'৭১-এর পরবর্তী প্রজন্ম যুদ্ধাপরাধী অনুসারী হয় কেন? by মমতাজ লতিফ

এটা তো সাদা চোখেই দেখা যায়, সাপের গায়ে আঘাত করলে সে তৰুণি আঘাতকারীকে ছোবল মারবে! প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, এখনও তো '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শুরু হয়নি, আংশিক সম্পন্ন হয়েছে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও রায় কার্যকর করার কাজ,
এরই মধ্যে তরম্নণ প্রজন্মের জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের নির্দেশে এবং তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে নিরীহ, জনপ্রিয়, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী রাজনৈতিক কমর্ীদের একের পর এক জনকে খুনের যে তা-ব চালিয়েছে_ তা করে যারা '৭১-এ জন্মগ্রহণ করেনি। তারা নিজেদের হাত, দেহ-মন-বিবেককে কলুষিত করল কেন? প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, বর্তমানের তরুণ প্রজন্মের একটি দল কি স্বাধীন বাংলাদেশ চায় না? তারা কি '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের মতো পাকিসত্মান-ভাঙ্গার দুঃখে ভোগে? যদি ভোগে, তাহলে তারা কি বর্তমানের তালেবান অধু্যষিত, প্রাণের নিরাপত্তাহীন, সবসময় বোমা-গ্রেনেড বিস্ফোরণে পাকিস্তানী নারী-শিশু-পুরুষ নিহত হওয়ার সেনা-পুলিশ ঘাঁটি বা শিৰা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হওয়ার সংখ্যাতীত ঘটনায় বিধ্বস্ত পাকিস্তানকে দেখতে পায় না? এ ঘটনাগুলো তাদের কাছে কাঙ্খিত হয় কেন এবং কিভাবে? সাধারণভাবে এটি জানা কথা যে,
কথিত আছে শয়তান সব সময় মানুষকে পাপ কাজে নিয়োজিত করতে প্রতিমুহূর্তে নতুন নতুন পরিকল্পনা প্রণয়ন করে চলে। তেমনি দেখা যাচ্ছে সমাজের মূল স্রোতের বিরুদ্ধপন্থী খুনী অপরাধীরাও দেশের মূলস্রোত-বিরোধী ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনায় সবসময় প্রতিমুহূর্তে নিয়োজিত রয়েছে।
আশ্চর্য এই যে, '৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের পৰের দলের ও মতের ব্যক্তিকে তারা যে বর্বরতম, নিষ্ঠুরতম পন্থায় হত্যা করেছিল, হাজার মুক্তিকামী বাঙালীর চৰু উৎপাটন করে বসত্মাভরা মানুষের চোখে জাতিকে প্রদর্শন করেছিল, চৰু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চোখ উৎপাটিত করেছে, বৰ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের হৃৎপি- তুলে নিয়েছে, লেখকদের আঙ্গুল কেটে নেয়া হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর তর্জনীতে গুলি করা হয়েছে, জেলখানায় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রধান স্থলে মুক্তিযুদ্ধের চার সংগঠক-পরিচালক জাতীয় নেতাকে গুলি ও বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করেছে, প্রহসনের বিচারে বীর মুক্তিযোদ্ধা, সম্মুখ পঙ্গু সমরে কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে হত্যা করেছে। এরপর কয়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে কু্য-এর নামে ফাঁসিতে হত্যা করা হয়েছে_ এসব অপঘটনাকে '৭১-পরবতর্ী প্রজন্ম যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিৰা গ্রহণ করছে, তারা কোন মেনে নিচ্ছে? এ এক গুরম্নতর প্রশ্ন। উপরন্তু শুধু গ্রহণ করেই এরা ৰানত্ম হচ্ছে