এবার জ্বলছে খাগড়াছড়ি- পাহাড়ী-বাঙালী ফের নারকীয় সংঘর্ষ নিহত ১ আহত অর্ধশতাধিক, ৭০ বাড়ি পুড়ে ছাই, শতাধিক যান ভাংচুর, সেনা মোতায়েন

 পাহাড়ী-বাঙালীর ভয়াবহ সংঘর্ষে এবার জ্বলছে পার্বত্য জেলা শহর খাগড়াছড়ি। চলছে নারকীয় তা-ব। পাহাড়ী ও বাঙালীরা সংঘবদ্ধ হয়ে একে অপরের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে।
চলছে সংঘর্ষ। রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলায় গত ১৯ ও ২০ ফেব্রম্নয়ারি সংঘটিত ঘটনার প্রতিবাদে স্থানীয় পাহাড়ী সংগঠন ইউপিডিএফ (ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট) মঙ্গলবার রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে সড়ক ও নৌপথ অবরোধ চলাকালে এ ঘটনার সূত্রপাত। শহর ও আশপাশ এলাকায় বিুব্ধ পাহাড়ী-বাঙালীদের নারকীয় তা-বে এক বাঙালী নিহত এবং সাংবাদিক ও গুলিবিদ্ধ দুই মহিলাসহ অর্ধ শতাধিক আহত হয়েছে। জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে ছাত্রাবাসসহ ৭০টি বসতবাড়ি, ভাংচুর করা হয়েছে বাস, ট্রাক, জীপ, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন ধরনের শতাধিক যানবাহন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শহর এলাকায় জারি করা হয়েছে অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা। মোতায়েন করা হয়েছে বিপুলসংখ্যক সেনা সদস্য। কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় রাত ৯টা থেকে আজ বুধবার সকাল ৭টা পর্যনত্ম কার্ফু জারি করা হয়েছে। রাত ৮টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যনত্ম বিপ্তিভাবে হামলা ও ঘরবাড়িতে আগুন লাগানোর ঘটনা চলছিল।
আকস্মিক এ ঘটনায় পুরো খাগড়াছড়ি শহর রীতিমতো মৃতু্যপুরীতে রূপ নিয়েছে। দোকানপাট, যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। ঘটনার পর থেকে যে যেখানে ছিল সেখানে আটকা পড়েছে। নিহতরা হলেন- আনোয়ারা হোসেন (২২) ও সেকান্দার মিস্ত্রি (৪৫)। আনোয়ার হোসেনকে পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা সাটভাইয়া এলাকায় প্রথমে গুলি ও পরে আগুনে নিপে করে হত্যা করে। সে খাগড়াছড়ি পৌরসভার কর্মচারী। এছাড়া সেকান্দার মিস্ত্রি নামে এক ব্যক্তি নিহত হওয়ার গুজব রয়েছে। প্রশাসন ও পুলিশ সূত্র সেকান্দার মিস্ত্রি সম্পর্কে কিছু নিশ্চিত করতে পরেনি। অবরোধের শুরম্নতে সকাল ১০টায় শহরের শাপলা চত্বর এলাকায় ইউপিডিএফের পিকেটাররা বাঙালীদের বিভিন্ন দোকানে হামলা ও ভাংচুর চালায়। তারা অবরোধে কেন দোকানপাট খুলেছে এ প্রশ্ন রেখে প্তি হয়ে দোকানদারদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। হামলার এ খবর দ্রম্নত ছড়িয়ে পড়লে শত শত বাঙালী রাসত্মায় নেমে আসে এবং প্রতিবাদ ও বিােভ প্রদর্শন শুরম্ন করে। উত্তেজিত জনতা মহাজনপাড়া এলাকায় আসলে মুখোমুখি হয় ইউপিডিএফ কর্মীদের। শুরম্ন হয় সংঘর্ষ। ইটপাটকেল নিেেপর পাশাপাশি পাহাড়ীদের প েফাঁকা গুলিবর্ষণ করা হয়। এতে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে। এভাবে