জামায়াত রাজনীতি নিষিদ্ধ দাবি- সেদিন বিএনপি এমপিরা সংসদে ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন by নাজনীন আখতার

 সাড়ে ষোলো বছর আগে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বধীন বিরোধী দলের মুলতবি প্রস্তাবের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে জামায়াত শিবিরের বিরুদ্ধে বিএনপির সংসদ সদস্যরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন ।
মসজিদের ইমামতি নিয়ে তর্ক-বির্তেকর সামান্য ঘটনায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মধ্যরাতে শিবিরের তাণ্ডব ও নৃশংসভাবে ছাত্র হত্যার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে একই ভাষায় বক্তব্য দেন শাসক বিএনপির সংসদ সদস্যরা। ১৯৯৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর সংসদে দাঁড়িয়ে তাদের দাবি ছিল-ধর্মের নামে বাণিজ্য করা দলটিকে আর বাড়তে দেয়া যায় না। দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। দেশের সেনাবাহিনীতে যেন কোনভাবে এ দলের অনুসারী ঢুকে রাষ্ট্রৰমতা দখলের সুযোগ না পায় সেজন্য নাগরিক সনদের পাশাপাশি বিশেষ সনদ চালুরও দাবি জানান বিএনপির সংসদ সদস্যরা।
সেদিন এ ঘটনা নিয়ে বিরোধী দল ৩৩টি মুলতবি প্রসত্মাবের নোটিস দেয়। সংসদের ইতিহাসে এক ঘটনায় এত বেশিসংখ্যক মুলতবি নোটিস দেয়ার ঘটনাও বিরল। মুলতবি প্রসত্মাব হিসেবে বিরোধী দল প্রিভিলেজ চাইলেও সরকারী দল আলোচনায় অংশ নেয়ার দাবি জানালে আলোচনা শুরম্ন হয় ৬২ ধারায়। সরকার ও বিরোধী দলের ক্রমাগত আক্রমণাত্মক বক্তব্যের এক পযর্ায়ে জামায়াত নেতা মতিউর নিজামীসহ দলের অন্য সংসদ সদস্যরা সংসদের বৈঠক ত্যাগ করেন।
বিরোধী দলের পৰে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম প্রসত্মাব তুলে ধরে বলেন "রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুমনত্ম ছাত্রদের ওপর নিশুতি রাতে জামায়াত-শিবিরের নারকীয় তা-বে নিহত জোবায়ের চৌধুরী রীমু হত্যাকা- এবং শতাধিক আহত ছাত্রদের আর্তনাদ বিষয়ক আলোচনা এবং দোষী ব্যক্তিদের শাসত্মি দেয়ার উদ্দেশ্যে আইনগত ব্যবস্থা অবলম্বনের স্বার্থে অবিলম্বে সংসদ মুলতবি করা হোক।'
প্রসত্মাব অনুযায়ী রাত ৮টা ৩ মিনিটে সংসদের বৈঠক মুলতবি হয়ে যায়। আলোচনা শুরম্ন হয় ৮টা ২০ মিনিটে।
আলোচনা শুরম্ন করে আওয়ামী লীগের অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ঘটনার বর্ণনা করে বলেন, গত ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রাজশাহী মেডিক্যাল ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মম হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে। একাত্তরের মতো জামায়াত আজ দেশকে মেধাশূন্য করতে চায়।
বিএনপির আবদুল আলী মৃধা বলেন, আজকে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি জামায়াত শিবির রাতের অন্ধকারে যে নারকীয় ঘটনা ঘটিয়েছে সমসত্ম জাতি তার জন্য উদ্বিগ্ন। আজকে এই রগ কাটার দল, গলা কাটার দল পাশের গ্রামে অস্ত্রের ট্রেনিং করে। আমাদের সনত্মান যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে তাদের লেখাপড়া শিখতে দিতে চাইছে না। তারা একাত্তরে পাকবাহিনীকে সহায়তা করে যেভাবে দেশের মানুষকে হরণ করেছিল, তা আবার ঘটাতে চাইছে। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দেশে যখন রাজনৈতিকভাবে উৎপাদন ও উন্নয়ন শুরম্ন হয়েছে তখন বাংলাদেশকে একটি ধ্বংসসত্মূপে পরিণত করতে উদ্যোগ নিয়েছে জামায়াত-শিবির চক্র।
