টালমাটাল জামায়াত

 সেক্রেটারিসহ কার্যকরী পরিষদের ২৬ সদস্যের গণপদত্যাগকে কেন্দ্র করে চরম অস্থির হয়ে উঠছে পুরো জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি। বিদ্রোহীদের আক্রমণাত্মক অবস্থানে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে শিবিরের সভাপতি রেজাউল করিমসহ তার মদদদাতা হিসেবে চিহ্নিত জামায়াতের ৩ শীর্ষ নেতা।
কেবল তাই নয়, পদত্যাগের পর এবার দুর্নীতিবাজ ও রাবির হত্যাকা-ের জন্য অভিযুক্ত করে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুুহাম্মদ মুজাহিদ, ঢাকা মহানগর আমির রফিকুল ইসলাম খান এবং সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল নুরম্নল ইসলাম বুলবুল এবংর্ িশবির সভাপতি রেজাউল করিমকে দেশব্যাপী অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে প্রতিরোধের ডাক দিয়েছে বিদ্রোহীরা। একই সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের এই নেতাদের সারাদেশে প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন তারা। অন্যদিকে সঙ্কট সমাধানে সরাসরি হসত্মৰেপ করেও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না জামায়াতের আমির নিজামীসহ কেন্দ্রীয় নেতারা। ঘটনার জন্য একে অপরকে দায়ী করে বিভক্ত ও টালমাটাল হয়ে পড়েছে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াত। জানা গেছে, সর্বশেষ গত ৮ ফেব্রম্নয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের বর্বরতার পর প্রশাসনের কঠোর অবস্থার মুখে বিরোধ তীব্র হয়ে উঠলেও শিবিরের এই বিদ্রোহ আরও অনেক পুরনো। জানা গেছে, ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে কেবল একবার সেক্রেটারির পদ থেকে কারও পদত্যাগ করার নজির আছে। শিবিরের প্রথমদিকে বিরোধ এবং নতুন দল করার চিনত্মা নিয়ে আহমেদ আব্দুল কাদের (খেলাফত মজিলিসের বর্তমান মহাসচিব) পদত্যাগ করেছিলেন। এছাড়া এতদিন অভ্যনত্মরীণ কোন্দলমুক্ত থাকলেও এবার সভাপতি ও সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভক্ত হয়ে পড়েছে মৌলবাদী এই সংগঠনের নেতাকর্মীরা। অনিয়ম, দুর্নীতি প্রবেশ করানোর দায়ে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ' সেভ শিবির' এর ব্যানান থেকে জানুয়ারির প্রথম দিকে আন্দোলনের হুমকি দেয়ার খরব পত্রিকায় প্রকাশ হওয়ায় পর রীতিমতো তোলপাড় শুরম্ন হয়। তবে কারা কারা কেন্দ্র থেকে মাঠ পর্যায় পর্যনত্ম শিবির সদস্যদের আন্দোলনে সংগঠিত করছে তার হিসাবও মেলাতে পারছিল না জামায়াত নেতারা। ১৮ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় সদস্য সম্মেলনের পর বিরোধ অনেকটা প্রকাশ্য রূপ নিতে থাকে। জামায়াতের দলের আন্দোলনের অন্যতম চালিকাশক্তি ছাত্রশিবিরের ৩৩তম কেন্দ্রীয় সদস্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় গত ১৮ জানুয়ারি। বঙ্গবন্ধু আনত্মর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে সভাপতি পদে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হন মুহাম্মদ রেজাউল করিম। কিন্তু েেসক্রেটারি জেনারেলের পদ থেকে ছিটকে পড়েন শিশির মুহাম্মদ মুনির। এ পদে নির্বাচিত হন ডা. আবদুলস্নাহ আল মামুন। শিবিরের একটি বড় অংশ সেক্রেটারি পদে মামুনের আসাকে গ্রহণ করলেও মেনে নিতে পারেনি সভাপতি পদে রেজাউল করিমের দ্বিতীয় মেয়াদে আসাকে। কারণ রেজাউল করিমের অর্থ লোপাট, লোপাটের টাকা দিয়ে ফ্যাট কেনা, বিয়ের তথ্য গোপন করাসহ বিভিন্ন কারণে নির্বাচনের আগে থেকেই ভেতরে ভেতরে সভাপতি পদে শিশির মোহাম্মদ মনিরের আসা সম্ভাবনার কথা শোনা যাচ্ছিল। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতাকর্মীদেরও এই বিষয়টিতে ব্যাপক সমর্থন ছিল। আবার অনেক আগে থেকেই সভাপতি রেজাউল করিমের পেছনে জামায়াতের কয়েক কেন্দ্রীয় নেতার আশীর্বাদ থাকার অভিযোগ ছিল। বিষয়টি ভালভাবে নিতে পারছিলেন না শিবিরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়সহ মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। কিছুদিন যাবত ভেতরে ভেতরে ৰোভ থাকলেও কেন্দ্রীয় সদস্য সমলেনের পর থেকে তা প্রকাশ্য রূপ নিতে থাকে। ইতিহাসে আমির ছাড়া বাইরের কারও উপস্থিত থাকার রীতি না থাকলেও ৰোভ বাড়তে থাকে সম্মেলনে জামায়াতের কয়েক নেতার উপস্থিতি নিয়েও। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোঃ কামারম্নজ্জামান, ঢাকা মহানগর জামায়াতের আমির রফিকুল ইসলাম খানসহ জামায়াতের কয়েক কেন্দ্রীয় নেতা। সম্মেলনে কেন্দ্রীয় দুই নেতা উপস্থিত থেকে তারা তাদের মতামতের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন বলে অভিযোগ তোলে শিবির নেতাকর্মীরা। সম্মেলনের পর থেকেই জামায়াত নেতাদের বিরম্নদ্ধে ৰোভ বাড়তে থাকে সাধারণ শিবির সদস্যসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পর্যায়ে নেতাদের। এর পর ১ ফেব্রম্নয়ারি ইন্টারনেটের মাধ্যমে মেল পাঠিয়ে বিদ্রোহী গ্রুপ রীতিমতো সতর্ক করে দেয় জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্বকে। বিভিন্ন সাংবাদিকের ব্যক্তিগত মেল নম্বরে একটি মেল পাঠানো হয় ' সেভ শিবিরের' ঠিকানা থেকে। যেখানে বলা হয়েছে, 'প্রিয় সাংবাদিক ভাইয়েরা_ শিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল ড. মামুন ভাই পদত্যাগ করেছেন। লাস্ট পরিষদ মিটিংয়ে মামুন ভাই পদত্যাগ করেছেন। তার পদত্যাগের কারণ হলো, বর্তমান প্রেসিডেন্ট রেজাউল করিমের দুর্নীতি, জামায়াত নেতা মুজাহিদ ও রফিকুল ইসলামসহ অনেকের নগ্ন অসাংবিধানিক হসত্মৰেপ। এই দুর্নীতিবাজ প্রেসিডেন্টের আন্ডারে সেক্রেটারি হয়ে তিনি কাজ করবেন না বলেই পদত্যাগ। সেভ শিবিরের পৰে বলা হয়, সারাদেশের শিবিরের হাজার হাজার সমর্থক, কর্মী, সাথী, সদস্য আমাদের সঙ্গে আছে।
বিষয়টি নিয়ে জামায়াতের কয়েক নেতা অনেক আগে থেকেই ুব্ধ ছিল মুজাহিদসহ অভিযুক্ত অন্য কয়েক নেতার ওপর। তারা আমিরের হসত্মৰেপও চেয়েছেন। কিন্তু ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে বলে এই মুহূর্তে অসহায়ের মতো কথা বলছেন জামায়াতের নেতারা। সমপ্রতি বিভিন্ন সভায় যারা শিবির নেতাদের ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন তাদের একজন (সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল) মঙ্গলবার জনকণ্ঠকে বলেন, অস্বীকার করার উপায় নেই, আজকের অবস্থার জন্য মুজাহিদসহ ৩ নেতার অজাচিত হসত্মৰেপ ও আমিরের নমনীয়তাই দায়ী। তিনি জানান, কার্যকরী পরিষদের সদস্য ৩৮ জন। এর মধ্যে নির্বাচিত ৩১ জনের (বাকিরা সভাপতি দ্বারা মনোনীত) ২৬ জনই পদত্যাগ করেছেন। জানা গেছে, রবিবার সেক্রেটারি