টপ টেন

ড. ইউনূস ও রামু প্রসঙ্গ

তারেক মোরতাজা

বছরজুড়েই আলোচনায় ছিলেন নোবেলজয়ী একমাত্র বাংলাদেশী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের অস্তিত্ব ও তার প্রতি সরকারের প্রতিহিংসা নিয়ে সমগ্র দুনিয়ায় সমালোচিত হয়েছে মহাজোট সরকার।
তবুও সরকারের তরফে বরাবরই তার সমালোচনা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মার্চ মাসে বলেন, ড. ইউনূস এত যোগ্য লোক হলে তাকে কেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট করা হচ্ছে না। তিনি তাকে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট করার প্রস্তাবও করেন। এ জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে এক বিবৃতি দিয়ে ড. ইউনূস নিজেই প্রস্তাবটি ফিরিয়ে দেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্ম সেতু কেলেঙ্কারি জন্য নিজ দলের কলঙ্ক সৈয়দ আবুল হোসেনকে দেশপ্রেমিক বললেও ড. ইউনূসকে বলেছেন বিশ্বাসঘাতক। সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি এমন মন্তব্য করেন। এতে অবশ্য সরাসরি ড. ইউনূসের নাম বলা হয়নি। পরে অবশ্য এর সাথে তার সংশ্লিষ্টতা নেই বলে ড. ইউনূস এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন। বলেছেন, হিলারির সাথে তার বন্ধুত্বের কারণে এমনটা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

সরকার বরাবরই চেষ্টা করে আসছিল ড. ইউনূসের প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক থেকে তাকে সরানোর পরও তার যে প্রভাব রয়েছে তা কমানোর জন্য। সেটি করতে ব্যর্থ হয়ে আগস্ট মাসে গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ বদলে ফেলা হয়। এতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগে সার্চ কমিটি গঠনের ক্ষমতা পর্ষদের কাছ থেকে সরিয়ে চেয়ারম্যানের ক্ষমতা বাড়ানো হয়। সেপ্টেম্বর মাসে চেয়ারম্যান তার ক্ষমতাবলে পর্ষদের মতামত ছাড়াই একটি সার্চ কমিটি গঠন করেন। যেখান থেকে পরে পর্ষদের ঋণগ্রহীতাদের ভোটে নির্বাচিত সদস্য তাহসিনা পদত্যাগ করেন। এরপর এ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হলে নতুন করে আরেকজন সদস্য নিয়োগ ছাড়াই ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরু হলে তাহসিনা আদালতে গেলে এমডি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দুই মাসের জন্য স্থগিত করেন আদালত। বর্তমানে সে স্থগিতাদেশ কার্যকর রয়েছে। তবে ড. ইউনূসের আয়ের ওপর সরকারের তদন্ত চলছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত কোনো অনিয়ম ধরতে পারেনি সরকার।

রামুকাণ্ড : রামুকাণ্ডের আসল ঘটনা আড়ালেই থেকে গেছে। ঘটনার পরদিন ৩০ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহিউদ্দীন খান আলমগীর সরকারবিরোধীদের এর জন্য দায়ী করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও রামু সফর করে একই কথা বলেন। সর্বশেষ জমা হওয়া সরকারি তদন্ত রিপোর্টেও ক্ষমতাসীন দলের মতের প্রতিফলন ঘটেছে।

রামুকাণ্ডের পর ওই এলাকা ঘুরে প্রায় সবাই বলেছেন, এ ঘটনা প্রশাসনের ব্যর্থতা ও পুলিশ বাহিনীর নির্বিকার ভূমিকার কারণে ঘটেছে। এমনকি সরকারসমর্থক আইনজীবীরা ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের নেতৃত্বে আইনজীবীরা এবং মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানও রামু ঘুরে সাংবাদিকদের বলেছেন, প্রশাসন সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ ছিল।

পুলিশের তদন্তের মূল ভিত্তি হলো মুক্তাদির। যাকে পুলিশ পরিচয় করিয়ে দিয়েছে ছাত্রশিবির কর্মী বলে। অথচ তার মা সাজেদা বেগম নয়া দিগন্তকে বলেছেন, তার ছেলে কোনো সময়ই রাজনীতির সাথে জড়িত নয়। শিবির তো দূরের কথা, অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের সাথেও তার কোনো রকমের সম্পর্ক নেই।

প্রতিবেদনে ঘটনা সম্পর্কে যে প্লট তৈরি করা হয়েছে, তাতে অগ্রভাগেই আছেন তোফায়েল আহমেদ। ২৮ সেপ্টেম্বর মোক্তাদির তার বাড়িতে যান। সেখানে একটি বৈঠক হয়েছে বলে তদন্ত কমিটি জানতে পেরেছে। কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উত্তম বড়–য়ার ফেসবুকে যে কুরআন অবমাননার ছবি যুক্ত করা হয়েছে তা মুক্তাদিরই ছড়ানো। কিন্তু যার দোকান থেকে এটি ছড়ানো হয় যে ফারুকের ভাষ্য মতে, সন্ধ্যার কিছু পর মুক্তাদির তার দোকানে আসে। মুক্তাদিরের মায়ের ভাষ্য মতে, সেটি সন্ধ্যা ৭টা থেকে সাড়ে ৭টা। এরপর অতি অল্প সময়ে কিভাবে তিনি রামু উপজেলাজুড়ে এ ছবির প্রচার করলেন সে বিষয়ে প্রতিবেদনে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি। শুধু বলা হয়েছে, ঘটনা ছড়িয়েছেন মুক্তাদির। সেই মুক্তাদির শিবিরকর্মী। তবে বাস্তবে সে আওয়ামী লীগ নেত্রীর সন্তান এবং নিজেও ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে কিছুটা জড়িত।

উত্তম বড়–য়ার ফেসবুকে কুরআন অবমাননার অভিযোগ এনে এ হামলা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে সে বিষয়েও তদন্ত প্রতিবেদেন কোনো বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়নি। বলা হয়েছে, উত্তম আত্মগোপনে। তাই এ বিষয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না। পুলিশ তার মা ও মাসিকে হেফাজতে নিলেও পরে আদালতের নির্দেশে ছেড়ে দেয়।