না; এরা ঐ বর্বর, ফ্যাসিবাদী হিংস্র খুনের রাজনীতির ভ্রানত্ম কলুষিত পথকেও গ্রহণ করছে এবং নিজেরা সমাজের মূলস্রোতকে পরিত্যাগ করে অন্ধকার সহিংস পথে পা বাড়াচ্ছে। '৭১-এর পর পরিকল্পিতভাবে নিরৰরের ও দরিদ্রের সনত্মানদের জঙ্গীতে পরিণত করেছে অতি ধূর্ত সুবিধাভোগী এই যুদ্ধাপরধী ও যুদ্ধাপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা এবং যুদ্ধাপরাধীদের খুনের রাজনীতির সুবিধাভোগী শ্রেণী। দেখা যাচ্ছে, '৭১-এর পর প্রথম দশক এরা খুনের রাজনীতিকে ক্রমশ উচ্চশিৰায় অনুপ্রেবেশ করিয়েছে তাদের মাধ্যমে যাদের থাকা-খাওয়ার প্রয়োজন পূরণের অসুবিধা আছে_ এমন তরম্নণ-তরম্নণীকে 'হলের সিট দেয়া, ভর্তি ও পড়াশুনা চালানোর ব্যয় যুগিয়ে তাদেরকে জঙ্গী রাজনীতির অনুসারীতে পরিণত করেছে। পরবতর্ীতে দেখা যাচ্ছে__ ধনী-উচ্চবিত্তের সনত্মান যারা বাড়িতে বাবা-মা'র ভালবাসা, নজরদারি নৈকট্য লাভের মাধ্যমে সমাজের মূলস্রোতের কাঙ্খিত মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি, আদর্শ লাভে বঞ্চিত থাকে, যারা ন্যায়-অন্যায়, শুভ-অশুভ বোধ-এর পার্থক্য উপলব্ধি করতে অৰম বা এসব বিষয়ে দ্বিধাগ্রসত্ম রয়ে গেছে, সেই তরম্নণ ও উচ্চবিত্তের সনত্মানদের এই দ্বিধান্বিত চিত্তের কারণে এবং ন্যায়-অন্যায় সম্বন্ধে অস্পষ্ট ধারণার ফলে তারা ধর্মজীবী ধুরন্ধর অপশক্তির অসহায় শিকারে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ এরাও '৭১-এর সেই প্রাচীন বর্বর খুনের অপরাজনীতির খপ্পরে পড়েছে। এ ঘটনা লজ্জাজনক এবং তরম্নণ-প্রজন্মের কাঙ্খিত ভূমিকা_ লাভের পৰে এবং অশুভের বিপৰের লড়াইয়ে অংশগ্রহণের চিরকালীন রীতিটিকে বাংলাদেশে দীর্ঘকাল যাবত ভঙ্গুর করে তুলেছে। নতুবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিক্যাল কলেজ কিংবা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিৰাথর্ী এবং শিৰকেরা ত্রিশ লাখ মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী বাঙালীর প্রাণের বিনিময় অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসীদের মূল স্রোতধারার বিরম্নদ্ধে এবং '৭১ ও '৭৫ ও এর পরবতর্ীকালের খুনীদের পৰাবলম্বন করে কেন ও কি ধরণের লাভের স্বার্থে? অথচ জার্মানীর হিটলারের নাৎসি বাহিনীর দ্বারা কৃত মানবতার বিরম্নদ্ধে অপরাদের পাশে বাংলাদেশের '৭১, '৭৫ ও এর পরের অনেক পরিকল্পিত নাশকতা ও খুনের ঘটনাবলী নাৎসি বাহিনীর অপরাধের চাইতে কোন অংশে কম বর্বর নয়। সেৰেত্রে ইউরোপে নাৎসি-অনুসারী হওয়া আর অপরাধী হওয়া বর্তমানে সমার্থক। প্রগতিশীল লেখক-শিৰক হুমায়ুন আজাদ প্রায়ই বলতেন_ 'মাদ্রাসার মোলস্না যদি বুয়েটের উপাচার্য অধ্যৰ হন, তাহলে ওখানে মাদ্রাসায় যা উৎপন্ন হয়, তাই উৎপন্ন হবে, ওখানে দেশপ্রেমিক উদার প্রগতিশীল প্রকৌশলী জন্মাবার সম্ভাবনা তো কমই হবে।' খুব বেশি না হলেও জঙ্গী জন্মদানকারী জামায়াত-শিবির ও জঙ্গীপন্থী বিএনপির সংখ্যা বিশ্ববিদ্যালয়ের বা বুয়েটের প্রডাক্টে খুব কম হবে না। শুধু শিৰা প্রতিষ্ঠানে নয়, প্রশাসন, গোয়েন্দা, সিভিল-মিলিটারি প্রশাসনে এদের উত্থান মুক্তিযুদ্ধ-জাত জাতিকে বিস্মিত না করে পারে না। '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পরাজিতদের সমাজে ধনে-ৰমতায় প্রত্যাবর্তনে রাজনীতিকদের চাইতে দীর্ঘকাল যাবত বেশি ভূমিকা রেখেছে উচ্চশিৰিত সিভিল-মিলিটারী ও নিরাপত্তা বাহিনীর প্রশাসক-আমলা এবং পেশাজীবী বিশেষত: বিভিন্ন পেশার শিৰা প্রতিষ্ঠানের শিৰক এবং সাংবাদিক।
