পাকিস্তানের বিভক্তিঃ আবার ’৭১-এর পথে by ডক্টর আবদুল কাদির খান

বিশ্বের প্রতিটি জাতিই বিভিন্ন সময়ে সুদিন ও দুর্দিনের সম্মুখীন হয়ে থাকে। জনসাধারণ সুখস্মৃতিময় দিনগুলো উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে উদযাপন করে এবং দুঃখস্মৃতি ও কলঙ্কময় ঘটনাগুলোকে সতরঞ্চি বা কার্পেটের নিচে লুকিয়ে রেখে ভুলে যেতে চায়।
সমঝদার জাতিগুলো সুখস্মৃতিময় দিনগুলো ঢাকঢোল পিটিয়ে উদযাপন করে জাতিকে উদ্বুদ্ধ এবং তাদের মধ্যে উৎসাহ, উদ্দীপনা ও সাহস সঞ্চার করতে, সেই সাথে তাদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির প্রয়াস পায়। দুর্দিনগুলোর কথা স্মরণ করে তারা তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে এবং এসব ভুল ও কলঙ্কের যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে ব্যাপারে সচেষ্ট হয়। দুর্ভাগ্যক্রমে, মুসলমানদের ইতিহাস এমন সব ঘটনায় ভরপুর, শাসকমহল ক্ষমতার মত্ততা ও আরাম-আয়েশের উন্মাদনায় যেসব ধ্বংসাত্মক ঘটনা ভুলে গেছে। সেগুলো তাদের পূর্বসূরিদের ধ্বংসের হেতু হয়েছিল। আপনাদের সম্মুখে বনু উমাইয়া, আব্বাসি খিলাফত, খাওয়ারিজমশাহি সালতানাত, মঙ্গোলীয় সাম্রাজ্য, মোগল সাম্রাজ্য, উসমানীয় খিলাফত এবং স্পেনে মুসলমান রাজত্বের পতনের মতো উদাহরণগুলো রয়েছে। খ্রিষ্টান রাষ্ট্রগুলোও এসব অপ্রীতিকর অবস্থা অতিক্রম করেছে। নেপোলিয়নের রাশিয়ার বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক অভিযান এবং তার ধ্বংসলীলার কথা খেয়াল না করেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে হিটলার রাশিয়ায় আক্রমণ চালিয়ে সে নিজের ধ্বংসবীজই বপন করেছিল। হিটলার যদি রাশিয়ার ওপর হামলা না করত, তাহলে যুদ্ধের ফলাফল ভিন্ন হতো। কিন্তু আল্লাহ যখন কাউকে ধ্বংস করতে চান, তখন তার অত্যাচার অনাচারের দরুন প্রথমে তার বিবেকবুদ্ধি কেড়ে নেন। তারপর তাকে ধ্বংস করে দেন।

আমরা এখনো আমাদের স্বদেশের ওপর দিয়ে ঘটে যাওয়া ধ্বংসাত্মক ঘটনাবলি থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করতে পারিনি। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের লজ্জাকর ও অপমানজনক ঘটনা আমাদের সম্মুখে রয়েছে। লাখ লাখ নয়, কোটি কোটি লোক পাকিস্তান ভেঙে যাওয়া ও তার কারণগুলো সম্পর্কে অবহিত। কিন্তু হাবভাবে মনে হয়, আমাদের শাসকমহল ও সামরিক নেতৃত্ব যেন, সে অপমানজনক ঘটনাটির কথা জানেনই না! অথবা তারা তা ইচ্ছাকৃতভাবেই ভুলে গেছেন! এটা কত বড় একটা ট্র্যাজেডি ছিল যে, একটি রাষ্ট্র ভেঙে গেল। হাজার হাজার লোক নিহত হলেন; নারীরা সম্ভ্রম হারালেন; ৯২ হাজার সৈন্য বন্দী হলো; তাদের পরম অপমান করা হলো। এসব দৃশ্য পাকিস্তানে দেখানো হয়নি বটে, কিন্তু পাশ্চাত্যের দেশগুলোয় বিস্তারিতভাবে দেখানো হয়েছে। আর এটা আমার জীবনের প্রথম ঘটনা যে, আমি সেদিন অঝোরে কেঁদেছিলাম। এত বড় একটা সঙ্গিন ঘটনা ঘটে গেল; কিন্তু এর জন্য কাউকে দায়ী করা হলো না! ভুট্টো সাহেব জাস্টিস হামুদুর রহমানের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করেন। উদ্দেশ্য ছিল কমিশন ওই অপমানজনক ট্র্যাজেডির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করবে। কমিশনের রিপোর্ট যথারীতি তৈরিও হল। দুই তিনটি ছোটখাটো ব্যাপার বিভিন্ন সূত্রের বরাতে পত্রপত্রিকায় আসতেও থাকে। কিন্তু সে কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করে জনগণকে ঘটনাবলির বিস্তারিত বিবরণ অবহিত করার সৎসাহস ভুট্টো সাহেবের ছিল না। প্রায় ৩০ বছর পর রিপোর্টটি ভারতে প্রকাশিত হয় এবং সে সূত্রের বরাতে পরে প্রকাশিত হয় আমাদের পত্রপত্রিকায়। জাস্টিস হামুদুর রহমান যাদের সেই অপমানজনক ট্র্যাজেডির জন্যে দায়ী ও অপরাধী সাব্যস্ত করেন, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই গৃহীত হয়নি। ইয়াহিয়া খানকে জাতীয় পতাকা ও তোপধ্বনির সালাম দিয়ে সমাহিত করা হয়। অবশিষ্ট দায়ী ব্যক্তিরাও রাষ্ট্রীয় উচ্চপদগুলোয় সমাসীন থেকে বেশ ফুর্তিতেই জীবন যাপন করেছেন। ওই রিপোর্টে কয়েকজন সামরিক বীর পুঙ্গবের স্বরূপও উদঘাটন করা হয়েছিলÑ যারা পরে বুক ফুলিয়ে সদর্পে আমাদের শাসনও করেছেন।