১৭ অক্টোবর প্রকাশ করা ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের এ ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকা ও প্রশাসনের ন্যক্কারজনক ব্যর্থতার অভিযোগ আড়াল করার জন্যই এখন রোহিঙ্গাদের অন্যায়ভাবে দায়ী করার চেষ্টা চলছে। অধিকার এই অসমর্থিত তথ্য ও অন্যায় অভিযোগকে মিয়ানমারে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া হত্যাযজ্ঞের পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গাদের জন্য ভয়ানক বিপজ্জনক বিষয় বলে মনে করে।

অধিকার বলেছে, শুধু মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের জন্য নয়, একই সাথে বাংলাদেশে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্যও তা বিপদ সৃষ্টি করতে পারে। রোহিঙ্গারা এই ঘটনায় জড়িত ছিল প্রমাণ করার জন্য তাদের গ্রেফতার করার চেষ্টা করা হতে পারে।

স্থানীয়রা নয়া দিগন্তকে বলেন, ২৯ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৯ার দিকে মিছিলটি বের হয় ছাত্রলীগ নেতা সাদ্দাম হোসেন, আমজাদ হোসেন, জিন বাবু ও রুস্তম আলীর নেতৃত্বে। ওই মিছিলটি বৌদ্ধমন্দির এলাকা ঘুরে আসে। সেখান থেকে ফিরে তারা রামু চৌমুহনী বাজারের চৌরাস্তায় মিলিত হয়। সেখানে দেন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা নুরুল ইসলাম, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সোহেল সারোয়ার কাজল, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মুশরাত জাহান, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নুরুল ইসলাম, সেখানে উপস্থিত হন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেবী চন্দ ও স্থানীয় থানার ওসি নজিবুল ইসলাম। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতারা সেখানে বক্তব্য রাখেন। সেখানে বিএনপি নেতা ও স্থানীয় সংসদ সদস্য লুৎফর রহমান ইউএনওর ফোন পেয়ে যান। তিনিও ওই সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। ওই সমাবেশ চলাকালে চৌমুহনী বাজারের পাশে বিহার রোড়ের শ্রীকুল এলাকায় সাদা চিং বিহার ও লাল চিং বিহার মন্দিরে হামলা শুরু হয়। লুৎফর রহমান বলেছেন, তিনি এ হামলা ঠেকানোর চেষ্টা করেন। একই কথা বলেছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। তবে স্থানীয়রা বলেছেন, মিছিল, সমাবেশ ও হামলার ক্ষেত্রে সামনের সারিতে ছিলেন সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা।





সুরঞ্জিতের কালো বিড়াল

ফজলুল হক শাওন

মহাজোট সরকারের গেল বছরটি (২০১২) ছিল ঘটনাবহুল। এ বছরটিকে অনেকে আর্থিক কেলেঙ্কারির বছর বলে মন্তব্য করছেন। অনেক আর্থিক কেলেঙ্কারির মধ্যে সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ঘুষ কেলেঙ্কারির ঘটনা ছিল অন্যতম। গেল বছরের ৯ এপ্রিল রাতে সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিতের বাসায় ৭০ লাখ টাকা নিয়ে যাওয়ার সময় বিজিবি গেটে এপিএস ওমর ফারুক ধরা পড়েন। এ ঘটনার তদন্তে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দোষী প্রমাণিত না হলেও তার মন্ত্রিত্ব চলে যায়। রেলে চাকরি দেয়ার নামে ঘুষ কেলেঙ্কারির ঘটনা মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচার হওয়ায় তা নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় শুরু হয়। দুর্নীতির কালো বিড়াল ধরার কথা বলে সুরঞ্জিত নিজেই হয়ে গেলেন কালো বিড়াল।

মজার বিষয় ছিল, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত শেয়ার বাজারের কেলেঙ্কারির সাথে জড়িতদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন জাতীয় সংসদে। দুর্নীতি প্রসঙ্গে সংসদে দাঁড়িয়ে সুরঞ্জিত বলেন, দুর্নীতির কালো বিড়ালটি কোথায় সেটি খুঁজে বের করতে হবে। তিনি শেয়ার বাজারের কেলেঙ্কারির সাথে জড়িতদের ইমাম, মোয়াজ্জিন, দরবেশ-আউলিয়া বলে আখ্যায়িত করেন। এ বক্তব্যে মূলত শেয়ার বাজারের কেলেঙ্কারির সাথে দুর্নীতিবাজ ক্ষমতাসীন কয়েকজন নেতার কথা বলেন তিনি আকার ইঙ্গিতে। রেলের ঘুষ কেলেঙ্কারির খবর সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী তাকে ডেকে ঘটনার জন্য ধমকান এবং তাকে পদত্যাগ করার কথা বলেন। পদত্যাগ করলেও পরে পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে তাকে দফতরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে রাখা হয়। যে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত লাগামহীনভাবে মানুষের সমালোচনা করেন, মুখ ভেংচিয়ে বক্তব্য রাখেন সেই ব্যক্তি ঘুষ কেলেঙ্কারির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে মন্ত্রিত্ব হারিয়ে এক মাস ঘরে বসে থাকেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ঘুষ কেলেঙ্কারির ঘটনায় ৭০ লাখ টাকা নিয়ে ধরা পড়লেও এ প্রসঙ্গে অনেকেই অনেক কথা বলেন। বিষয়টি নিয়ে হোটেল রেস্তোরাঁয়, গাড়িতে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে মুখরোচক আলোচনা হয়। এ ঘটনার পর সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে অনেকে ‘কালো বিড়াল’ বলে অভিহিত করে থাকেন।

এ ঘটনার পর থেকে আওয়ামী লীগের নেতারা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সম্পর্কে নানা ধরনের মন্তব্য করেন। নেতারা বলেন, সুরঞ্জিত এখন আওয়ামী লীগের বোঝা। এই লোকটি দল ও সরকারের চরম ক্ষতি করল। নিজেও ডুবল দলও ডুবাল। রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএসের গাড়ি থেকে ৭০ লাখ টাকা উদ্ধারের পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বিপাকে পড়েছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে বর্তমান সরকার যতটুকু সোচ্চার ছিল সুরঞ্জিতের ঘটনার পর সরকার আর ততটুকু সোচ্চার থাকতে পারবে কি না তা নিয়েও দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে নানা আলোচনা হয়।

