্টুডেন্ট ইউনিয়নের নেতা ছিলেন। ১৯৯১ সালে রাফাহ পার্টি থেকে প্রথম পার্লামেন্ট মেম্বার নির্বাচিত হন। এরপর ২০০২ সাল পর্যন্ত একাধিকবার দেশটির পার্লামেন্টে নির্বাচিত হয়েছেন। নির্মূল কমিটির নেতারা দাবি করেছেন আবদুল্লাহ গুল সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। অথচ এই আওয়ামী লীগ আমলে ২০১০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি দেয়। এর আগে ২০০৯ সালের ভারতের আমিতি বিশ্ববিদ্যালয়ও তাকে সম্মানসূচক ডিগ্রি দেয়। নির্মূল কমিটির মতো উগ্রবাদী এসব সংগঠনের নেতারা নিজেদের অমার্জিত রূপ অন্যের মাঝে দেখতে পায়।

এসব ফ্যাসিবাদী সংগঠনের তৎপরতা ও বাস্তবতাবর্জিত কূটনৈতিক প্রয়াস মূলত বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। অথচ গত বছরের এপ্রিলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুরস্ক সফর করে এসেছেন। ইস্তাম্বুলে তাকে উষ্ণ সংবর্ধনা দেয়া হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সফরকে তুরস্ক অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ইস্তাম্বুলে তখন তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রজব তৈয়ব এরদোগান ছিলেন কাতারে। তিনি সরাসরি কাতার থেকে ইস্তাম্বুল চলে আসেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠক শেষ করেই আবার সৌদি বাদশাহর সাথে বৈঠকের জন্য সৌদি আরব চলে যান।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইস্তাম্বুল সফরে বাংলাদেশ ও তুরস্কের মধ্যে একটি চুক্তি ও কয়েকটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে বিনিয়োগ বাড়ানো ও নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়ে চুক্তি। কূটনীতিক ও বিশেষ পাসপোর্টধারী ব্যক্তিদের ভিসার ব্যবস্থা বিলুপ্তিকরণ এবং শুল্ক সহযোগিতাসংক্রান্ত বিষয়ে সমঝোতা। এ ছাড়া তুরস্ক বাংলাদেশের অবকাঠামো ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ২০১৫ সালের মধ্যে দুই  দেশের মধ্যে তিন বিলিয়ন ডলারে বাণিজ্য বাড়ানোর আশাবাদ প্রকাশ করা হয়। ইস্তাম্বুলে একটি কনস্যুলেট অফিস খোলা, আরো বাংলাদেশী ছাত্রের বৃত্তি দেয়া এবং তুরস্কের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লার শাহী জামে মসজিদ নির্মাণ বিষয়ে তুরস্ক আগ্রহ প্রকাশ করে।

মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমির স্মৃতিবিজড়িত আধ্যাত্মিক শহর কোনাইয়া এবং হজরত শাহজালাল রহ: স্মৃতিবিজড়িত সিলেট শহরের মধ্যে সিস্টার সিটি হিসেবে যোগসূত্র স্থাপন ও আধ্যাত্মিক রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে দুই দেশ একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করে।

এই সফরে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ চুক্তিটি হয় প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সম্পর্কিত বিষয়ে। বাংলাদেশে একটি সমরাস্ত্র কারখানা স্থাপনে তুরস্কের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও তুরস্কের মধ্যে সম্পর্কের একটি নতুন মাত্রা যোগ হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বিশেষ করে কমিউনিটি কিনিক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তুরস্ক সহযোগিতার ব্যাপারেও আশ্বাস দেয়। এ ছাড়া তুরস্কে ওষুধ রফতানি বাড়ানোর ব্যাপারেও দুই দেশ একমত হয়। ইতোমধ্যে ঢাকা-ইস্তাম্বুল সরাসরি বিমান যোগাযোগ চালু হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে এরদোগানের সাথে প্রধানমন্ত্রীর আর কোনো বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল কি না তা তখন জানা যায়নি। কিন্তু এখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়েছে, তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রজব তৈয়ব এরদোগান যুদ্ধাপরাধ বিচার বন্ধের অনুরোধ করেন। বিষয়টি ভুলে যাওয়ার পরামর্শ দেন। ২০১১ সালের মে মাসে ইস্তাম্বুলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির সাথে বৈঠকে  বিষয়টি ভুলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এর আগে ২০১০ সালের অক্টোবর মাসে বাংলাদেশে নিযুক্ত তুরস্কের রাষ্ট্রদূত মেহমুত ভারকুল ইরকুল আইনমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক মানের বিচারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

