সাধারণ মানুষের জন্য গণতন্ত্র- বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

যেখানেই খমতা সেখানেই প্রতিরোধ, কিন্তু প্রতিরোধের ধরন বিভিন্ন অধস্তনতা রাজনীতির প্র্যাকটিসে কাজ করে, আবার অধস্তনতা থেকে তৈরি হয় নির্যাতনের সম্পর্ক।
বাংলাদেশে যে ধরনের গণতন্ত্র কাজ করছে, সেখানে অধস্তনতা এবং নির্যাতন দুই-ই বিদ্যমান। সেজন্য গণতান্ত্রিক বিপস্নব সম্পূর্ণ হতে পারছে না। সমাজ হয়ে উঠেছে সত্মরবিন্যসত্ম ও অসম। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির উদ্ভাবন হচ্ছে না এবং গণতান্ত্রিক কার্যক্রম বৈধতা পাচ্ছে না। সবকিছু বন্দী করা হচ্ছে ৰমতার মধ্যে এবং ৰমতার অভিজ্ঞতা কিন্তু গণতন্ত্র না। যে রাজনীতি অধস্তনতা এবং নির্যাতন দূর করতে পারছে না কিংবা দূর করতে চাচ্ছে না, সেই রাজনীতি প্রবল হয়ে উঠছে এবং সেই রাজনীতি থেকে সাধারণ মানুষ দূরে সরে যাচ্ছে। বলতেই হবে সংসদীয় রাজনীতি বিভিন্ন ধরনের অধসত্মনতা এবং বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন আমলে নিচ্ছে না। তার ফলে সংসদীয় রাজনীতির মাধ্যমে সারাদেশে ইকুয়ালিটি এবং লিবার্টির কনসেপ্ট ছড়াচ্ছে না; আবার সংসদের বাইরের রাজনীতিতে ব্যক্তি বিশেষের সুযোগ-সুবিধার কথা উচ্চারিত হচ্ছে। এ সব তো গণতান্ত্রিক ডিসকোর্স নয়, অধসত্মনতা ও অসমতা ও নির্যাতনের বিভিন্ন ফর্মের বিরম্নদ্ধে লড়াই নয়। রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতির মধ্যে দিয়ে বাঙালী র্যাডিকালিজমের উৎসে পেঁৗছাতে পারছে না, তেমনি বিদ্যমান রাজনীতির মধ্যে দিয়ে র্যাডিকালিজম দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে পারছে না।
কিন্তু সমস্যা তৈরি হচ্ছে এবং সমস্যার সধমাধান গণতন্ত্রের মাধ্যমে হতে হবে। একুশে ফেব্রম্নয়ারির কোন এক অনুষ্ঠানে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য প্রধামন্ত্রীর সামনেই বললেন : আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা আর আমার মাতৃভাষা : গারো। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে প্রমোদ মানকিনের কথা সমর্থন করেছেন। বাংলাদেশের অভ্যনত্মরে বিভিন্ন ৰুদ্র জাতিসত্তা অসত্মিত, ভাষা, নিজস্ব রাজনৈতিক ব্যবস্থা, বাবেদী গণতন্ত্রের দিক থেকে মনে নিতে হয়। এই মেনে নেয়ার একদিকে আছে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভাষা, রাজনৈতিক ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, অন্যদিকে আছে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৰুদ্র জাতিসত্তা অবস্থান চিহ্নিত করা। প্রথমত দরকার : সাংবিধানিক রিফর্ম, দ্বিতীয় দরকার : ৰুদ্র জনগোষ্ঠীর সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি ভাষার দিক থেকে, জমির দিক থেকে, রাজনীতির দিক থেকে, অর্থনীতির দিক থেকে সম্পর্ক গড়ে তোলা। একটার পর একটা প্র্যাগমেটিক রিফর্ম তৈরি করা।
এৰেত্রেও সামষ্টিক অ্যাকশন কিভাবে তৈরি হচ্ছে ৰুদ্র জনগোষ্ঠী অনবরত লড়াই করে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভেতরে থেকে অসমতার বিরম্নদ্ধে এবং অধসত্মন সম্পর্ক চ্যালেঞ্চ করে। এই পর্যায়ে আমরা বলতে পারি যে, অধস্তনতা সম্পর্ক হয়ে ওঠে নির্যাতনের সম্পর্ক। এভাবেই উদ্ভূত হয় বৈরিতার অবস্থান। ৰুদ্র জাতিসত্তার অবস্থান এভাবেই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভেতরে চিহ্নিত হয়। এই চিহ্নিতকরণ, বলা যায়, জন্মদাগ, সহসা কিংবা সহজে মোছা যায় না।