ডা. আব্দুলস্নাহ আল মামুন পদত্যাগ করার পরই সঙ্কট সমাধানে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন জামায়াতে নেতারা। কিন্তু এর একদিন পরেই ঘটে গণপদত্যাগের ঘটনা। এই দু'দিনের অবস্থা নিয়ে তথ্য জানতে চাইলে বিদ্রোহী শিবির নেতারা বলেছেন, অভিযোগগুলো তদনত্মে গঠিত কমিটি সত্যতা পায় বলে রেজাউল করিমকে বাঁচাতে মুজাহিদ কমিটির কাজে হসত্মৰেপ করেন। এবং উল্টো কার্যকরী সদস্যদের হুমকি দেন, ঝামেলা করলে বাদ দিয়ে নতুন কমিটি করা হবে। জানা গেছে, এই অবস্থায় সোমবার সেক্রেটারি মামুনসহ ২৫ জন নিজামীর সঙ্গে দেখা করতে যায় বিকেল ৪ টায়। রাত ৮ টা পর্যনত্ম তাদের বসিয়ে রেখে শেষে তাদের কাছে এই বলা হয় যে ু আপনারা কাপ (কার্যকরী পরিষদ) সদস্যরা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এবং রেজাউল সঠিক, আপনারা মুজাহিদসহ জামায়াতের বড় লিডারদের গ্রেফতারের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।চ্ এর পরই তারা জন পদত্যাগ পত্র জমা দেয়। সূত্র জানিয়েছে, আরও অনত্মত ৫ সদস্য দু'একদিনের মধ্যে পদত্যগ করবে। এক কেন্দ্র্রীয় নেতা (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক নেতা) বলেন, শিবিরের বর্তমান সভাপতি ও জামায়াতের কয়েক কেন্দ্রীয় নেতার অবস্থান নিয়ে আগেই ৰোভ ছিল। অধিকাংশ নেতাকর্মীই মনে করেন, সদস্য সম্মেলনে জামায়াতের কয়েক কেন্দ্রীয় নেতা উপস্থিত থেকে সাধারণ সদস্যদের প্রভাবিত করেছেন।
পুরো বিষয় নিয়ে অস্থিরতায় পড়লেও শীঘ্রই মুখ খুলছেন না জামায়াত নেতারা। কথা বললেও নাম প্রকাশ করতে কেউ রাজি নয়। যার বিরম্নদ্ধে শিবিরের অভিযোগ দুদিন যাবত সেই সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। জামায়াত অফিস থেকে বলা হয়, এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের প্রধান অধ্যাপক তাসনিম আলমের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাকেও পাওয়া যায়নি। জানা গেছে, ঘটনার জন্য জামায়াতের ৩ নেতাকে দায়ী করে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন নেতারা। মঙ্গলবার বৈঠকে সরাসরি অনেক নেতা তাদের দায়ীও করেছেন। তাদেরই একজন জানিয়েছেন, এখন সঙ্কট সমাধান কঠিন। আগে হলে এই ভাঙ্গনের মুখে পড়তে হতো না। অন্যদিকে যে অফিসের সামনে সব সময় অনত্মত ২০-২৫ নেতাকর্মী অবস্থান নিয়ে থাকে সে শিবিরের অফিস সকাল থেকে ছিল তালাবদ্ধ। সভাপতির মোবাইল বন্ধ। নেতাকর্মীরাও তার হদিস পাচ্ছেন না। সাংবাদিকরা অফিসে গিয়েও কারও দেখা পাননি। তবে অনেকৰণ অপেৰার পর স্কুল বিষয়ক সম্পাদক আতাউর রহমান সরকার গেটের বাইরে উপস্থিত হন। পদত্যাগের প্রসঙ্গ জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে বলেন, আমরা এখন কার্যকরী পরিষদ নির্বাচন নিয়ে ব্যসত্ম আছি। দু'একদিনের মধ্যে আপনারা সব জানতে পারবেন।
অন্যদিকে পদত্যাগের কথা স্বীকার করেছেন সেক্রেটারি আবদুলস্নাহ আল মামুন। বলেন, আমি আগেই পদত্যাগ করেছি। ররিবার তা গ্রহণ করা হয়েছে। বাকিরা হয়ত সোমবার পদত্যাগ করেছে। দেখা যাক কি হয়। তবে, নিয়ম অনুযায়ী এখন নির্বাচনের মাধ্যমে শূন্য পদ পূরণ করতে হবে। পদ্যত্যাগের কারণ জানতে চাইলে বলেন, আমি ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়েছি।

No comments

Powered by Blogger.