২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যনত্ম খালেদা-নিজামী-তারেক-বাবরের সরকারের সময়-এর অপ-ঘটনাবলী প্রমাণ করে, জামায়াত-শিবির (এ দুটোকে রাজনৈতিক দল বিবেচনা করা যায় না) এর দ্বারা কত সহস্র জঙ্গী-খুনীর জন্ম হয়েছে এবং সে সঙ্গে কত উচ্চশিৰিত ষড়যন্ত্রীরও জন্ম হয়েছে।
একদিকে সংঘটিত হয়েছে জঙ্গী খুনীদের দ্বারা কাজী আরেফসহ অনেক জঙ্গীবিরোধী জাসদ নেতা হত্যা, নেমনি জঙ্গীবিরোধী সাংবাদিক শামছুর রহমান হত্যা, তেমনি উদীচী, ছায়ানটের নববর্ষের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, শাহ কিবররিয়ার ওপর গ্রেনেড হামলা, ব্রিটিশ হাই কমিশনারের ওপর বোমা হামলা, সিনেমা হলে, যাত্রামঞ্চে, মেলায় বোমা হামলা, অপরদিকে সংঘটিত হয়েছে তারেক-খুনী দাউদ ইব্রাহিমের সভা, নির্বাচনের ফল দখলের লৰ্যে আমলাদের উত্তরা ষড়যন্ত্র, এরপর 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার' দখলের ষড়যন্ত্র, যার পরিণতিতে সেনা সমর্থিত নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার-এর ৰমতাগ্রহণ সংঘটিত হয়।
এখন বর্তমানেও এই যুদ্ধাপরাধীপন্থী, '৭৫-এর খুনীপন্থীরা ব্যবসায় চাল, ডাল, তেল, দুধ-এর সিন্ডিকেট করে বাজার অস্থিতিশীল করছে, শীতকালেও বিদু্যতের লোডশেডিং যা আগে কখনও হয়নি। তা'ও ঘটাচ্ছে, গ্যাস-এর সঞ্চালনে কৃত্রিম অতিরিক্ত ঝামেলা সৃষ্টি করছে, টেলিফোন বিকল করছে, অটো সিগন্যাল ব্যবস্থা ও যন্ত্র বিকল করে যানজট বৃদ্ধি করছে এমনকি প্রায় সব কোম্পানি লবণে আয়োডিন না মিশিয়ে গর্ভস্থ শিশুদের বুদ্ধি-প্রতিবন্ধী করছে, বাজারকে চীনা কমলায় সয়লাব করে দেশীয় কমলা যা প্রচুর উৎপন্ন হয়েছিল সেগুলোকে অদৃশ্য করে কৃষির সাফল্য মস্নান করার কাজ করছে। এসবের সঙ্গে প্রশাসনে উন্নয়ন কর্মসূচীকে ফাইলবন্দী করে ফেলে রাখা এবং বারবার অহেতুক অপ্রয়োজনীয় 'নোট' লিখে সরকারের কাজের গতিকে বাধাগ্রসত্ম করার প্রক্রিয়াও অব্যাহতভাবে চলছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল সরকার গঠন করলে উচ্চ শিৰিত পেশাজীবী যাদের বোধ-জ্ঞান-উপলব্ধি শুভ-অশুভকে চিহ্নিত করতে পারার কথা, তাদের মধ্যেও এ সরকার-বিরোধিতা কেন? যুদ্ধাপরাধী পৰ হতে কেন এরা বিন্দুমাত্রও লজ্জিত বোধ করছে না?
সবশেষের প্রশ্ন_বিএনপির নতুন যুগ্মসচিবের তারেক ও জিয়া বন্দনা বিএনপির রাজনীতির অন্ধকার ভবিষ্যকেই কি ইঙ্গিত করছে না? সংবাদসূত্রে জানা গেছে, তিনি সম্প্রতি লন্ডনে তারেকের দ্বারা আয়োজিত এক সভায় যুদ্ধাপরাধী চৌধুরী মইনুদ্দীনসহ অনেক যুদ্ধাপরাধীর সঙ্গে যোগ দিয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনা ও কর্মকা- সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ? তার নিজের ও বিএনপির ভবিষ্যত রাজনীতির ওপর তারেক ও '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের ছায়া দেখে জাতি উদ্বিগ্ন, তা বলা বাহুল্য। ভালকে ভাল বলার এবং মন্দকে মন্দ জ্ঞান করে পরিত্যাগ করার সৎ সাহস না থাকলে যে কোন রাজনীতিক বা রাজনৈতিক দলের ভবিষ্যত আর যাই হোক উজ্জ্বল হবে না_ তা বলা যায়।

No comments

Powered by Blogger.