আমাদের সবারই জানা আছে, ১৯৭১ সালের মার্চে জেনারেল ইয়াহিয়া খান জেনারেল টিক্কা খানকে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে আর্মি অ্যাকশন করিয়েছিলেন এবং নিজেদের সেনাবাহিনীকে নিজেদেরই নাগরিকদের ওপর, নিজেদের ভাইবোনদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে মুক্তভাবে লেলিয়ে দিয়েছিলেন। এটা মানবিক মনস্তত্ত্বের একটা দিক যে, যখনই তার হাতে ক্ষমতা আসে, তখন বাহ্যত যাদের নম্র থেকে নম্রতর মনে হয় এমন ব্যক্তিরাও অত্যাচার-উৎপীড়নের সুযোগটা হাতছাড়া করে না। বরং আস্তে আস্তে সে মাত্রা বাড়াতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানে তা-ই হয়েছিল। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর উঁচু পদধারীরা ইচ্ছেমতো সেখানে অত্যাচার-উৎপীড়ন চালিয়ে গেছে। এ সব কিছু পাশ্চাত্যের মাধ্যমগুলো প্রচার করে তাদের জনগণকে অবহিত করে চলেছিল। এসব ব্যাপার দেখে দেখে লজ্জায় আমরা মরে যাচ্ছিলাম যে, মুসলিম বলে নিজেদের পরিচয় দিয়েও আমরা এহেন হীন তৎপরতায় লিপ্ত ছিলাম! পাকিস্তানি মাত্রই জানেন, পূর্ব পাকিস্তানবাসীর সাথে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের আচরণ ছিল বৈষম্যমূলক। তাদেরকে জনসংখ্যা ও শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুসারে প্রতিনিধিত্ব দেয়া হচ্ছিল না। তাদের ছোট মনে করা হতো। পশ্চিম পাকিস্তানি যেসব আমলা-অফিসার পূর্ব পাকিস্তানে নিয়োগ পেতেন, তাদের আচরণ ঠিক ওইরূপ ছিল যেমনটি ছিল পরাধীন ভারতবাসীর প্রতি ইংরেজ আমলাদের আচরণ। টিক্কা খান যখন পূর্ব পাকিস্তানে আর্মি অ্যাকশন চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন আমাদের শ্রদ্ধেয় বন্ধু মরহুম হাবীব জালিব তার কবিতায় এভাবে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন : মুহাব্বত গুলিয়োঁ ছে বু রাহে হো/ ওয়াতান কা চেহারা খুন ছে ধু রাহে হো

গুমাঁ তুমকো রাস্তা কাট রাহা হ্যায়/ য়াকিন মুঝকো ক্যা মঞ্জিল খু রাহে হো।

অর্থাৎ প্রেম বপন করছিস তোরা গুলি দিয়ে/স্বদেশে চেহারা ধোও রক্ত দিয়ে। ভাবছিস বুঝি, রাস্তা তোদের যাচ্ছে কেটে/ নিশ্চিত রও, মঞ্জিল থেকে যাচ্ছ দূরে।

