ভাষাসৈনিকদের তালিকা প্রণয়ন করুন by বাহাউদ্দীন চৌধুরী

বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে তরুণ-তাজা প্রাণ ঝরে পড়েছিল। তাদের তপ্ত লহুতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলা ভাষার দাবি। বস্তুত ১৯৪৮ সাল থেকে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন শুরু করেছিল ছাত্ররা।
দাবিটি প্রথম উচ্চারণ করেছিলেন জ্ঞানতাপস বহু ভাষাবিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুলস্নাহ ১৯৩৭ সালের জুলাই মাসে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৩৭ সালের পনেরোই আগস্ট। ডক্টর শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, যদি বিদেশী ভাষা বলে ইংরেজী পরিত্যক্ত হয়, তাহলে বাংলাকে পাকিসত্মানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ না করার যুক্তি নেই। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দিলে ডক্টর শহীদুল্লাহ একথা বলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরে দার্শনিক মনীষী কাজী মোতাহার হোসেন বলেন, বর্তমানে যদি গায়ের জোরে উর্দুকে বাঙালী হিন্দু-মুসলমানের ওপর রাষ্ট্রভাষারূপে চাপাবার চেষ্টা করা হয়, তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ হবে।
কারণ ধূমায়িত অসনত্মোষ বেশিদিন চাপা থাকতে পারে না। শীঘ্রই তাহলে পূর্ব-পশ্চিম সম্পর্কের অবসান হবার আশঙ্কা আছে। ঐশ্বরিক ভবিষ্যদ্বাণী। তাঁর কথা সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। সমকালীন অপর মনীষী ডক্টর এনামুল হক বলেছিলেন, মোটের উপর বাংলাকে ছাড়িয়ে, উর্দুকে রাষ্ট্রভাষারূপে পূর্ব পাকিস্তানবাসী গ্রহণ করিলে তাহাদের রাজনৈকিত, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মৃত্যু অনিবার্য।
দেখা যায়, কোন রাজনৈতিক দল বা নেতা বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেন নাই। জ্ঞানী পণ্ডিত ব্যক্তিগণই এই দাবি প্রথম উত্থাপন করেন। যদিও এই দাবি উত্থাপন ছিল রাজনৈতিক নেতাদেরই কর্তব্য। পরবর্তী সময়েও প্রতিষ্ঠিত প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এই দাবি সমর্থন করেন নি। তাঁরা ছিলেন কীব মেরম্নদ-হীন, পশ্চিম পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দের পা-চাটার দল। তাঁরা নিজেদের পথ এবং হালুয়া-রম্নটির ভাগ-বাটোয়ারা নিয়েই ব্যসত্ম ছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের তরম্নণ অধ্যাপক আবুল কাশেম সর্বপ্রথম এই দাবিটিকে সাংগঠনিক রূপ দেয়ার চেষ্টা করেন। তিনি সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন তমুদ্দুন মজলিশের পৰ থেকে ভাষার দাবি সংবলিত বিভিন্ন বিদগ্ধজনের প্রবন্ধ সংগ্রহ করে প্রথম পুসত্মিকা 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উদর্ু' প্রকাশ করেন। তমুদ্দুন মজলিশ না করলেও এই পুসত্মিকাটি আমি ফেরি করে বিক্রি করেছি। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে পাকিসত্মান গণপরিষদের কংগ্রেসদলীয় সদস্য শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে পরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রসত্মাব উত্থাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী নবাবজাদা লিয়াকত আলি খান তাকে অত্যনত্ম অসৌজন্যমূলক ভাষায় আক্রমণ করেন। প্রতিবাদে ১৯৪৮ সালের ছাবি্বশে ফেব্রম্নয়ারি অধ্যাপক আবুল কাশেমের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্রসভায় শ্রী দত্তকে অভিনন্দন জানানো হয়। গণপরিষদে পূর্ববঙ্গীয় কোন মুসলমান সদস্য শ্রী দত্তকে সমর্থন করেন নি। ১৯৪৮ সালের সাতাশে ফেব্রম্নয়ারি অধ্যাপক আবুল কাশেমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় শামসুল আলমকে আহ্বায়ক করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সংগ্রাম