শহরের মিলনপুর, কাদের টিলা, শালবাগান, কল্যাণপুর, স্বনির্ভর নারিকেলবাগান এলাকায় বিপ্তিভাবে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। সকাল ১১টা থেকে বিকেল ২টা পর্যনত্ম পাহাড়ী-বাঙালীদের বিপ্তি সংঘর্ষ চলতে থাকার পর শুরম্ন হয় অগি্নসংযোগ। পাহাড়ীরা বাঙালী এলাকায় এবং বাঙালীরা পাহাড়ী অধু্যষিত এলাকায় আগুন দিয়ে বসতবাড়ি, দোকানপাট জ্বালিয়ে দিতে শুরম্ন করে। এতে মহাজনপাড়া এলাকায় ১২টি ঘর, সরকারী হাইস্কুলের ৩টি আবাসিক ভবন, মিলনপুরের ৩টি, কাদের টিলা ও আশপাশ এলাকার ৩০টি ও শানত্মিনিকেতন ভবনসহ ৭০টি ঘরবাড়ি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এতে য়তির পরিমাণ কয়েক কোটি টাকা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিােভকারীদের প্রতিরোধের কারণে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা কোথাও আগুন নেভাতে এগিয়ে যেতে পারেনি।
পরিস্থিতি চলতে থাকার পর পুলিশ ফাঁকা গুলিবর্ষণ ও টিয়ারশেল নিপে করে। বাঙালীরা লাঠিসোটা নিয়ে মাঠে নামলেও ইউপিডিএফের সন্ত্রাসীরা পাল্টা গুলিবর্ষণ করে। সন্ধ্যার পর আবারও বিপ্তিভাবে অগি্নসংযোগের ঘটনা শুরম্ন হয়। পাহাড়ীরা বাঙালী অধু্যষিত এলাকা এবং বাঙালীরা পাহাড়ী অধু্যষিত এলাকায় হামলা শুরম্ন করে। পাশাপাশি অগি্নসংযোগে লিপ্ত হয়। রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যনত্ম এ ধরনের তা-ব অব্যাহত ছিল। এদিকে খাগড়াছড়ি সেনা সূত্র জানায়, দুপুর সোয়া ১টায় পুলিশ প্রশাসন সেনাবাহিনীর সহায়তা কামনা করলে দেড়টায় শহর এলাকায় সেনা মোতায়েন হয়। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট স্বল্পতার কারণে সেনা সদস্যরা কোন এ্যাকশনে যেতে পারেনি বলে অভিযোগ রয়েছে। পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকায় জেলার গুঁইমারা, মাটিরাঙ্গা ও সিন্ধুকছড়ি এলাকা থেকে অতিরিক্ত সেনা সদস্যদের নিয়ে এসে টহল কাজে নিয়োজিত করা হয়েছে। এছাড়া মহালছড়ির আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন বিপুলসংখ্যক সদস্যকেও শহরে নিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু এরপরও রাতের অাঁধারে শুরম্ন হয়েছে তা-বলীলা। এ অবস্থায় মহাজনপাড়া, খবংপুরিয়া, নারানখাইয়াপাড়া এলাকার বহু পাহাড়ী পরিবার বাড়িঘর ছেড়ে চেংগী নদীর ওপারে কালাপাহাড় এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে। অপরদিকে পাহাড়ী জনঅধু্যষিত এলাকাগুলোর পাশের বাঙালী বসতিরা ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে গেছে। শহরের বাঙালী পরিবাররা যে যা পারে তা হাতে নিয়ে প্রতিরোধের প্রস্তুতিতে ঘরবন্দী হয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে আক্রমণের আশঙ্কায় বাঙালীদের অনেকে বিপ্তিভাবে সংঘবদ্ধ হয়ে অবস্থান নিয়েছে।