তদন্ত শেষ হওয়ার পর অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনায় পদত্যাগী মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তদন্ত রিপোর্ট সম্পর্কে প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্তে স্পষ্ট হয়েছে আমি নির্দোষ। তদন্ত কমিটি আমার কোনো দোষ খুঁজে পায়নি। এর আগে পদত্যাগ করার সময় আমি বলেছিলাম তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকেও বিরত থাকব। সে কারণে গত এক মাস রাজনীতি, সমাজনীতি সব কিছু থেকেই বিরত ছিলাম। তদন্ত শেষ হয়েছে তাই এক মাস এক দিন পর আমি আবার রাজনীতিতে ফিরে যাচ্ছি। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাজনীতিতে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি আমার; আর মন্ত্রিত্বের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।

সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ছেলে সৌমেনের দুর্নীতি নিয়েও মিডিয়ায় প্রচার প্রচারণা চলে এ বছর। পত্রপত্রিকায় প্রচার হয়, তাকে টেলিকমিউনিকেশন্স লাইসেন্স দেয়ায় সরকারের কয়েক কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।





ইলিয়াস আলী গুম

মঈনউদ্দিন খান

প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ২০১২ সালজুড়েই ছিল সরকারের রোষানলে। মামলা-হামলার শিকার হয়েছেন দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী। আর জেলের ঘানি টেনেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপি ও ১৮ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতারা। এপ্রিল ও ডিসেম্বরে দু’টি বড় কর্মসূচিতে নিহত হয়েছেন আটজন নেতাকর্মী। বিপক্ষের হামলা-গুলিতে বছরজুড়ে সারা দেশে নিহত হয়েছেন আরো কয়েকজন নেতা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহালের দাবিতে বিএনপি এ বছর বেশ কিছু কর্মসূচি পালন করলেও উল্লেখযোগ্য কোনো সফলতা আসেনি।

২০১২ সালের শুরুতেই ৯ জানুয়ারি তত্ত্বাবধায়ক দাবিতে চট্টগ্রাম অভিমুখে রোডমার্চ করেন খালেদা জিয়া। ১০ জানুয়ারি চট্টগ্রামের সমাবেশ থেকে ২৯ জানুয়ারি ঢাকায় গণমিছিল ও ১২ মার্চ ঢাকায় সমাবেশ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এরপর রাষ্ট্রপতির সাথে সংলাপে বসেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। ১২ জানুয়ারি ওই সংলাপে খালেদা জিয়া সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা আবার বহালের দাবি জানান।

২৯ জানুয়ারি সারা দেশে বিএনপির গণমিছিল কর্মসূচি নিয়ে বেশ উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। একই দিন রাজধানীতে আওয়ামী লীগ বিক্ষোভ কর্মসূচি দেয়ায় বিএনপি গণমিছিল এক দিন পিছিয়ে ৩০ জানুয়ারি করে। ওই দিন সারা দেশে পুলিশের গুলিতে চারজন বিএনপি কর্মী নিহত হন।

ঢাকায় ১২ মার্চের মহাসমাবেশকে ঘিরে সরকার লঙ্কাকাণ্ডের জন্ম দেয়। সমাবেশের তিন দিন আগে থেকে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। লঞ্চ, বাস, ট্রেন সব বন্ধ করে দেয়া হয়। রাজধানীর হোটেলগুলোতে থাকার ওপর জারি করা হয় নিষেধাজ্ঞা। তার পরও সমাবেশ ঘিরে নামে জনতার ঢল। ওই সমাবেশ থেকে তত্ত্বাবধায়ক বহালে তিন মাসের আলটিমেটাম দেয়া হলেও তা আমলে আনেনি সরকার।

৮ এপ্রিল নির্বাহী কমিটির সভা থেকে বিএনপি আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। এর কিছু দিন পরই গুম হন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি এম ইলিয়াস আলী। ১৭ এপ্রিল মধ্য রাতে ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার পর থেকে রাজনীতি ফের উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বিএনপি টানা হরতালের পথ বেছে নেয়। সারা দেশে তৈরি হয় সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি। সরকার হার্ডলাইন নিয়ে বিরোধী দলের ওপর মামলা-হামলা শুরু করে। হরতালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে গাড়ি পোড়ানো মামলায় বিএনপিসহ ১৮ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের নজিরবিহীনভাবে জেলে ঢোকানো হয়। এ দফায় জেল খাটেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, এম কে আনোয়ার, মির্জা আব্বাস, হান্নান শাহ, গয়েশ্বর রায়, সাদেক হোসেন খোকা, আমানউল্লাহ আমান, রিজভী আহমেদ, ফজলুল হক মিলন, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, নাজিম উদ্দিন আলম, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, এলডিপির চেয়ারম্যান অলি আহমদ, বিজেপির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ, জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, এনপিপি চেয়ারম্যান শেখ শওকত হোসেন নীলুসহ বিএনপি ও জোটের শীর্ষ নেতারা।

৭ জুন তাদের বেশির ভাগের মুক্তির পর ১১ জুন তরিকুল ইসলামের সমন্বয়ে ঢাকায় ফের সমাবেশ করে ১৮ দলীয় জোট। এপ্রিল-মে মাসজুড়েই চলে বিরোধীদলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতারপ্রক্রিয়া।

এরপর রমজান চলে আসায় আন্দোলনে আসে অবকাশ। কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে মনোযোগ দেয় বিএনপি। ১৪ অক্টোবর সাত দিনের সফরে চীনে যান খালেদা জিয়া। পরে ২৯ অক্টোবর সাত দিন ভারত সফর করেন বিরোধীদলীয় নেতা।

দুই দেশ সফরের পর আবার আন্দোলনমুখী হয় বিএনপি। ২৮ নভেম্বর ঢাকায় সমাবেশ হয় ১৮ দলের। ওই সমাবেশ থেকে ৯ ডিসেম্বর সারা দেশে অবরোধ কর্মসূচি দেয়া হয়, যা ছিল চার বছরের মধ্যে বিরোধী দলের সবচেয়ে শক্ত কর্মসূচি। এই কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে বিএনপি-জামায়াতের চার নেতাকর্র্মী নিহত হন। এরই জের হিসেবে ১০ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় দ্বিতীয় দফায় গ্রেফতার হন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এখনো জেল খাটছেন তিনি। নতুন বছরে বিএনপি আন্দোলনে আরো বেশি আক্রমণাত্মক হবে, এমন কথা বলছেন দলের নেতারা।