তার প্রমাণ ২০ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ঘটনা। 'জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে ২০ ফেব্রুয়ারি শনিবার রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে বাঙালী ও পাহাড়িদের মধ্যে গোলাগুলি, অগি্নকা- ও ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ায় আদিবাসী নিহত হওয়ার ঘটনায় পার্বত্য জেলা রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি বিৰুব্ধ হয়ে উঠেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার রবিবার বাঘাইছড়ি গেলে আদিবাসীরা তাঁকে দফায় দফায় অবরোধ করে। তারা স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এএসএম হুমায়ুন কবীরকে লঞ্ছিত ও তাঁর সরকারী গাড়িটি ভাঙচুর করেছে। সেনাবাহিনী ও পুলিশের উপস্থিতিতেই এসব ঘটনা ঘটে। তিন পার্বত্য জেলা থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার, গুম হওয়া লাশ ফেরত, ৰতিপূরণ ও অবৈধ দখলে চলে যাওয়া জমি ফেরত দেয়ার দাবিতে আদিবাসীরা প্রতিমন্ত্রীর সামনে বিৰোভ করে। গতকাল লক্ষ্মী বিজয় চাকমা (৪০) নামে একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আগের দিন বুদ্ধ পত্তি চাকমা নামের এক আদিবাসী নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল। প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার বিশাল গাড়ি বহর নিয়ে গতকাল সকালে বাঘাইছড়ি এলাকায় আসেন। তিনি বেলা ১১টা ২০ মিনিটে বাঘাইছড়ি বটতলী এলাকায় এলে নয়াপাড়া গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা কয়েক শ' আদিবাসী নারী-পুরম্নষ তাঁকে ঘিরে ধরে ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবি করে। প্রতিমন্ত্রী তাদের সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করলে বিৰুব্ধ লোকজন 'পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করো, করতে হবে' বলে সেস্নাগান দিতে থাকে। গুলি ও আগুনের ঘটনার জন্য তারা নিজস্ব ভাষায় উপস্থিত সেনা কর্মকর্তাদের দোষারোপ করতে থাকে। (কালেরকণ্ঠ, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১০) এই পরিসরে র্যাডিক্যাল এবং বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক ধারণা কতদূর পর্যনত্ম গভীর করা যেতে পারে?
সেজন্য যে প্রশ্ন উঠে, তা হচ্ছে ইকোয়ালিটির দাবির যথেষ্ট নয়, সেই সঙ্গে দরকার লিবার্টির দাবিও। এই দুই একত্র হলে র্যাডিক্যাল ও পস্নুরাল গণতন্ত্রের কথা বলা যায়। বাঘাইছড়িতে যা ঘটেছে তা নেহাৎ সমতার অভাব কিংবা অনুপস্থিতি নয়, বরং তা লিবার্টির অভাব কিংবা অনুপস্থিতি। প্রতিটি গণতান্ত্রিক এবং ইমানসিক্যাটরি প্রজেক্টের মধ্যে লিবার্টি যদি না থাকে, তাহলে অধসত্মন জনগোষ্ঠী, নির্যাতিত হতে থাকবেই। এই পরিস্থিতিতে জাস্টিস হয় না। ৰুদ্র জনগোষ্ঠী গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় কিংবা ওই সব অধিকার সম্বন্ধে উদাসীন হয়ে ওঠে। মৌলিক রাজনৈতিক ও সিভিল অধিকারের অবদমনের ফলে 'সরকার' সর্বত্র দেখা দেয়া শুরম্ন করে। বাঘাইছড়িতে তাই ঘটেছে। আমলাতন্ত্র, সেনাবাহিনী এবং তাদের পিছনে বাঙালি সেটলার একত্রে কোণঠাসা করে রেখেছে ৰুদ্র জনগোষ্ঠীকে। এভাবে সাধারণ মানুষের জন্য গণতন্ত্র হয় না।

No comments

Powered by Blogger.