বিশ্বের অন্যান্য দেশে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে তুরস্ক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সরকারের আচরণের প্রতি তুরস্কের সতর্ক দৃষ্টি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আটক ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলের নেতাদের ব্যাপারে স্বচ্ছ বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে তুরস্কের উদ্বেগ প্রকাশ করা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়।

তুরস্কের সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল স্বাধীনতার অনেক পরে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ১৯৭৬ সালে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর তুরস্ক সফর করেন এবং দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক জোরদারের উদ্যোগ নেন। ১৯৭৮ সালে তুরস্কের সাথে বাংলাদেশের সামরিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। জিয়াউর রহমানের নামে ইস্তাম্বুলে একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়। সামরিক কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ বিনিময়ের বিষয়ে ২০০৪ সালে দেশটির সাথে আরেকটি সামরিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রায় তিন হাজার সামরিক কর্মকর্তা তুরস্কে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি ধারাবাহিকভাবে তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতাসীন হওয়ার পর মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক জোরদারের ওপর গুরুত্বারোপ করে। এর অংশ হিসেবে ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে ঢাকা সফর করেন তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী এরদোগান। এর আগে একই বছরে ফেব্রুয়ারি মাসে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুলও ঢাকা সফর করেন।

তুরস্কের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি ক্ষমতায় এসে দেশটির বিদেশনীতিতে আমূল পরিবর্তন আসে। ন্যাটোর সদস্যদেশ হিসেবে পশ্চিমা বিশ্বের সাথে ঘনিষ্ঠতার পাশাপাশি মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের পর্যায়ে চলে আসে। ইসরাইলের সাথে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার সম্পর্ক থাকার পরও প্রধানমন্ত্রী এরদোগান ইসরাইলের কঠোর সমালোচনা করেছেন। অবরুদ্ধ গাজায় ত্রাণবাহী জাহাজ পাঠানোকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক চরম অবনতি ঘটে। ইতোমধ্যে তুরস্ক ঘোষণা দিয়েছে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক সীমিতপর্যায়ে নামিয়ে আনা হবে। শুধু ফিলিস্তিন ইস্যু নয়, আরব বিশ্বে তুরস্কের প্রভাব সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে আরব গণজাগরণ শুরু হওয়ার পর। তিউনিশিয়ায় বেন আলি সরকারের পতনের পর ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল আল নাহদা ক্ষমতায় আসার আগে স্পষ্ট জানিয়ে দেয় তারা রাষ্ট্র পরিচালনায় তুরস্ককে অনুসরণ করবে। মিসরেও মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক সংগঠন ফ্রিডম ও জাস্টিস পার্টি ও অনেকটা তুরস্কের নীতি নিয়েছে। মরক্কোতেও ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে।

বাংলাদেশের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশবিরোধী খিলাফত আন্দোলনে এ দেশের মানুষ তুরস্কের পাশে দাঁড়িয়েছিল। মাওলানা মুহাম্মদ আলী, মাওলানা শওকত আলী, মাওলানা আকরম খাঁ, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক খিলাফত আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। মোস্তফা কামাল পাশার বীরোচিত ভূমিকার জন্য কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতাটি এ দেশের মানুষকে শুধু উজ্জীবিত করেনি তুরস্কের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের আবেগকে স্থায়ী রূপ দিয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে মোস্তফা কামাল পাশার নামে দু’টি রাস্তার নামকরণ ছাড়াও ফেনীর দাগনভূঞা আতাতুর্ক মডেল হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। তুরস্কের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের একধরনের আবেগের সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের উচিত আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারকারী এ দেশটির সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ করা। দেশটির সাথে দূরত্ব সৃষ্টি করলে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। তুরস্কের সাথে টানাপড়েন এই বিচ্ছন্নতাই শুধু বাড়াবে।

alfazanambd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.