পদ্মা সেতু ও আবুল কাহিনী

সৈয়দ সামসুজ্জামান নীপু

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশর সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প বিবেচনা করা যায় পদ্মা সেতু প্রকল্পকে। অর্থের সংস্থান রয়েছে প্রায় ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার। এটি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের স্বপ্নের সেতু, এই মানুষেরা সব সময় ভেবে এসেছেন কবে পদ্মা নদীর ওপর সেতু হবে, কবে তাদের যাত্রা নিরাপদ ও দ্রুত হবে, কবেই বা তারা সেতুর দাক্ষিণ্যে উন্নয়নের ছোঁয়া পাবেন। প্রায় সব সরকারই প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে পদ্মার ওপর সেতু নির্মাণ করার। আর এসব কারণে ২০০৪ সালে প্রথম সেতু নির্মাণের প্রাথমিক কাজ শুরু করা হয়। ২০০৪ সালে বিস্তারিত সমীার পর মাওয়া-জাজিরা প্রান্তে পদ্মা  সেতু নির্মাণের পরামর্শ দেয় জাপানি সংস্থা জাইকা। সে অনুযায়ী কাজও এগিয়ে চলে। ২০০৭ সালে ১০ হাজার কোটি টাকার পদ্মা সেতু  প্রকল্প প্রস্তাব একনেকে অনুমোদন করা হয়।

২০০৯ সালের ৯ জানুয়ারি বিস্তারিত নকশা প্রণয়নের জন্য পরামর্শক নিয়োগের প্রক্রিয়া ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি অনুমোদন করে। ২ ফেব্রুয়ারি শুরু হয় নকশা প্রণয়নের কাজ। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংকের  সাথে সরকার আলোচনা চালিয়ে যায় অর্থ পাওয়ার আশায়। এক সময় পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য দরপত্র আহ্বান করে সরকার। কিন্তু এতে আপত্তি দেয় বিশ্বব্যাংক, প্রত্যাহার করে নেয়া হয় দরপত্র। ২০১০ সালে ১১ অক্টোবর আবার দরপত্র আহ্বান করা হয়। তারপরের বছর ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি সেতু প্রকল্পের সংশোধিত প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় অনুমোদন করিয়ে নেয়া হয়। একই বছর ২৪  ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাংকের বোর্ড সভায় ১২০ কোটি ডলারে ঋণ চুক্তি অনুমোদন করা হয়।

২০১১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টির একটি গোপন তারবার্তা ফাঁস করে দেয় উইকিলিকস। সেখানে মরিয়ার্টি যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন সম্পর্কে মন্তব্য করেন, এই লোকটির সততায় ঘাটতি রয়েছে (দিজ পারসন ইজ লেস দেন অনেস্ট)। মানুষের পারসেপসন্স বলে একটি কথা রয়েছে, এই পারসেপসন্স বলে আবুল হোসেন সৎ ব্যক্তি নন। কারণ ১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়  ছিল তখন মন্ত্রী থাকা অবস্থায়  দু’টি পাসপোর্ট ব্যবহার করায় তার মন্ত্রিত্ব তখন খোয়া যায়।

আবুল হোসেন সম্পর্কে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এই মন্তব্য প্রকাশ হওয়ার পর গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর মূল সেতু ও তদারকি পরামর্শক নিয়োগ বিষয়ে দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক প্রথমে অর্থমন্ত্রীর কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। এখানে সংস্থাটির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, এসএনসি লাভালিন নামে একটি কানাডিয়ান পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য সরকারের কিছু পদস্থ কর্মকর্তা ঘুষ দাবি করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, বিশ্বব্যাংকের এই চিঠিতে তিনজন লোকের নাম উল্লেখ করা ছিল। এরা হলেন, যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন, তৎকালীন সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া ও পদ্মা সেতু প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলাম। এতে বাংলাদেশী মুদ্রায় ঘুষ চাওয়ার পরিমাণ ছিল ৩৮ কোটি টাকা। সরকার প্রথম দিকে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির এই অভিযোগকে পাত্তাই দিতে চায়নি। পরে চাপে পড়ে ২০১১ সালের ৯ অক্টোবর প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলামকে অপসারণ করা হয়। এরপর গত ১৩ অক্টোবর সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে বদলি করা হয়। কিন্তু বহাল তবিয়তেই রয়ে যান আবুল হোসেন। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সাথে সুসস্পর্ক থাকার কারণে তার এই টিকে থাকা। কিন্তু তারপরও শেষ রক্ষা হয় না। কারণ দুর্নীতির তদন্ত না করার কারণে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে সেতু প্রকল্পের ঋণচুক্তি স্থগিত রাখার ঘোষণা করা হয়।

সরকার যখন দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেয়েও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে এগিয়ে আসেনি, তখন গত ২৯ জুন বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি বাতিলের ঘোষণা দেয়। এরপর বিশ্বব্যাংকের সাথে ঋণচুক্তি পুনবর্হালের জন্য আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকে সরকার। পরে বিশ্বব্যাংক ২১ সেপ্টেম্বর ঘোষণা দেয় তারা নতুন করে পদ্মা সেতুতে সম্পৃক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েেেছ।

এরপর পদ্মা সেতু নিয়ে দুদক পরিচালিত দুর্নীতি কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে চার সদস্যের একটি আন্তর্জাতিক প্যানেল বাংলাদেশে দু’দফা সফর করে। এর নেতৃত্বে ছিল হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক প্রধান কৌঁসুলি লুই গ্যাব্রিয়াল ওকাম্পো। দুদকের সাথে আলোচনায় প্যানেলটি সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন ও এসএনসি লাভালিনের লবিস্ট আবুল হাসান চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা করার সুপারিশ করে। কিন্তু দুদক এ দু’জনকে বাদ দিয়েই গত মাসে মোট আটজনের বিরুদ্ধে মামলা করে। তবে বিশ্বব্যাংক এখনো বলেনি তারা এ সেতুতে অর্থায়ন করবে কি না।





