পার্বত্য চট্টগ্রামের পাকিস্তানীকরণের জন্য দায়ী জামায়াত-বিএনপি ও পাকিস্তানপন্থী প্রশাসন

পার্বত্য চট্টগ্রামে আবার রক্ত ঝরেছে। গত ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ির কয়েকটি জনপদে পাহাড়ী ও বাঙালীদের ভেতর রক্তয়ী সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন চারজন পাহাড়ী।
আহতদের ভেতর পাহাড়ী ও বাঙালী উভয় সমপ্রদায়ের সদস্যরা আছেন। আগুনে পুড়ে যাওয়া অধিকাংশ বাড়ি পাহাড়ীদের। দুটো বৌদ্ধ বিহারও আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বিহারের ভিুরা পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। রাঙ্গামাটির পাহাড়ী-বাঙালী সংঘর্ষ ও ধ্বংসযজ্ঞ ছড়িয়ে পড়েছে খাগড়াছড়িতে। ২৩ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়িতে দুই পরে সংঘর্ষে একজন বাঙালী নিহত হয়েছেন, আহতদের ভেতর বাঙালী ও পাহাড়ীসহ পাঁচ সাংবাদিকও আছেন।

ঢাকার অধিকাংশ জাতীয় দৈনিকে এই নৃশংস ঘটনার জন্য প্রধানত অবৈধ অভিবাসী বাঙালীদের দায়ী করা হয়েছে। জামায়াত ও বিএনপির পত্রিকাগুলো এই হত্যাকা- ও ধ্বংসযজ্ঞের জন্য যথারীতি পাহাড়ীদের দায়ী করেছে। স্থানীয় প্রশাসনের কেউ দুই পকে আবার কেউ শুধু পাহাড়ীদের দায়ী করেছেন। সেনাবাহিনীর আঞ্চলিক অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সালেহীন বলেছেন, 'সন্ত্রাসীরা সেনাবাহিনীর ওপর গুলি চালালে আত্মরার জন্য সেনা সদস্যরা তিনটি ফাঁকা গুলি ছোড়ে, তবে বাকি গোলাগুলি কারা করেছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বাঘাইহাটের চলমান ঘটনাকে দুঃখজনক আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, পাহাড়ী-বাঙালী উভয়প তিগ্রসত্ম হচ্ছে। একটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল পাহাড়ের শানত্মি নষ্ট করতে এসব ঘটনার পেছনে ইন্ধন দিচ্ছে। তবে তিনি দলটির নাম বলেননি।' (প্রথম আলো, ২১ ফেব্রম্নয়ারি ২০১০)
সেনা কর্মকর্তা শুধু আঞ্চলিক দলের ইন্ধন দেখেছেন, যারা নাকি পাহাড়ের শানত্মি নষ্ট করতে চায়। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী আমাদের মেনে নিতে হবে পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতীয় পর্যায়ের যে সব দল আছে তারা সবাই পাহাড়ে শানত্মির প্রতি নিবেদিত। এমনকি যে বিএনপি-জামায়াত পার্বত্য শানত্মিচুক্তির বিরম্নদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছে তারাও এই সেনা কর্মকর্তার বিবেচনায় পাহাড়ে শানত্মির প েকাজ করছে!