এদিকে তিগ্রসত্মদের প েঅভিযোগ করা হয়েছে, প্রশাসনের অবহেলা ও অদূরদর্শিতায় খাগড়াছড়িতে নারকীয় এ তা-বের ঘটনা ঘটল। শহর এলাকায় পাহাড়ী-বাঙালীদের দীর্ঘদিনের সামপ্রদায়িক সমপ্রীতিতে বড় ধরনের আঘাত হলো। অথচ পার্বত্য শানত্মি চুক্তির পর থেকে শহর এলাকায় পাহাড়ী-বাঙালীদেও সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক বজায় ছিল। অভিযোগ, শুরম্ন থেকে পুলিশ ও সরকারী প্রশাসনযন্ত্র যথাযথ ভূমিকা নিলে এ ধরনের ঘটনা এড়ানো যেত।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, শহর ও আশপাশ এলাকায় পাহাড়ী-বাঙালীদের মাঝে ভয়াবহ সংঘর্ষ, অগি্নসংযোগ ও গুলিবর্ষণের ঘটনা শুরম্ন হলে দুপুর ১২টার পর থেকে নিরাপরাধ সাধারণ মানুষ আতঙ্কে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে থাকে। বিভিন্ন শিাপ্রতিষ্ঠানের শিার্থীরা হয়ে পড়ে অবরম্নদ্ধ। বিকেল ৪টার দিকে পরিস্থিতি শহর এলাকায় কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসার পর শিাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রশাসনের সহযোগিতায় ছাত্রছাত্রীদের উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয়।
রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যনত্ম শহরতলির শালবাগান, মধুপুরসহ বিভিন্ন স্থান থেকে বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ এবং আগুন লাগানোর খবর আসছিল। সংঘর্ষের ঘটনায় আহত সাংবাদিকদের মধ্যে রয়েছে এনটিভির তালাত মামুন, চ্যানেল আইয়ের দিলীপ চৌধুরী, বৈশাখীর এইচএম প্রফুলস্ন, নিউজ টুডের কফিল মাহমুদসহ ৫ জন। আহত অন্যান্য যাদের নাম পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে গাড়ি চালক রাসেল, হেলপার সাইফুল, ফরিদ উদ্দিন, গাড়িচালক সুনীল, সোহেল চাকমা, আপন চাকমা, কামাল হোসেন, আহসান উলস্নাহ উলেস্নখযোগ্য। এদের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালে প্রায় ৫০ জন চিকিৎসা নিয়েছে। এর মধ্যে ১৭ জনকে ভর্তি করা হয়েছে।
পাহাড়ীরা শহরের শানত্মিনিকেতন, উপজেলা পরিষদ শালবন, এডিসি হিল এলাকায় বাঙালীদের বসতি এলাকায় অগি্নসংযোগ করে। বাঙালীরা পাল্টা মহাজনপাড়া, হোটেল জিরান, মধুপুর ও আদালত এলাকার বিভিন্ন এলাকায় অগি্নসংযোগ করে। বিপ্তি অগি্নসংযোগের আরও ঘটনার শিকার হয়েছে মধুপুর এলাকার আলাম নামক একটি এনজিও অফিস, রিক্সা গ্যারেজ, সনির শোরম্নম, কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং উপজেলা পরিষদ মসজিদে হয়েছে ভাংচুর। রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যনত্ম পরিস্থিতি থমথমে রয়েছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে সংঘর্ষের বিপ্তি ঘটনাবলীর খবর আসছে। চরম উৎকণ্ঠায় রয়েছে সাধারণ মানুষ। প্রশাসন মাইকিং করে রাসত্মাঘাটে ঘোরাফেরা না করে নিজ নিজ বাড়িঘরে অবস্থান নেয়ার পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে।