ব্যাংক কেলেঙ্কারি

আশরাফুল ইসলাম

দেশের ব্যাংকিং খাতে স্মরণকালের ভয়াবহতম কেলেঙ্কারি হয়েছে বিদায়ী বছরে। ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে সোনালী ব্যাংক থেকে হাতিয়ে নেয়া হয় চার হাজার কোটি টাকা। হলমার্ক নামক একটি অখ্যাত কোম্পানি সোনালী ব্যাংক থেকে এ বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয় বিদায়ী বছরটিতে। এর সাথে জড়িয়ে পড়ে আরো ২৬টি বেসরকারি ব্যাংক। এর বাইরে আরো এক হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারি ধরে পড়ে সোনালী ব্যাংকে। তা ছাড়া জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও কৃষি ব্যাংক থেকেও কয়েক হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারি উদঘাটন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। অগ্রণী ব্যাংকের সরকার সমর্থিত কর্মচারী সংগঠনের নেতাদের ১০০ বস্তা ফাইল গায়েব করা, রাজনৈতিক বিবেচনায় আবারো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে পরিচালক নিয়োগ, বিদেশী ঋণদানকারী সংস্থা, সাবেক ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদদের বিরোধিতা সত্ত্বেও ৯ রাজনৈতিক ব্যাংকের অনুমোদনের মতো ঘটনাগুলো দেশের ব্যাংক খাত নিয়ে আলোচনায় ছিল সারা বছর।

ব্যাংক খাতের অভিশাপ হলমার্ক : চীনের দুঃখ যেমন হোয়াং হো নদী, তেমনি ব্যাংক খাতের দুঃখ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে হলমার্ক কোম্পানি। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাথমিক তদন্তে অখ্যাত এ কোম্পানিটি সোনালী ব্যাংক থেকে চার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার তথ্য উন্মোচিত হয়েছে। এর সাথে সোনালী ব্যাংকের প্রায় তিন ডজন কর্মকর্তাকে আইনের আওতায় আনা হলেও নেপথ্যের নায়কেরা এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। হলমার্কের হাতিয়ে নেয়া অর্থের গন্তব্য নিশ্চিত করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক বা দুর্নীতি দমন কমিশন। হাতিয়ে নেয়া অর্থ দেশে রাখা হয়েছে না বিদেশে পাচার করা হয়েছে, হলমার্কের হাতিয়ে নেয়া অর্থের প্রকৃত সুবিধাভোগী কারা, কাদের অ্যাকাউন্টে টাকা চলে গেছে তা এখনো অজানা রয়ে গেছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, হলমার্কের হাতিয়ে নেয়া অর্থের পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এ বিষয়ে ব্যাপক তদন্ত করা হয়নি বলে ওইসব কর্মকর্তা অভিযোগ করেছেন। হলমার্ক কেলেঙ্কারি ধরা পড়ার পর অর্থমন্ত্রণালয়ের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার দায়ে সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়ার পরামর্শ দেয়া হলেও সে পরামর্শের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করে অর্থমন্ত্রণালয়। উপরন্তু বাংলাদেশ ব্যাংককে যথাসময়ে ঋণের অনিয়ম বের করতে না পারার জন্য দোষারোপ করে অর্থমন্ত্রণালয়। এর বাইরে সরকারি মালিকানাধীন প্রায় প্রতিটি ব্যাংকেই ঋণ কেলেঙ্কারি হয় বিদায়ী বছরে, যা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তদন্ত করা হয়।

১০০ বস্তা ফাইল গায়েব : গত জুন মাসে প্রকাশ্য দিবালকে অগ্রণী ব্যাংকের মতিঝিলের প্রধান কার্যালয় থেকে এক শ’ বস্তা ফাইল লিফট দিয়ে নামিয়ে ট্রাকে করে সরিয়ে নেয়া হয়। এই ঘটনার সাথে জড়িত ছিলেন সরকারপন্থী  কর্মচারী ইউনিয়নের ছয় সদস্য। নেপথ্যে ছিলেন অগ্রণী ব্যাংকের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকটি  ফাইল গায়েবের সাথে জড়িতের কয়েকজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা ছাড়া আর কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এমনকি এত বিশাল ঘটনা ঘটলেও থানায় কোনো মামলা পর্যন্ত করেনি অগ্রণী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।  এক শত বস্তা ফাইলের মধ্যে বেশ কয়েক বস্তা ফাইল উদ্ধার করা সম্ভব হলেও বেশির ভাগ ফাইল আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।





ছাত্রলীগের তাণ্ডব

আমানুর রহমান

শিক্ষাঙ্গনজুড়ে ২০১২ সালে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ছাত্রলীগ। দেশের সব কয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ সরকারি কলেজে তাদের নৈরাজ্য, অরাজকতা, সন্ত্রাস আর নৃশংসতায় কয়েকজন মেধাবী ছাত্র খুন হন। পুরো বছরই কোনো-না-কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা সরকারি কলেজে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে অথবা প্রতিপক্ষের ওপর হামলায় কিংবা কোনো টেন্ডারবাজির কারণে শিক্ষাকার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। আতঙ্ক ছড়িয়েছে ক্যাম্পাসজুড়ে। শুধু ছাত্রলীগের নৈরাজ্যই নয় বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার সমর্থক শিক্ষকদের দলাদলি আর পদ দখল এবং দলীয় বিবেচনায় নিয়োগকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ক্যাম্পাস ছিল উত্তপ্ত। শিক্ষকদের দখলবাজি ও দলীয়-আত্মীয়স্বজনকে নিয়োগ দেয়ার পাশাপাশি এক ভিসি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাবর সম্পত্তিও বিক্রি করে দিয়েছেন। এরূপ হাজারো কারণে শিক্ষাঙ্গনের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও শিক্ষার পবিত্র স্থানগুলো কলুষিত হয়েছে। দলীয়করণ আর ছাত্রলীগের অরাজকতায় দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় দিনের পর দিন মাসের পর মাস বন্ধ থেকেছে। সাধারণ ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীরাও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশের দাবিতে প্রতিবাদ মুখর হলে তাদের নানাভাবে হয়রানি করা হয়।

উচ্চ শিাঙ্গনের নানা অচলাবস্থা নিরসনে এবং শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ না নিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষকদের পরিবর্তে নতুন শিক্ষক নিয়োগেরও হুমকি দেয়া হয়েছে নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে।

আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ ছাত্রদলকে গত চার বছরই ক্যাম্পাস ছাড়া করে রেখেছে। ছাত্রদলের শীর্ষ নেতারা এ ব্যাপারে ভিসির সাথে কথা বলতে চাইলে ভিসি অফিসের কাছেই ছাত্রদলের সভাপতিসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের ওপর প্রাকাশ্যে হামলা করে ছাত্রলীগ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ একইভাবে শিবিরের ওপর হামলা করে পাঁচজনকে গুলিবিদ্ধ করে। পরিস্থিতি শান্ত করতে গিয়ে লাঞ্ছিত হন প্রক্টোরিয়াল বডির ছয় সদস্য। সিলেট এমসি কলেজ থেকে ছাত্রশিবির বিতাড়নের নামে ছাত্রলীগ ঐতিহ্যবাহী কলেজটির ছাত্রাবাসের চারটি ভবনের শতাধিক ক জ্বালিয়ে দেয়। সবচেয়ে নৈরাজ্যকর ও নজিরবিহীন ঘটনা ছিল গত বছর  বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট)। প্রতিষ্ঠার পর এই প্রথমবারের মতো বুয়েটে দলীয় পরিচয়ে ভিসি ও প্রো-ভিসি নিয়োগ দিয়ে চূড়ান্ত পরীক্ষায় ভিন্ন মতের শিক্ষার্থীদের ফলাফল টেম্পারিংসহ নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনার আশ্রয় নেয়া হয়। প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ডিন ও বিভাগীয় প্রধানগণ গণপদত্যাগের মতো ঘটনা ঘটার পর সরকারের শীর্ষপর্যায়  থেকে সব অনিয়মকেই সমর্থন করা হয়েছে। আন্তর্জাতিকপর্যায়ে স্বীকৃত দেশের একমাত্র উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিকেও করে ফেলা হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ ।

নিয়োগবাণিজ্যকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া অস্থিরতায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) অচল ছিল প্রায় চার মাস। পরীা স্থগিত হয়েছে সাড়ে তিন শ’। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসে নিরাপত্তাহীনতায় ছিলেন সাধারণ শিক ও শিার্থীরা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হামলায় প্রাণ হাগ্রণ দুই শিবির নেতা। গত ৮  ফেব্রুয়ারি এ ঘটনা ঘটে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ অক্টোবর ছাত্রলীগ হামলা চালায় ছাত্রশিবিরের ওপর। পদ্মা সেতুর চাঁদা  তোলাকে কেন্দ্র করে ১৫ জুলাই সন্ধ্যায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে সাধারণ সম্পাদকের সমর্থক সোহেল রানা গুলিবিদ্ধ হয়ে  পরদিন মারা যান।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হামলায় নিহত হন ইংরেজি বিভাগের শেষ বর্ষের মেধাবী ছাত্র জুবায়ের আহমেদ। দলাদলি আর নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা জটিলতায় বছরজুড়ে ছিল এখানে অচলাবস্থা। শিক্ষক-ছাত্রদের লাগাতার আন্দোলনের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হন ভিসি অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির। নতুন ভিসি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন দায়িত্ব নেয়ার পরও পরিস্থিতি শান্ত হয়নি।

রাজধানীতে অবস্থিত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৩৪ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কয়টিতেই সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে প্রতিনিয়তই সংঘর্ষ হয়েছে এবং প্রতিপক্ষের ওপর হামলাসহ সহিংস ঘটনা ঘটেছে। শুধু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েই ১১ বার অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে প্রতিপক্ষের ওপর হামলা হয়েছে। এ কারণে তিন দিনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে হয়েছিল কর্তৃপক্ষকে। এ ছাড়া লাগাতার অচলাবস্থা ছিল যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। টেন্ডার ও চাঁদাবাজির সুযোগের দাবিতে ছাত্রলীগ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত ভিসিদেরও অপসারণের দাবিতে ক্যাম্পাসে অচলাবস্থার সৃষ্টি করেছে। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এর মধ্যে অন্যতম।

ছাত্রলীগের নৃশংসতার সর্বশেষ নজির হচ্ছে গত ৯ ডিসেম্বর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতাদের নির্দেশে হরতালের মধ্যে বিশ্বজিৎ দাস নামে এক যুবককে প্রকাশ্য দিবালোকে চাপাতি ও রড দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা।





সাগর-রুনি ও বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড

আবু সালেহ আকন

থেমে গেছে বহুল আলোচিত সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত। এই ঘটনায় সন্দেহভাজন সাতজনের গ্রেফতারের কথা বলা হলেও এখন তা নিয়ে কোনো কথা বলছে না সংশ্লিষ্টরা। তবে একটি সূত্র বলেছে, পাঁচজন গ্রিলকাটা চোর এবং রুনির পরিচিত তানভীর রহমান আবীর ও নিরাপত্তা কর্মী পলাশ রুদ্র পালসহ সাতজনের ডিএনএ প্রসেস ও কিছু আলামতের রিপোর্ট পেতে বিলম্বের কারণে পিছিয়ে গেছে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা রহস্য উদঘাটনের তদন্ত কার্যক্রম। প্রায় আড়াই মাস আগে সাতজনের ডিএনএ নমুনা এবং কিছু আলামত প্রসেসের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রাইভেট ল্যাবে পাঠানো হলেও এখনো কোনো খবর নেই। এ দিকে এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিভিন্ন সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্তাদের বক্তব্য ব্যাপক আলোচিত হয়। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন খুনিদের গ্রেফতার ও রহস্য উদঘাটনে ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিলেও প্রায় ১১ মাসেও উদঘাটন হয়নি সাগর-রুনি হত্যার রহস্য।

হত্যাকাণ্ডের প্রায় আট মাস পরে ডা: নারায়ণ হত্যা মামলায় গ্রেফতার হওয়া অন্তত সাতজনকে সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলে সন্দেহ হয় মামলার তদন্তকারী সংস্থার। তাদের মধ্যে পাঁচজনকে গ্রেফতার দেখানো হয়। সেই সাথে গ্রেফতার করা হয় রুনির কথিত বন্ধু তানভীর এবং বাড়ির দারোয়ান রুদ্রপালকে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহিউদ্দীন খান আলমগীর এই সাতজনকে সাগর-রুনির সন্দেহভাজন খুনি হিসেবে উল্লেখ করেন। তবে বিষয়টি মানতে নারাজ সাগর-রুনির পরিবার এবং তাদের সহকর্মীরা। তাদের অভিযোগ আসল ঘটনা আড়াল করতেই নাটক সাজানো হচ্ছে। আসল খুনিদের বাঁচাতে গ্রেফতার করা হয়েছে অন্যদের।