পার্বত্য চট্টগ্রামে সমতলের বাঙালীদের এনে পাহাড়ে বসতি স্থাপনের সূচনা করেছিল পাকিসত্মানের আইয়ুব খানের সামরিক জানত্মা। ১৯৪৭ সালে যে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালী জনসংখ্যা ছিল শতকরা তিন ভাগেরও নিচে, তেইশ বছরে পাকিসত্মানি কলোনিকালে বাঙালীর সংখ্যা বেড়ে পনের ভাগ হয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাকিসত্মানিকরণ প্রক্রিয়া স্বাধীন বাংলাদেশেও অব্যাহত রয়েছে। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে সংুব্ধ পাহাড়ীদের সঙ্গে শেখ হাসিনার সরকারের শানত্মিচুক্তি সম্পাদনের সময় তিন পার্বত্য জেলায় বাঙালী অভিবাসীর সংখ্যা ছিল প্রায় আটচলিস্নশ ভাগ।
সরকারী উদ্যোগে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে বাঙালীদের বসতি স্থাপনের জন্য নেয়া হয়েছে তারা সরকারের খাসজমি ছাড়াও পাহাড়ীদের জমি-ভিটা দখল করেছে, পাহাড়ের মানুষদের ওপর বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন চালিয়েছে। পাহাড়ী জনপদে অগি্নসংযোগ, হত্যাকা-, লুণ্ঠন প্রভৃতি প্রাত্যহিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। আইয়ুব খানের আমলে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করতে গিয়ে এক ল চাকমাকে জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। জমি থেকে উচ্ছেদ হওয়া পাহাড়ীরা ভারতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। এক পর্যায়ে মরিয়া হয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে পাহাড়ীরা। পার্বত্য বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে বাঙালী সেনাবাহিনী '৭১-এ পাকিসত্মানী হানাদার বাহিনীর মতো আচরণ করেছে। শানত্মিচুক্তি স্বারের পূর্ব পর্যনত্ম পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী এবং সেনাবাহিনীর সহায়তায় অবৈধ বাঙালী অভিবাসীদের অব্যাহত হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও ধ্বংসযজ্ঞসহ যাবতীয় মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনের কারণে আনত্মর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ধুলোয় মিশে গেছে।
পাকিসত্মানী শাসকদের উদ্দেশ্য ছিল পাহাড়ের আদিবাসীদের শায়েসত্মা করা। কারণ '৪৭-এ দেশভাগের সময় যৌক্তিক কারণে পাহাড়ীরা ভারতের সঙ্গে যুক্ত হতে চেয়েছিল। জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্ব অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারতের অংশ হওয়ার কথা, পাকিসত্মানের নয়। কলকাতা বন্দরের বিনিময়ে র্যাডকিফ সাহেব কলমের এক খোঁচায় পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিসত্মানের ভাগে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। সেই কারণে পাকিসত্মানী শাসকরা প্রথম থেকে এবং বাংলাদেশে যারা পাকিসত্মানী শাসকদের স্বার্থের জন্য জান কুরবান করতে প্রস্তুত, যেমনটি ছিলেন '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময়জ্জ তারা পাকিসত্মানী প্রভুদের পার্বত্যনীতির ধারাবাহিকতা নিষ্ঠার সঙ্গে অনুসরণ করছেন। ১৯৯৭ সালে সরকারের সঙ্গে বিদ্রোহীদের শানত্মিচুক্তি শুধু দেশের ভেতরে নয়, আনত্মর্জাতিক অঙ্গনেও সমূহ প্রশংসা অর্জন করেছিল। পৃথিবীর যে সকল দেশে সংখ্যালঘু ধমর্ীয় ও নৃগোষ্ঠীসমূহের সঙ্গে সরকারের বৈরী সম্পর্ক বিরাজ করছে অধিকাংশ েেত্র চুক্তির মাধ্যমে সম্পাদিত শানত্মি কিছু সময়ের জন্য কাজ করলেও চুক্তিবিরোধীদের কারণে বহু দেশে বিদ্রোহীদের সঙ্গে সরকারের শানত্মিচুক্তি কার্যকর হয়নি, সংঘাত, নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশে পাকিসত্মানপন্থী মৌলবাদী-সামপ্রদায়িক অপশক্তি বোধগম্য কারণেই ১৯৯৭ সালে সম্পাদিত শানত্মিচুক্তির বিরোধিতা করছে শুরম্ন থেকেই। চুক্তি সম্পাদনের আগে তারা বলেছিল বিদ্রোহীদের সঙ্গে শানত্মিচুক্তি করলে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারতের অংশ হয়ে যাবে। শত্রম্নর মুখে ছাই দিয়ে তেমনটি হয়নি। সঙ্গতকারণেই শানত্মিচুক্তির শত্রম্নরা প্তি হয়েছে। জামায়াত-বিএনপি প্তি হয়েছেজ্জ শানত্মিচুক্তির ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের 'পাকিসত্মানীকরণ' বা 'ইসলামীকরণ' প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে। পাহাড়ীদের একটি অংশ প্তি হয়েছেজ্জ শানত্মিচুক্তির ভেতর পাহাড়ীদের সব দাবি অনত্মভর্ুক্ত হয়নি। শানত্মিচুক্তির বিরোধিতাকারীদের ভেতর এই দুই পরে ভেতর প্রথম প, অর্থাৎ জামায়াত-বিএনপি দ্বিতীয় পরে তুলনায় অনেক শক্তিশালী।