তৎকালীন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য বর্তমানে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মেজর (অব) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বলেন, জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি একটি প্রগতিবিরোধী রাজনীতি। এদেশে তারা সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে আসছে। দিনের পর দিন প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা ছাত্রদের রগ কেটে অমানুষিক অত্যাচার করে হত্যা করছে। আজকে আমরা জানতে চাই, তাদের শক্তির উৎস কোথায়? দু'চারজন বাদে এ সংসদের প্রতিটি সদস্য, ট্রেজারি বেঞ্চের সদস্যরাও এ হত্যাকা-ের বিচার চায়।
সংসদের হুইপ আশরাফ হোসেন বিরোধী দলকে কটাৰ করে বলেন, একযোগে শানত্মি প্রতিষ্ঠায় যে সহায়তা করার কথা ছিল তাদের তা করেননি। জামায়াতে ইসলামী তার ছাত্র সংগঠনের নামে যে নারকীয় হত্যাকা- ঘটিয়ে চলেছে তা রোধে সহায়তা না করে অনেকে অবস্থাকে সঙ্কটময় করার কাজে লিপ্ত ছিলেন।
তবে এর জবাবে পাল্টা আক্রমণ করে জাতীয় পার্টির আবু লেইছ মোঃ মুবিন চৌধুরী বলেন, আজকে প্রশ্ন উঠছে সন্ত্রাস বন্ধের ব্যাপারে সরকারের কতটুকু আনত্মরিকতা ছিল। আজকে তাদের নিজেদের ঘরে আগুন লেগেছে। জামায়াত-শিবিরের হাতে তাদের ঘরের ছেলেরা মার খাচ্ছে বলে তাদের মুখে জামায়াত-শিবিরের বিরম্নদ্ধে খই ফুটছে। যাদের সাহায্যে সরকার গঠন করেছেন তাদের বিরম্নদ্ধে আজ বাধ্য হয়ে কথা বলছেন।
বিএনপির আরেক সংসদ সদস্য শাজাহান ওমর জামায়াতের প্রতি বিষোদগার করে বলেন, আজকে আশ্চর্যের সঙ্গে দেখলাম যে, এ প্রসত্মাব আনার সঙ্গে সঙ্গে মাননীয় সদস্য নিজামী সাহেবও দাঁড়িয়েছেন। তার মানে তিনি নিশ্চয় স্বীকার করছেন না যে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এ নারকীয় হত্যাকান্ড তাদের ছাত্র শিবির করেছে। এ অপকর্ম যদি শিবির না করে থাকে তাহলে তিনি যেন দাঁড়িয়ে বলেন যে ওরা ছাত্র শিবির নয়। তিনি বলেন যে, ওই ছাত্রদের ছাত্রশিবির হিসেবে গ্রহণ করি না। তাঁর যদি সাহস থাকে, মনে বল থাকে, তিনি কথা এই এখানে বলুন।
জাসদের সংসদ সদস্য পরে বিএনপিতে যোগদানকারী শাজাহান সিরাজ বলেন, আজ আমরা আর একটি মুহূর্তও দেশকে এভাবে চলতে দিতে পারি না। ছাত্রদলের নেতৃত্বে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমসত্ম ছাত্র আজ এক হয়েছে। জামায়াত-শিবির ছাড়া সমসত্ম রাজনৈতিক দল এক হয়েছে।
সংরৰিত নারী আসনের বিএনপির সংসদ সদস্য ফরিদা রহমান জামায়াত শিবিরের কর্মসূচী সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে বলেন, ২২ বছরের রীমুকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে। আমরা জানতাম, মানুষ গরম্ন ছাগল জবাই করে। এখন জামায়াত শিবির নামক একটি দল মানুষ জবাই করতে শুরম্ন করেছে। আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ করব তিনি যেন ঠা-া মাথায় ধীরস্থিরভাবে এ সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তাহলে আমরা খুশি হব, জনগণ খুশি হবে এবং দেশে একটি নিরাপত্তা আসবে।
বিএনপির আবু ইউসুফ মোঃ খলিলুর রহমান বলেন, আজ এ সংসদে জামায়াতে ইসলামীর যেসব সংসদ সদস্য বন্ধুরা আছেন তাদের বিবেককে একটু জিজ্ঞাসা করতে চাই_ ধরো, ধরো বিএনপি ধরো, জবাই করো, এ সেস্নাগানটি ইসলামিক না অনৈসলামিক? মধ্যরাতে রাজশাহী বিশ্ববিদালয়ের দুই শ' কামরায় অগি্ন সংযোগ করল, লুটপাট করল, এগুলো কি ইসলামিক না অনৈসলামিক? আমি জিজ্ঞাসা করতে চাই, ঘুমনত্ম অবস্থায় নিরীহ ছাত্রদের এক এক করে রগ কেটে দেয়া কি ইসলামিক না অনৈসলামিক? আপনাদের বিবেককে প্রশ্ন করম্নন বিভিন্ন পযর্ায়ে ট্রেনিং দিয়ে, ক্যাডার তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছেড়ে দিয়েছেন এটা কি মানবতার বিরোধী না মানবতার পৰে? তিনি বলেন, শিবির বহু মায়ের কোল খালি করে দিয়েছে। এ হাউসে আজ যে ঐকমত্যের সৃষ্টি হয়েছে সেই ঐকমত্যের দিকে লৰ্য রেখে অনতিবিলম্বে এ বিষয়ে একটি সিদ্ধানত্ম গ্রহণ করা হোক।