উল্লেখ্য, গত ১০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ৫৮/১/২ নম্বর পশ্চিম রাজাবাজারের বহুতল ভবন ‘রশিদ লজ’ নামে ভাড়া ফ্যাটে খুন হন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ও তার স্ত্রী এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনি। পর দিন তাদের ক্ষত বিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ নিজেদের ব্যর্থতার দায় স্বীকার করার পর চাঞ্চল্যকর এই সাংবাদিক দম্পতি হত্যারহস্য উদঘাটনে হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে তদন্তের জন্য র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র‌্যাব) দায়িত্ব দেন। র‌্যাব সাত মাস ধরে তদন্ত করেও কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি। এ দিকে সাংবাদিকেরা কঠোর আন্দোলনের হুমকি দিলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ওই সাতজনকে সন্দেহভাজন গ্রেফতার হিসেবে উল্লেখ করে মিডিয়ার সামনে বক্তব্য রাখেন। সাংবাদিক নেতারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, সাগর-রুনি হত্যার আসল রহস্য উদঘাটন করতে হবে এবং প্রকৃত খুনিদের গ্রেফতার করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

বিশ্বজিৎ হত্যা : প্রকাশ্যে কুপিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনা আগেও ঘটেছে। তবে বিশ্বজিৎ হত্যার ঘটনাটি কিছুটা ব্যতিক্রমী। যার সাথে জড়িত রয়েছে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে পাস করা যুবকেরা। অনেকে আবার অনার্স বা মাস্টার্সে পড়ছেন। তারা সবাই সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সাথে সম্পৃক্ত। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সংবাদকর্মীদের চোখের সামনে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় নিরীহ যুবক বিশ্বজিৎ দাসকে। এই ঘটনায় মোট ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে চারজন ইতোমধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। তারা বলেছে, বিরোধী দলের অবরোধ কর্মসূচিকে ঘিরে যারা রাস্তায় নামবে তাদের শায়েস্তা করার অংশ হিসেবেই বিশ্ববিজৎকে তারা হত্যা করে।

গত ৯ ডিসেম্বর ১৮ দলীয় জোটের অবরোধ কর্মসূচি চলাকালীন রাজধানীর ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকায় ছাত্রলীগ কর্মীরা পিটিয়ে ও কুপিয়ে বিশ্বজিৎ দাস নামে ওই ব্যবসায়ী যুবককে হত্যা করে। সকালে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের একটি মিছিল বের হলে সেই মিছিলে হামলা চালায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এই হামলার কয়েক মিনিটের মধ্যে সেখানে একটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। ছাত্রলীগ ধর ধর বলে চিৎকার করে ওঠে। এতে সাধারণ পথচারীরা তখন দৌড়ে পালায়। বিশ্বজিৎ স্থানীয় একটি কিনিকের দোতলায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। সেখানে উঠে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করে। বিশ্বজিতের বাসা লক্ষ্মীবাজারে। সেখান থেকে হেঁটে তিনি শাঁখারী বাজারের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছিলেন।

বিশ্বজিতের খুনিরা ধরা পড়ে যায় ক্যামেরায়। ঘটনার পর খুনিদের ছবি বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। সেখান থেকে শনাক্ত করা হয় অন্তত ২০ জন ছাত্রলীগ কর্মীকে। যাদের মধ্যে কেউ কেউ কুপিয়েছে, কেউ লাঠি বা রড দিয়ে পিটিয়েছে, কেউ কিল-ঘুষি ও লাথি মেরেছে। আবার অনেকে মারতে গিয়েও সুযোগ না পেয়ে চলে গেছে। পুলিশ এই খুনিচক্রের মধ্যে সাতজনকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করেছে। তারা হলো  রফিকুল ইসলাম শাকিল, মাহফুজুর রহমান নাহিদ, রাশেদুজ্জামান শাওন, এইচএম কিবরিয়া, কাইউম মিয়া টিপু, সাইফুল ইসলাম ও এমদাদুল হক। তারা সবাই ছাত্রলীগ কর্মী। আরো চারজনকে পুলিশ সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে শাকিল, নাহিদ, শাওন ও এমদাদুল হক আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। বাকি তিনজন এখনো পুলিশ রিমান্ডে রয়েছে।

ঘটনার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ৯ জনের ছাত্রত্ব ও সনদ বাতিল করেছে। ক্যাম্পাস সূত্র জানায়, এই ঘটনায় ওবায়দুল কাদের তাহসিন, মীর মোহাম্মদ নুরে আলম লিমন, ইউনূছ, জনি, শিপলু, রাজন চন্দ্র তালুকদার, মেহেদী হাসান, রফিকুল ইসলাম ওরফে কালা রফিক, আজিজুর রহমান, আব্দুল্লাহ আল মামুন, পাভেল হাসান, আলাউদ্দিন, মোস্তফা ও তমালসহ আরো বেশকিছু ছাত্রলীগ নেতাকর্মী জড়িত রয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে তাদেরকেও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

স্বীকারোক্তিতে ছাত্রলীগ কর্মীরা বলেছে, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শরিফুল ইসলাম এবং সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলামের নির্দেশেই এই খুনের ঘটনা ঘটেছে।





তাজরীনের কান্না

জিয়াউল হক মিজান

বছরজুড়ে অগ্নিকাণ্ডের অনেক ঘটনাই ঘটেছে। পুলিশের সাথে সংঘর্ষে কিংবা যানবাহনের নিচে চাপা পড়ে নিহত হয়েছেন অনেক তৈরী পোশাক শ্রমিক। কিন্তু ২১ নভেম্বর রাজধানীর অদূরে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ছিল স্মরণকালের ইতিহাসে ভয়াবহতম দুর্ঘটনা। নিহত ১২১ শ্রমিকের স্বজনদের পাশাপাশি এ ঘটনা কাঁদিয়েছে পুরো দেশবাসীকে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এ ঘটনায় একটি দায়সারা তদন্ত হলেও সরকারের আগাম ‘ষড়যন্ত্র’ ঘোষণায় প্রকৃত সত্য চাপা পড়ে গেছে আর দশটি ঘটনার মতোই।