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য জামায়াতের পুরো এজেন্ডা বিএনপির পওে হজম করা কঠিন। জামায়াতের ছত্রছায়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম অঞ্চলে বিসত্মৃত হয়েছে জঙ্গী মৌলবাদীদের বিশাল নেটওয়ার্ক। এসব এলাকায় শুধু বাংলাদেশের নয়, বার্মা, থাইল্যান্ড, ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার জঙ্গীদের প্রশিণ আরম্ভ হয়েছে ১৯৯২ সালে, যখন থেকে পাকিসত্মানের হরকতুল জিহাদ বাংলাদেশে ঘাঁটি গেড়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে এসব জঙ্গী প্রশিণের দায়িত্বে যারা নিযুক্ত ছিল তাদের কয়েকজন আমাকে বলেছে, জামায়াত কীভাবে গত দেড় দশক ধরে এসব জঙ্গী প্রশিণ শিবিরের তত্ত্বাবধান করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে জামায়াতের এই সশস্ত্র আধিপত্যে মদদ দিয়েছে সেনাবাহিনীর একাংশ। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী ও বেসামরিক প্রশাসনে এখনও যে পাকিসত্মানপন্থীরা শেকড় গেড়ে বসে আছে এটা নতুন কোনও তথ্য নয়। নতুন তথ্য হচ্ছে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগে জামায়াত-শিবিরের অনুপ্রবেশ। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, স্থানীয় সরকার ও পলস্নী উন্নয়নমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন এবং আমারাও জানিজ্জ ছাত্রলীগে কীভাবে ছাত্র শিবিরের অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
২০০৯ সালে মতায় আসার পর যখনই মহাজোট সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং '৭২-এর সংবিধান পুনর্প্রবর্তনের কথা বলেছে তখন থেকে জামায়াতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। সমপ্রতি কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা ছাত্রশিবিরের তা-ব ও নৃশংসতা প্রত্য করেছি। পার্বত্য চট্টগ্রামে যে সহিংসতা নতুন করে সৃষ্টি করা হয়েছে তার সঙ্গে জামায়াতের সম্পৃক্তি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অজানা থাকার কথা নয়। মহাজোট সরকারকে অকেজো করার জন্য যত ধরনের সন্ত্রাস ও হত্যাকা- সম্ভব জামায়াত সবই করবে, কারণ সরকার যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যথাযথভাবে সম্পন্ন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংবিধান পুনর্প্রবর্তন করতে পারে বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের মৌলবাদী সহযোগীদের অসত্মিত্ব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন প্রয়োজন হলে নাকি পার্বত্য চট্টগ্রামে আবার সেনাবাহিনী নামানো হবে। জামায়াত এটাই চাইছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সামরিক বলপ্রয়োগে সম্ভব নয় বলেই শানত্মিচুক্তি করা হয়েছিল। শানত্মিচুক্তি অনুযায়ী সমস্যার সমাধান করতে হলে সরকারকে রাজনৈতিকভাবে এগুতে হবে। শনত্মিচুক্তির পূর্ণ বাসত্মবায়ন ব্যতীত পার্বত্য চট্টগ্রাম কখনও শানত্ম হবে না। পাহাড়ীদের একাংশকে দায়ী করে সামরিক বাহিনী দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে শানত্মি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগে যেভাবে জামায়াত শিবিরের অনুপ্রবেশ ঘটেছে একইভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালীদের অধিকাংশ সংগঠনের নিয়ন্ত্রণ এখনও জামায়াতের হাতে। সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনকে জামায়াতমুক্ত না করলে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাকিসত্মানীকরণ প্রক্রিয়া বন্ধ হবে না, শানত্মিও ফিরে আসবে না।
২৪ ফেব্রম্নয়ারি ২০১০

No comments

Powered by Blogger.