ইসলামের ইতিহাসে এমন ঘটনার অভাব নেই যে, আত্মকলহে ও হানাহানিতে এ জাতি ধ্বংস হয়েছে। বনু উমাইয়া, আব্বাসী খিলাফত, খাওয়ারিজমশাহি সালতানাত, তৈমুর ও সুলতান বায়েজিদ ইয়ালদরমের মধ্যকার যুদ্ধগুলো এবং সর্বশেষ আরব ও তুির্কদের যুদ্ধে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর ভিত্তিমূল নড়বড়ে হয়ে যায়। ভারতবর্ষেও সে ধারা চলে। আওরঙ্গজেব ও তার ভাইদের মধ্যকার যুদ্ধবিগ্রহ রাষ্ট্রের ভিত্তি ধসিয়ে দেয় এবং তার মৃত্যুর পর এত বিশাল একটি সাম্রাজ্য খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যায়। সুগম হয়ে যায় ইংরেজদের অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ। প্রথমে বাংলায় নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন ঘটে। তারপর মহীশুরে টিপু সুলতানের রাজত্বের ঘটে অবসান। উভয় ক্ষেত্রেই তাদের মুসলমান সঙ্গীসাথীরাই চরম ন্যক্কারজনক ভূমিকা পালন করেছিল। এ মুহূর্তে দেশে যে ভয়াবহ নাজুক অবস্থা চলছে, তা অতীতের সেই ভয়াবহ দিনগুলোর চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়, যা ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে বিরাজমান ছিল। এ সময়েও শাসকমহল ও সামরিক নেতৃত্ব এ ভুলে নিমগ্ন রয়েছেন যে তারা দেশের শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়ছেন এবং শিগগিরই তাদের দমন করে তারা দেশকে সন্ত্রাসমুক্ত করে ফেলবেন। বর্তমান সময় এ উভয় কর্তৃপক্ষই ‘শাহ’-এর প্রতি অধিকতর বিশ্বস্ততার প্রমাণ দেয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। তারা নিজেদেরই লোকদের বিরুদ্ধে লড়াই করাকে জিহাদ মনে করছেনÑ যা এক বিবেকবিক্রেতা স্বৈরশাসক নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থে শুরু করেছিল! এটা হচ্ছে মার্কিনিদের যুদ্ধ, যা আমরা তাদের থেকে ডলার নিয়ে ভাড়াটে সৈন্যদের মতো চালিয়ে যাচ্ছি এবং নিজেদের লোকদেরকে নিজেরা হত্যা করে চলেছি!

আমাদের শাসকমহল ও সামরিক নেতৃত্ব এ কথাটি ভুলে যাচ্ছেন যে, তাদের বর্তমান প্রতিপক্ষ বাঙালিদের মতো নম্র মেজাজ ও শান্তিপ্রিয় নন। এরা তাদের বীরত্ব, সামরিক প্রতিভা ও দুর্ধর্ষতার জন্য বিশ্ববিখ্যাত। তারা নিজেদের অস্ত্র নিজেরাই বানায় এবং এসব অস্ত্রের মানও খুব উন্নত। এরা আমাদের জাতীয় সংহতিকে চুরমার করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। রাষ্ট্র ও সামরিক কর্তৃপক্ষ মার্কিনিদের অকার্যকর অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য গ্রহণ করে এ যুদ্ধে জড়িয়ে রয়েছে। অথচ যারা নিহত হচ্ছে সেই বেচারারা নেহাত সাধারণ নাগরিক ও আম সেপাইÑযাদের নিহত হওয়ার পর কয়েকটি প্রশংসাবাক্য উচ্চারণ করা হয়ে থাকে। তাদের পরিবারবর্গকে নামমাত্র যে অর্থসাহায্য দেয়া হয়ে থাকে তা এতই অপ্রতুল যে, না তাতে পৌণে এক কামরার একটা ঘর বানানো যায় আর না তা ব্যাংকে সঞ্চিত রেখে পরিবারবর্গের ভরণপোষণ করা চলে।

এখন অবস্থা ১৯৭১ এর চেয়েও ভয়াবহ। অর্থনৈতিকভাবে আমরা ধ্বংস হয়ে গেছি। সব ধরনের সামাজিক ব্যাধি শিরায় শিরায় সংক্রামিত হয়ে গেছে। ঘুষ, খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল, প্রতারণা, মিথ্যাকথন প্রভৃতি এখন সরকারি ও জাতীয় নীতিতে পরিণত হয়েছে। আমরা যদি শিগগিরই আমাদের অবস্থা শোধরাতে না পারি, তা হলে একাত্তরের মতো ঘটনাবলি আর খুব দূরে নয়। যত তাড়াতাড়ি আমরা বিদেশীদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন ছেড়ে দেব, ততই মঙ্গল। বাংলাদেশের ঘটনাবলিকে যদি সঠিকভাবে অনুধাবন করতে চান, তাহলে আহমদ ফারাজের বাংলাদেশ (ঢাকা মিউজিয়াম দেখে) একবার পড়ে নিন! গোটা জাতির মনোভাব ও আবেগ তাতে প্রতিফলিত হয়েছে।

দৈনিক জঙ্গ, করাচি ১৭ ডিসেম্বর, ২০১২

অনুবাদ : আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী আলআযহারী

No comments

Powered by Blogger.