বিএনপির সংসদ সদস্য আলমগীর কবির ধর্ম নিয়ে রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানান। তিনি বলেন, প্রয়োজনে এ মহান সংসদে বিল আনতে হবে। জামায়াত-শিবিরের নারকীয় হত্যাকা- শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নয়, সমগ্র রাজশাহীর আকাশ-বাতাস মোথিত হয়ে উঠছে। আমি থুথু নিৰেপ করে জামায়াতের সমালোচনা করব না। আমি গণতন্ত্রের ভাষায় ঘৃণা প্রকাশ করব, নিন্দা জানাব এবং আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের দিকে লৰ্য রেখে জামায়াতকে নিন্দা জানাব।
বিএনপির মেজর (অব) আখতারম্নজ্জামান বলেন, আমি বিরোধী দলের বন্ধুদের বলব, স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী চক্রকে রাজনীতিসহ সব জায়গায় নিষিদ্ধ করে প্রসত্মাব আনেন। আপনাদের ভোট দিতে হলে দলের সিদ্ধানত্মের বাইরে গিয়ে হলেও আপনাদের ভোট দেব। আসুন আমরা আজ তাদের সঙ্গে আর এক কৰে না বসার অঙ্গীকার করি।
বিএনপির সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমি আজকে প্রসত্মাব করতে চাই সামরিক বাহিনী, বিডিআর, পুলিশ, এনএস, আইডিএফআইসহ সকল বাহিনীতে নাগরিক সনদের পাশাপাশি আরও একটি সনদ যোগ করতে হবে। জামায়াত-শিবিরের কোন সদস্য এ বাহিনীতে যোগ দিতে পারবে না। তা না হলে বিশ বছর পর তারা এ বাহিনী দখল করে আবার এদেশের ৰমতা দখল করবে। একাত্তরে তারা যেভাবে এদেশের মানুষকে হত্যা করেছিল। সেই একই কায়দায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নেতাশূন্য করতে ঘুমনত্ম ছাত্রদের ওপর আক্রমণ করেছিল।
বিএনপির সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট খায়রম্নল এনাম জামায়াতকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে বলেন, জামায়াতের উদ্দেশ্য কি? কি কারণে তারা নিরীহ সাধারণ মানুষ বিশেষ করে ছাত্র সমাজের ওপর তা-বলীলা চালাচ্ছে?
বিরোধী দলের প্রতি আহবান জানিয়ে বিএনপির জিয়াউল হক বলেন, বিরোধী দলের বন্ধুদের বলতে চাই, আমাদেরকে জোর করে অপশক্তির সঙ্গে হাত মেলাতে বলবেন না। স্বাধীনতার স্বার্থে রাজনৈতিক স্বার্থে আপনাদের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করি। আমাদেরকে জোর করে জামায়াতের সঙ্গে ঠেলে দেবেন না।
হুইপ শাজাহান মিয়া বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে জামায়াত শিবির যে নারকীয় ঘটনা ঘটিয়েছে তা বর্ণনা করার ভাষা আমার জানা নেই। জামায়াত শিবির সীমা লঙ্ঘন করছে। তারা একাত্তরের নারকীয় ঘটনা আবার ঘটাতে চায়। আজ কোন গোষ্ঠীবিশেষ নয় আমাদের সবাইকে রাজনৈতিকভাবে সামাজিকভাবে এ জামায়াত শিবিরকে দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়ার সুযোগ এসেছে।
সব শেষে রাত সোয়া ১২ টায় সংসদ উপনেতা ডাঃ বদরম্নদোজ্জা চৌধুরী বলেন, উভয় তরফের বক্তব্য খুব কাছাকাছি ছিল। আমি দুঃখিত যে জামায়াতে ইসলামীর সদস্যরা এখানে নেই। তাদের এখানে থাকা উচিত ছিল এবং তাদের বক্তব্য কি ছিল সেটা জানতে পারলে আমাদের আরও সুবিধা হতো। আমরা তাদের বক্তব্য খ-ন করতে পারতাম। তিনি বলেন, ঘুমনত্ম ছাত্রদের ওপর রাজনৈতিক বিশ্বাসের অজুহাতে ধর্মকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করে যে বর্বর হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে তা পৈশাচিক। এটা ইসলাম ধর্মের মূলনীতির বিরম্নদ্ধে। সবচেয়ে বড় কথা বিবেকবিরোধী। এ হত্যাকা-ে সমসত্ম জাতি সত্মম্ভিত। রগ কাটা, হাত কাটা, জবাই করা এটা কি ধরনের রাজনীতি? স্বাধীন দেশে এটা চলতে দেয়া যায় না।
তিনি বলেন, জামায়ত শিবিরের রাজনীতি বন্ধের প্রসত্মাব সংবিধান দিয়ে ভাল করে পরীৰা করার অবকাশ আছে। জনগণের ইচ্ছার প্রতিধ্বনি করে সংসদ এ ব্যাপারে দৃঢ় ঘোষণা দেবে এবং সরকার দৃঢ় পদৰেপ নেবে।

No comments

Powered by Blogger.