বিশ্বজিৎদের রক্তে ভেসে যাবে গণতন্ত্র! by অরণ্য ইমতিয়াজ

যদি বিশ্বজিতের পরিবারকে জিজ্ঞেস করা হয়Ñ স্বাধীনতা কাকে বলে কিংবা গণতন্ত্রের সংজ্ঞা কী? তা হলে কি উত্তর পাওয়া যাবে? এরা কেউ কি বলবেÑ গণতন্ত্র মানে সবার সম-অধিকার।
স্বাধীনতা মানে স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা। এরা যদি বলে, গণতন্ত্র মানে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া। তার প্রতিবাদ করার সাহস বা শক্তি এখন আমরা ক’জন দেখাতে পারব? উ™ভূত পরিস্থিতি কি গণতন্ত্রকে ক্রমেই গোরস্তান-শ্মশানের দিকে নিয়ে যাচ্ছে না? আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলেÑ সরকারের গোঁয়ার্তুমি পরিস্থিতিকে ওই দিকে ঠেলে দিচ্ছে। স্বাধীনতার পক্ষ বা বিপক্ষ কোনো শক্তির হয়ে বিশ্বজিৎ সেদিন মাঠে নামেনিন। তার পরও তাকে প্রাণ দিতে হয়েছে। মজার ব্যাপার হলোÑ যারা স্বাধীনতার পক্ষের বলে গলা ফাটান তাদেরই উত্তরসূরিরা এই প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। ভবিষ্যতে অন্য পক্ষের কী চমক যে অপেক্ষা করছে!

অন্যকে কোনোভাবে ভালো অবস্থানে থাকতে দেয়া যাবে না এবং কাউকে ভালো অবস্থানে আসেতও দেয়া যাবে নাÑ বিষয়টি এমন। এরই প্রতিযোগিতা চলছে দেশজুড়ে। অথচ এতে নিজেও যে ভালো থাকা যাবে না এবং ‘ভালো না থাকা’ নিজেকে একদিন আক্রমণ করবেইÑ এ উপলব্ধি এখন কারো মনেই জাগ্রত হচ্ছে না। আমরা বোধশক্তি হারাতে বসেছি। জটিলতা আর সমস্যা যত এখানেই।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, বিশ্বজিতের ওপর হামলাকারীরা ছাত্রলীগের কেউ না। যদি থেকেও থাকে তাহলে এরা বহিষ্কৃত। তাও ভালো তিনি বলেননিÑ শিবিরের লোকজন ছাত্রলীগে ঢুকে এসব করেছে। শিবিরের লোকজন হামলাকারীদের মতো মুখোশ পরে এটা করেছে সরকারকে বিব্রত করতে। এটা জামায়াতের ষড়যন্ত্র! আশ্চর্য হবো না, যদি সরকারদলীয় কেউ, বিশেষ করে মহীউদ্দীন সাহেব, কামরুল সাহেব অথবা হানিফ সাহেবেরা এসব ষড়যন্ত্রের কথা বলেন। তারা পারেনও। কত মোজেজাই যে তাদের চোখে-মুখে! অনেক অলৌকিক বিষয় তাদের চোখে ধরা পড়ে। এ নিয়েই ব্যস্ত তাদের চোখ। ছাত্রলীগ বা যুবলীগের সোনার ছেলেদের ‘দুষ্টুমি’ দেখার সময় কোথায়? শিশু ছেলে চঞ্চলÑ দুষ্টুমি তো করবেই। তারা ‘খেলনা’ (অস্ত্র যেন তাদের কাছে খেলনার মতোই) নিয়ে খেলার সময় বিশ্বজিতের মতো ছেলেদের (যারা খেলতে পারে না) খেলার মাঠে আসতে বলে কে?

৯ ডিসেম্বর বিশ্বজিৎ হত্যার কিছুক্ষণ আগে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে হামলাকারীরা মিছিল করেছে। একই দিন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের হরতালবিরোধী মিছিল করা হয়। সেখানেও হামলাকারীদের কয়েকজন ছিল। সংবাদপত্রে সে ছবিসহ তাদের পরিচয় ছাপা হয়েছে। তার পরও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, খুনিরা ছাত্রলীগের সাথে জড়িত নয়।

বিশ্বজিৎ হত্যার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বজ্রকণ্ঠ শোনা যায়নি খুনিদের গ্রেফতারের ব্যাপারে। তিনি মোলায়েম সুরে বলেছেনÑ যদি কেউ দোষী হয় তাহলে তার বিচার হবে। জামায়াত-শিবিরের বেলায় তিনি বাঘের গর্জন তোলেনÑ ‘কোনো অবস্থায়ই তাদের ছাড় দেয়া হবে না। তাদের দমন করতেই হবে।’ তাদের ধরতে চিরুনি অভিযান, সাঁড়াশি অভিযান চালানো হয়। প্রয়োজনে মাটি খুঁড়ে, সাগরের তলদেশ থেকে তুলে আনার মতো দৃঢ় ঘোষণা দেয়া হয়। যদি তাকে বা তাদের পাওয়া না যায় তাহলে তাদের নেতা কিংবা পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন, সম্ভব হলে চৌদ্দ গোষ্ঠী তুলে আনার চেষ্টা চলে। কারণ এরা পরের ছেলে। পরের ছেলের বিচার করা সহজ। আর ছাত্রলীগের বেলা ‘বাঘ বেড়াল হয়ে যায়’Ñ যদি কেউ দোষী হয়…।

বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে দেখানো হয়েছে কারা, কিভাবে বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে, রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছে। তার পরও আগে তাদের খুঁজে বের করতে হবে। আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ সাফ জানিয়েছেন, বিশ্বজিৎ হত্যার দায় আওয়ামী লীগ নেবে না। জামায়াত-শিবিরের দায়িত্ব আপনারা বিএনপিকে নিতে বলেন। আপনাদের অভিযোগÑ বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশে জামায়াত-শিবির সহিংসতা ঘটায়। যদি এটা সত্যি হয় তাহলে ছাত্রলীগের দায়িত্বও অবশ্যই আপনাদের। জামায়াত-শিবির বিএনপির অঙ্গ সংগঠন নয়; কিন্তু ছাত্রলীগ, যুবলীগ আপনাদের সরাসরি সহযোগী সংগঠন। তাদের দায়িত্ব আওয়ামী লীগের ওপর আরো বেশি। যদি বলা হয় বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড আপনাদের নির্দেশে হয়েছে। বিএনপিসহ ১৮ দলের ডাকা হরতাল, অবরোধে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগকে মাঠে প্রস্তুত থাকতে বলেছিল কারা? কেন প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছিলÑ ‘গণতান্ত্রিক হত্যাকাণ্ডের’ জন্য? বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্র হাতে, পিস্তল হাতে কারা ছিল? পত্রিকার পাতায় কাদের ছবি ছাপা হয়েছে? তাদের কয়জন গ্রেফতার হয়েছে? তাদের বিরুদ্ধে কয়টি মামলা হয়েছে? অথচ বিএনপির শত শত নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, গ্রেফতার হয়েছে।

আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের নেতারা নিজেদের বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক বলে দাবি করেন। নিঃসন্দেহে বলা যায়Ñ তাদের এই দাবি নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য। তারা সত্যিকার অর্থে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মানেন নাÑ লালন করেন না। তাদের আদর্শ হচ্ছে কিভাবে বিরোধী দলকে কোণঠাসা করতে হামলা-মামলা করা যায় এবং শেষ পর্যন্ত বিশ্বজিৎদের কিভাবে কতল করতে হয়। বিশ্বজিতের পরিবার এ সফলতার সাক্ষী। সংবাদপত্রে প্রকাশিত ছবিগুলো এর প্রমাণ।

আওয়ামী লীগের অভিযোগ, যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে বিএনপি ১৮ দল নিয়ে এ খেলায় মেতেছে, যার প্রধান শক্তি জামায়াত। যুদ্ধাপরাধীর তকমা কি জামায়াতের গায়ে ১৯৯৫ সালের আগে লেগেছে, না পরে? স্বাধীনতাযুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকা ছিল জামায়াতের। এই জামায়াত বিজয়ের মাসে বিএনপির সাথে আন্দোলনে যোগ দেয়ায় এবং হরতাল ডাকায় ুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে এমপি, মন্ত্রী ও দলীয় নেতারা। ৯ ডিসেম্বর ছিল বেগম রোকেয়া দিবস। এ দিন অবরোধ কর্মসূচি দেয় ১৮ দল। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই কর্মসূচির মাধ্যমে বিরোধী দল উপমহাদেশের নারী জাগরণের অগ্রদূতের প্রতি চরম অশ্রদ্ধা ও অবজ্ঞা প্রকাশ করেছে। এ জন্য দেশবাসীকে বিএনপির প্রতি ধিক্কার জানানোর আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। কথায় বলে হাসতেও হাসি পায়; এ লজ্জা রাখি কোথায়? ১৯৯৫ সালের এই দিনেই জামায়াতকে সাথে নিয়ে ৭২ ঘণ্টার হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছিল আওয়ামী লীগ। সেদিনও ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া দিবস ছিল। সেদিন ওই কর্মসূচি দিয়ে বেগম রোকেয়ার প্রতি কোন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানিয়েছিল আওয়ামী লীগ? এখন জামায়াত যুদ্ধাপরাধী-স্বাধীনতাবিরোধী। ১৯৯৫ সালে তারা কি সুফি ছিল? আওয়ামী লীগের সাথে থাকলে যুদ্ধাপরাধও কোনো সমস্যা বা দোষ নয়। তাদের ছাড়লেই অপরাধÑ যত দোষ নন্দ ঘোষ। জামায়াত আওয়ামী লীগের সাথে থাকলে দেশপ্রেমিক, বিএনপির সাথে গেলে যুদ্ধাপরাধী।

যে যা-ই বলি না কেনÑ যতই তর্কবিতর্কের ঝড় উঠুক; আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতসহ কোনো দলেরই আদর্শ যদি মানবপ্রেম না হয় তাহলে দেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করবে না। দলের নেতাদের বুকে ধারণ করতে হবে দেশপ্রেম। তবেই যদি দেশ সামনে এগিয়ে যায়।

লেখক : সাংবাদিক, টাঙ্গাইল

No comments

Powered by Blogger.