মনিকা ধর্ষণের প্রত্যক্ষদর্শী- হাছা কথায় মরতেও ভয় পাই না


(বাসচালক ও হেলপার পোশাককর্মী ‘মনিকা’কে (১৮) চলন্ত বাসে ধর্ষণ শেষে রাস্তায় ফেলে যায়। রোমহর্ষক ঘটনাটির অনুসন্ধানে বাংলানিউজ ইনভেস্টিগেটিভ টিম এ মুহূর্তে রয়েছে মানিকগঞ্জে।
এই টিমে রয়েছেন স্টাফ করেসপন্ডেন্ট উর্মি মাহাবুব, জেসমিন পাঁপড়ি, সাজেদা সুইটি, চিফ ল করেসপন্ডেন্ট জাকিয়া আহমেদ ও হেড অব নিউজ মাহমুদ মেনন। সঙ্গে রয়েছেন ডেপুটি চিফ অব ফটো করেসপন্ডেন্টস নাজমুল হাসান, স্টাফ ফটো করেসপন্ডেন্ট সবিতা রহমান ও মানিকগঞ্জ সংবাদদাতা খন্দকার সুজন হোসেন। পাশবিকতার শিকার মেয়েটির ‘মনিকা’ ছদ্মনাম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলানিউজ।)

‘মনিকা’ ধর্ষণের ঘটনা দেখতে পেয়ে আসামিদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য হান্নান এখন মানিকগঞ্জের হিরো। তিনি বলেছেন, নিজের চোখে দেখেছি দুই আসামি এই জঘন্য কাজ করছে। বিবেকের তাড়নায় আমি চুপ থাকতে পারি নি।
মানিকগঞ্জের অনেকেরই মুখে মুখে এখন হান্নানের নাম। তারা বলছেন হান্নানই আসামিদের ধরতে সহযোগিতা করেছেন। মানিকগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সফিকুল ইসলাম বাংলানিউজের কাছে হান্নানের প্রশংসা করেছেন। একইভাবে তার প্রশংসা করেন মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক মাসুদ করিম।

মানিকগঞ্জ শহর থেকে গড়পাড়ার বাংলাদেশ বাজার এলাকা পর্যন্ত হান্নানকে চেনেন না এমন কেউ নেই।

শনিবার একটি বাড়িতে বাবুর্চির কাজ করতে যান হান্নান। তার সঙ্গে বাংলানিউজের ইনভেস্টিগেটিভ টিমের কথা হয় শনিবার সন্ধ্যায়। সদর থানায় তিনি তখন দেখা করতে এসেছিলেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক (এসআই) আসগরের সঙ্গে।

‘‘কি বললেন ওসি?’’- জানতে চাইলে সদাহাস্য চেহারার হান্নান মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, “বললেন যা সত্য তাই বলবা। আমিও যা সত্য তাই বলছি (বলেছি)।”

‘‘সত্যটা কী?’’- জানতে চাইলে হান্নান বলেন, “আমি নিজের চোখে দেখি বাসের পেছনের সিটে মেয়েটির ওপর পাশবিক নির্যাতন চলছে। আমি যখন ঘটনাটি দেখতে পাই তখন হেলপার গাড়ি চালাচ্ছিল আর ড্রাইভার মেয়েটির ওপর হামলে পড়েছে। আমি তাদের ধরার জন্য পিছু নেই। বাসটি পাটুরিয়ার পথে কিছুদূর গিয়ে ফের উল্টো পথ ধরে।”

“তখন আমি দ্রত বাস থেকে নেমে উল্টোদিকের আরেকটি গাড়িতে চড়ে বসি। মানিকগঞ্জের রিকশাস্ট্যান্ডের কাছাকাছি এসে তারা মেয়েটিকে রাস্তার মধ্যে ফেলে রেখে যায়। আমিও দ্রুত অন্য বাস থেকে নেমে পড়ি। প্রথম মেয়েটিকে বাঁচাই। যাত্রী ছাউনির নিচে মেয়েটিকে নিয়ে যাই। তখন সে ভীষণ কান্নাকাটি করছিল। আমি তাকে রেখে ওদের ধরার জন্য ছুটে যাই। পরে ধর্ষকদের একজনকে খুঁজে বের করে নিজেই মারধর শুরু করি।”

“অন্য বাস থেকে আসামিদের কীভাবে চিনলেন?” জবাবে হান্নান বলেন, “২০ বছর ধরে এই এলাকায় হকারি করি প্রতিটি বাসের ড্রাইভার-হেলপারকে আমি চিনি।”

হান্নান বলেন, “ব্যাটারা মনে করেছিল পার পেয়ে যাবে কিন্তু আমি তা হতে দেই নি। মা বোন সবারই আছে। একটি অসহায় মেয়েকে দেখে আমি আর চুপ থাকতে পারি নি।” ধর্ষকরা মেয়েটির কাছ থেকে তার এক হাজার টাকা ও মোবাইল ফোনটিও ছিনিয়ে নিয়ে যায় বলে জানান হান্নান।

মা-বাবার প্রতি অত্যন্ত ভক্তিপ্রবণ মোহাম্মদ হান্নান আরও জানান, তিনি তার বাবা-মা-ভাইবোন-স্ত্রী-পরিজন নিয়ে একসঙ্গে বসবাস করেন। পরিবারের সবার মুখে খাবার তুলে দিতে উদয়াস্তই নয়, রাত-বিরেতেও বিভিন্ন ধরনের কাজ করে জীবিকা সংগ্রহ করেন। তবে তার প্রধান কাজ মানিকগঞ্জ-পাটুরিয়া রুটে ঝাল-বাদাম, চকলেট, চুইংগাম, জিনজার ইত্যাদি ফেরি করা। এসব থেকে দিনে ৫০০-৬০০ টাকা আয় হয়। তাতেই চলে সংসার। নিজের দুই ছেলে-স্ত্রী ও বাবা-মা ভাই বোন নিয়ে  ভালোভাবেই তার কেটে যাচ্ছে বলে জানালেন হান্নান। 

তবে এই ঘটনার পর অনেকেই তাকে এই বলে ভয়-ভীতি দেখাচ্ছে যে, আসামিরা ছাড়া পেলে তাকে মেরে ফেলবে। কিন্তু তাতে ভীত নন হান্নান। তিনি বললেন, ‘‘হাছা কথায় মরতেও ভয় পাই না।’’

তবে একটি ভালো কাজ করার জন্য যদি কখনো বিপদে পড়েন তখন পুলিশ ও সাধারণ মানুষ তার পাশে থাকবে এটাই প্রত্যাশা হান্নানের।



No comments

Powered by Blogger.