পরিষদ এগারোই মার্চ সভা-সমাবেশ ও বিৰোভ মিছিল করারও সিদ্ধানত্ম হয়। সচিবালয় গেটে পিকেটিং করার সময় ছাত্রলীগের শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, আজিজ আহমদ, আবদুল ওয়াদুদসহ কয়েকজন ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। বামপন্থী ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের আমি, মোহাম্মদ তকীয়ূলস্নাহ, ইকবাল আনসারী খান, মোহাম্মদ নাসিরসহ অন্যান্য কয়েকজন গ্রেফতার হই। আমি তদানীনত্মন জাঁদরেল পাঞ্জাবী চীফ সেক্রেটারি আজিজ আহমদের গাড়ির সামনে শুয়ে পড়ে তাকে হেঁটে অফিসে যেতে বাধ্য করি। এতে পুলিশ ৰিপ্ত হয়ে যায়। আমাকে নির্দয়ভাবে মারতে থাকে। পুলিশের বন্দুকের কুঁদার আঘাতে আমার বাঁ হাত দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঝুলতে থাকে। এই অবস্থায় আমাকে গ্রেফতার করে পুলিশ প্রহরায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসা দেয়া হয়। তিন মাস পরে মেডিক্যাল রিপোর্টের ভিত্তিতে আমাকে মুক্তি দেয়া হয়। তারপরও আমাকে দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিতে হয়। তবে বাম হাতটি সারাজীবনের জন্য দুর্বল হয়ে যায়। ১৯৪৮ সালের এগারোই মার্চ ভাষা আন্দোলনে এক অতি গুরম্নত্বপূর্ণ মাইলফলক। তখন থেকেই ভাষা আন্দোলন কেবল একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন হয়ে থাকে নি; একটি জঙ্গী রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নিতে থাকে। ১৯৪৮ সালেই হয় ভাষা আন্দোলনের সংগ্রামী সূত্রপাত। এই সূচনাপর্ব থেকেই ১৯৪৯, ১৯৫০, ১৯৫১ সালের বিভিন্ন সময়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে, আরবী হরফে বাংলা লেখার প্রতিবাদে ছাত্ররা আন্দোলন করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় বায়ান্নর একুশে ফেব্রম্নয়ারি তরম্নণদের রক্তে ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়। শুধু তাই-ই নয়, এই রক্তবীজে বাঙালী জাতীয়তার যে চারাগাছটি অঙ্কুরিত হয়, তা-ই বিভিন্ন পর্যায়ে, লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিরাট মহীরম্নহে পরিণত হয়ে একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামে যোগ দিতে বাঙালীকে অনুপ্রাণিত, উদ্বুদ্ধ করে। বাঙালী জাতিসত্তার প্রথম উন্মেষ বায়ান্নর একুশে ফেব্রম্নয়ারি। তাই একুশে ফেব্রম্নয়ারি আমাদের জন্য খুবই গুরম্নত্বপূর্ণ।
ফেব্রম্নয়ারি মাসে আমরা আবেগে আলোড়িত হই। ফেব্রম্নয়ারি মাসে বাংলা একাডেমী বই মেলার আয়োজন করে। এই বই মেলায় প্রচুর নতুন বই প্রকাশিত হয়, বিক্রিও হয়। তাই বই মেলায় প্রকাশকরা নবীন লেখকদের বইও প্রকাশ করায় তারা উৎসাহিত হয়। নতুন লেখক সৃষ্টিতে তাই বই মেলার অবদান অনস্বীকার্য।
পূর্বে পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের কবিতা-গল্প-উপন্যাসই আমাদের দেশে বেশি বিক্রি হতো। বর্তমানে আমাদের দেশীয় লেখকদের বই বিক্রি হচ্ছে। প্রকাশনার ও লেখার মান পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত বইয়ের সঙ্গে তুলনীয়। যথেষ্ট উন্নত মানের বই প্রকাশিত হচ্ছে। খ্যাতিমান শিল্পীরা বইয়ের প্রচ্ছদ করছেন। অবশ্য শিল্পী কামরম্নল হাসান পঞ্চাশের দশক থেকেই বইয়ের প্রচ্ছদ করছেন।