রাঙ্গামাটিতে শানত্মিপূর্ণ অবরোধ রাঙ্গামাটি থেকে জনকণ্ঠের নিজস্ব সংবাদদাতা মোহাম্মদ আলী জানান, বাঘাইছড়ির ঘটনার প্রতিবাদে ইউপিডিএফ আহূত সকাল-সন্ধ্যা সড়ক ও নৌপথ অবরোধ কর্মসূচী মঙ্গলবার রাঙ্গামাটিতে শানত্মিপূর্ণভাবে পালিত হয়েছে। এ সময় কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। তবে পুলিশ সূত্রে জানানো হয়েছে, সোমবার মধ্যরাতে বাঘাইছড়িতে আরও ৩টি পরিত্যক্ত বাড়িতে অগি্নসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে অবরোধের কারণে রিক্সা চলাচল স্বাভাবিক থাকলেও রাঙ্গামাটির অভ্যনত্মরীণ ও দূরবতর্ী সড়কগুলোতে যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। নৌপথেও দূরপালস্নার কোন লঞ্চ চলেনি। বাঘাইছড়ি উপজেলা সদরে রিক্সা চলাচল স্বাভাবিক থাকলেও দূরপালস্নার সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। অবরোধ চলাকালে পুলিশের পাশাপাশি সেনা টহলও ছিল। সকালে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে রাঙ্গামাটির বিশিষ্ট উপজাতীয় ব্যক্তিগণ ঘটনার সংসদীয় কমিটির তদনত্মের দাবি করে মানববন্ধন করেছেন এবং পরে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন। বিকেলে জেলা প্রশাসকের সম্মেলনক েআইনশৃঙ্খলা বিষয়ক এক জরম্নরী সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় জেলার কোন স্থানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কোন রকম অবনতি না ঘটে সেদিকে সংশিস্নষ্ট সকলের সচেতন থাকার আহ্বান জানানো হয়। বাঘাইছড়ি উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১৯ ও ২০ ফেব্রম্নয়ারি সংঘটিত ঘটনার পর তিগ্রসত্ম লোকজনের মাঝে যে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল তা কিছুটা কমে এসেছে। তিগ্রসত্মরা তাদের আত্মীয়স্বজনের বাসায় উঠেছে। রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসন তিগ্রসত্মদের তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরম্ন করেছে। তালিকা অনুযায়ী তাদেরকে তিপূরণ প্রদানের সিদ্ধানত্ম নেয়া হয়েছে।
মামলা বাঘাইছড়ির ঘটনায় দু'টি মামলায় ৪ শতাধিক আসামি করা হয়েছে। সোমবার বাঘাইহাট জোনের ১৪ বীরের সেনাসদস্য মোঃ আবুল হাশেম বাদী হয়ে বাঘাইছড়ি থানায় একটি মামলা করেন। এ মামলায় আসামির সংখ্যা অজ্ঞাতানাম ৪ শতাধিক। এ মামলায় রূপন চাকমা, লিটন চাকমা, বাইট্টা চাকমা ও দেবেন্দ্র চাকমাকে পুলিশ আটক করেছে। দ্বিতীয় মামলাটি করেন বাঘাইহাটে নিহত বুদ্ধ পুদির স্বামী উত্তর কুমার চাকমা। এ মামলায় ২৫ বাঙালীকে আসামি করা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আজ যাচ্ছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু বাঘাইছড়ির ঘটনাস্থল পরিদর্শনের জন্য মঙ্গলবার আসার কথা থাকলেও রাতে তা বাতিল করে আজ আসার সিদ্ধানত্ম নেয়া হয়েছে। প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সকাল ১০টায় মন্ত্রী তিগ্রসত্ম এলাকা পরিদর্শন শেষে সাজেক ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং তিগ্রসত্ম লোকজনের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। পরে খাগড়াছড়ি সার্কিট হাউসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, প্রশাসনের কর্মকর্তা এবং স্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে বৈঠক করবেন।

No comments

Powered by Blogger.