শারীরিক অসুস্থতার জন্য বছর তিনেক বই মেলায় যেতে পারিনি। বাতের জন্য আমি হাঁটতে পারি না। তাই কয়েক বছর শহীদ মিনারেও যেতে পারি নি। এবার বই মেলায় একদিন গিয়েছিলাম বহু কষ্ট করে আমার সাংবাদিকতার গুরম্ন কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিসের প্রবন্ধ গ্রন্থ 'সব মুখ চেনা চেনা'র মোড়ক উন্মোচন করতে। মেলায় আমার নিজের লেখা প্রবন্ধ সংকলন '১৫০ মোগলটুলী' প্রকাশ করেছে প্রকাশনা সংস্থা পড়ুয়া (স্টল নং-২৭০)। আমি সেখানেও যেতে পারিনি। মেলায় গিয়ে আমার মনে হয়েছে, বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণ বইমেলার জন্য অপ্রতুল। কথাটা আমি পত্রিকানত্মরে প্রকাশিত সাৰাতকারেও বলেছি। জায়গাটা সম্প্রসারিত করা প্রয়োজন। সোহরাওয়াদর্ী উদ্যানের একাংশে মেলা সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। আমার আরও একটি প্রসত্মাব আছে। অনত্মত জেলা শহরগুলোতে বইমেলা করা হোক এবং ফেব্রম্নয়ারি মাসেই। এই দায়িত্ব নিতে হবে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রকে। আশা করি, সরকার প্রসত্মাবটি বিবেচনা করে দেখবে।
ফেব্রম্নয়ারি মাসে আমরা বাংলা ভাষার জন্য আবেগাকুল হয়ে পড়ি। যেমন পহেলা বৈশাখে রমনা বটমূলে ছায়ানটের গান শুনে, মাটির সানকিতে পানত্মাভাত খেয়ে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে একদিনের বাঙালী হয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করি। আমি নিজে কখনও পানত্মভাত খাইনি। কারণ আমি জন্মাবধি ঢাকা শহরে আছি। আমার খাদ্যাভ্যাস পুরনো ঢাকার লোকদের মতো এবং তাতে আমি মোটেই লজ্জিত নই। একদিনের বাঙালীর চাইতে অনেক বেশি বাঙালী আমি। আমি আট চলিস্নশ থেকে বায়ান্ন পর্যনত্ম ভাষা আন্দোলনের সব সত্মরে ছিলাম। ১৯৪৮, ১৯৪৯, ১৯৫০ সালে সর্বমোট দেড় বছর জেল খেটেছি বিভিন্ন মেয়াদে। ১৯৫১ সালের শেষ দিকে ঢাকায় প্রথমবার বাংলা নববর্ষ উদযাপনের জন্য আমার নামে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হয়েছি। আমি আত্মগোপনে বায়ান্নর একুশে ফেব্রম্নয়ারি থেকে কমরেড শহীদুলস্নাহ কায়সারের নেতৃত্বে মেডিক্যাল কলেজের মাইক থেকে অবিরাম বক্তৃতা করেছি। গ্রেফতারী পরোয়ানা থাকায় মিছিলে যেতে পারিনি। পার্টি থেকে নির্দেশ ছিল যেন কিছুতেই গ্রেফতার না হই। আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি। তাই পানত্মাভাত খেয়ে আমার বাঙালী হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। এই একদিনের বাঙালীগণ উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোক। তারা নিজেদের সনত্মানদের ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে পাঠান। এই সব স্কুলে শিশুদের ইংরেজীতে কথাবার্তা বলতে বাধ্য করা হয়। বাড়িতেও পিতা-মাতা ইংরেজীতে কথা বলেন। তারা বাংলা বলার সুযোগই পায় না।
অনেক স্কুলে বাংলা পড়ানোই হয় না। তারা শিশুকাল থেকেই একটি ফিরিঙ্গি সংস্কৃতিতে অভ্যসত্ম হয়ে পড়ে। ফলে, স্বদেশ, স্বজাতি ও বাংলা ভাষার প্রতি তাদের কোন ভালবাসা জন্মায় না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলা ভাষা-সাহিত্য পড়ানো হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন কলেজসমূহেও বাংলা পড়ানো হয়। কিন্তু অধিকাংশ বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পড়ানো হয় না। এদিকে সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নজর দেয়া জরম্নরী। ইংরেজী মাধ্যম স্কুল এবং বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পড়ানো বাধ্যতামূলক করা হোক। যারা এই নির্দেশ মানবে না তাদের অনুমোদন বাতিল করা হোক। অবিলম্বে এই নির্দেশ দেয়া হোক।
আরও একটি বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। ভাষাসৈনিকের একটি প্রামাণ্য পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন করা হোক। বায়ান্নর পরে আটান্ন বছর চলে গেছে, কোন সরকারই ভাষাসৈনিকদের তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয় নি। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সরকার যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাঙালী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী সরকার, তাই তাদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেশি। কেবল তালিকা প্রণয়নই নয়, তাদের জাতীয় বীর আখ্যা দিয়ে সম্মানিত করতে হবে। তাদের মধ্যে যারা দুস্থ তাদের জন্য সম্মানজনক রাষ্ট্রীয় ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে। যারা অসুস্থ তাদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। এই কাজটি অনায়াসেই করা যায়। বর্তমানে জীবিত ভাষা-সৈনিকদের সংখ্যা খুবই কম, অধিকাংশই পরলোকগমন করেছেন। তাই সরকারের বেশি টাকা খরচ হবে না। তবে এই তালিকা প্রণয়ন, ভাতা প্রদান, চিকিৎসার ব্যবস্থায় কোন দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থাকা চলবে না। এই প্রসঙ্গে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের কুমিলস্নার বাড়িটি সম্পর্কে বলতে চাই। বাড়িটি অযত্ন-অবহেলায় জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। সংরৰণের কোন ব্যবস্থা নেই। বাড়িটি নিয়ে মামলা চলছে। বাড়িটি বন্ধক রেখে কিছু টাকা নেয়া হয়েছিল, অতি সামান্য টাকা। সরকার অনায়াসে এই টাকাটা অনুদান হিসেবে দিয়ে বন্ধকটি ছাড়িয়ে নিতে পারে। বাড়িটিতে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাতনি এরোমা দত্ত মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, হাসপাতাল ইত্যাদি প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। সরকার এই বিষয়ে তাকে সহায়তা করতে পারে। ভাষা শহীদদের পরিবারবর্গকেও সরকারের সর্বপ্রকার সহায়তা দেয়া উচিত। আশা করি, আগামী ফেব্রম্নয়ারি আসার পূর্বেই সরকার ব্যবস্থাগুলো নেবে।
আরও একটি বিষয়ের প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করব। দেশে কয়েকটি এফএম রেডিও চালু হয়েছে। তাদের অনুষ্ঠান জনপ্রিয় হয়েছে। এই রেডিওগুলোতে বাংলা ভাষাকে বিকৃত করা হচ্ছে, উচ্চারণও বিকৃতভাবে করা হয়। ইংরেজী বাংলা মিশিয়ে একটা অদ্ভুত খিচুড়ি ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়। এটা অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত। যারা পরিবর্তন করবে না তাদের সম্প্রচার লাইসেন্স বাতিল করতে হবে। কিশোর-কিশোরীরা এই অনুষ্ঠানগুলো পছন্দ করে। তারা বিকৃত ভাষা ও বিকৃত উচ্চারণ শিখবে। এটা ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য অত্যনত্ম ৰতিকর। আরও একটা দিক দিয়ে বাংলা ভাষা আক্রানত্ম। আকাশ-সংস্কৃতির কারণে এ দেশে হিন্দু ভাষার আগ্রাসন চলছে। পাকিসত্মান আমলে বাংলা ভাষার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে উদর্ু ভাষা। পাকিসত্মান সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় অনেক উদর্ু, আরবী, ফারসী শব্দ বাংলা ভাষায় জোর করে ঢুকিয়ে ভাষাকে মুসলমানী করাবার চেষ্টা হয়েছে। তাদের আক্রমণ থেকে নজরম্নল ইসলাম পর্যনত্ম বাদ যান নি। তার কবিতায় মহাশ্মশানের পরিবর্তে গোরসত্মান ব্যবহার করা হয়েছে।
আবুল মনসুর আহমদের মতো সাংবাদিক-সাহিত্যিকও এই প্রচেষ্টায় জড়িত হয়েছেন। হিন্দু বাংলা ভাষা থেকে মুসলমানী বাংলা ভাষার প্রচলন করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু এই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। পাকিসত্মান সরকার এ দেশে রবীন্দ্রনাথকে বর্জন করার চেষ্টা করেছে। রেডিও-টেলিভিশন থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীত বাদ দেয়া হয়েছে। দেশব্যাপী প্রবল প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের মুখে সরকারের চেষ্টা পরিত্যক্ত হয়েছে। বাঙালী রবীন্দ্রনাথ ও নজরম্নলকে ভাগ করতে দেয়নি। জাতীয় জীবনে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বাঙালী অনেক সংগ্রাম করেছে। আজ স্বাধীন দেশে বাংলাভাষার শ্রীবৃদ্ধি সাধনই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

লেখক : ভাষাসৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও সাবেক সচিব

No comments

Powered by Blogger.