তাজরীন অগ্নিকাণ্ড কেবল ১২১ শ্রমিককে পুড়ে অঙ্গারই করেনি, এ ঘটনায় পুড়েছে রফতানি আয়ে ৭৮ শতাংশ অবদান রক্ষাকারী বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্প খাতের ভাগ্যও। ঘটনার পর বিশ্বখ্যাত চেইন স্টোর ওয়ালমার্ট বাংলাদেশে তার চলমান কার্যাদেশ বাতিল করেছে। নড়েচড়ে বসে বাংলাদেশের শ্রমপরিবেশ নিয়ে কাজ করে এমন এনজিওগুলো। আরেকবার গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প খাত ভালো করলে যাদের স্বার্থ ুণœ হয় সেসব রফতানিকারক দেশও। সর্বোপরি বিশ্বমন্দা এবং চীনাদের ব্যবসায় পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের পোশাক খাতের যে অবিস্মরণীয় ও ঝলমলে উত্থান দেখা দিচ্ছিল তাতে ছাই দিয়েছে এই তাজরীন অগ্নিকাণ্ড।

বিভিন্ন স্তরের উদ্যোক্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাজরীন ফ্যাশনসের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে সম্ভাবনাময় এ শিল্পে বড় ধরনের ঝাঁকুনি লেগেছে। নড়েচড়ে বসেছে ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদফতর ও শ্রম অধিদফতরসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সব বিভাগ। এ ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে পাঁচ সহস্রাধিক উদ্যোক্তার মাঝে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় কাটছে এ শিল্প খাতে উদ্যোক্তাদের প্রতিটি মুহূর্ত। তবে যে কারখানাকে কেন্দ্র করে এমন উত্তেজনা সেই তাজরীন ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার হোসেন রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। জোর তৎপরতায় তাকে রক্ষা করেছেন বিজিএমইএ নেতারা।

গার্মেন্ট মালিকের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাজরীন দুর্ঘটনার পর থেকে তারা এখন বিভিন্ন আতঙ্কে ভুগছেন। কোন কর্তৃপক্ষ কখন এসে কারখানা বন্ধ করে দেয়, কখন পুলিশ এসে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়, কখন উত্তেজিত শ্রমিকেরা এসে কারখানা ভাঙচুর করেনÑ এমন আতঙ্ক এখন সবার মাঝে। এ প্রসঙ্গে আলাপকালে জয়দেবপুরের ডটকম সোয়েটার ফ্যাক্টরির উদ্যোক্তা শামীম আহমেদ গতকাল নয়া দিগন্তকে জানান, সারা জীবনের সব সঞ্চয় দিয়ে কারখানা করে আমরা এখন আতঙ্কে ঘুমাতে পারি না। তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে বিভিন্ন সমস্যার কারণে এমনিতেই আমরা সঙ্কটে আছি। তার ওপর নতুন করে আগুনভীতি আমাদের চরম হতাশায় ফেলেছে। দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে মালিকদের ব্যাংকঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে মরতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

শিল্পমালিকদের মাঝে সৃষ্ট হতাশা দূর করে তাদের মাঝে সাহস জোগানোর লক্ষ্যে পরের সপ্তাহে বিশেষ সাধারণ সভা ডাকে বিজিএমইএ। নিজস্ব কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ সভায় সভাপতিত্ব করেন বিজিএমইএ সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। দীর্ঘ এ সভায় প্রচারমাধ্যমের তীব্র সমালোচনার পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকেও দায়ী করা হয়। সভা শেষে বিজিএমইএ সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন জানান, পোশাক শিল্প খাতের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। টাস্কফোর্স বিভিন্ন কারখানা পরিদর্শন শেষে প্রয়োজনে বন্ধ করে দেয়ার ক্ষমতা রাখবে। বন্ধ করতে না পারলেও যেসব কারখানায় কাজের উপযুক্ত পরিবেশ থাকবে না সেগুলোর ইউডি ইস্যু বন্ধ করে দেবে বিজিএমইএ। পাশাপাশি সব শ্রমিকের জন্য সার্ভিস বুক চালু করা, শ্রমিকদের কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ গঠন করা, ফিঙ্গার প্রিন্ট চালু করাসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানান তিনি।





সংসদ-বিচার বিভাগ মুখোমুখি

ফয়েজ উল্লাহ ভূঁইয়া

বিচারপতি সামসুদ্দিন মানিককে কেন্দ্র করে সংসদ ও বিচার বিভাগের মুখোমুখি হওয়ার ঘটনা ২০১২ সালের অন্যতম আলোচিত ঘটনা। হাইকোর্ট সংলগ্ন সড়ক ভবন অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার বিষয়ে বহুল আলোচিত এই বিচারপতির একটি আদেশের বিষয়ে সংসদে মন্তব্য করে ব্যক্তিগত আক্রমণের শিকার হন স্পিকার আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট।

সংসদের ১৩তম অধিবেশনে গত ২৯ মার্চ স্পিকার বিচারপতি মানিকের আদেশের ব্যাপারে মন্তব্য করেন। পয়েন্ট অব অর্ডারে সড়ক ভবন সরিয়ে নেয়া প্রসঙ্গে এক সংসদ সদস্যের দৃষ্টি আকর্ষণীর ইতি টানতে গিয়ে স্পিকার বলেন, দেশের একটি সুপ্রিম পাওয়ার যদি এ রকম আচরণ করে, তড়িঘড়ি করে সরকারের একটি বিভাগকে এভাবে সরিয়ে দেয় তা হলে পুরো সরকারই প্যারালাইজড হয়ে যাবে। দেশের অন্য মানুষের বিচারের ক্ষেত্রে বছরের পর বছর লেগে যাবে আর নিজেদের বিষয় বলে বিচার বিভাগ ঝটপট সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবে এটি ভালো দেখায় না। কোর্টের বিচারে (রায়ে) জনগণ যদি ুব্ধ হয় তাহলে বিচারকের বিরুদ্ধে এক সময় রুখে দাঁড়াতে পারে। তিনি বলেন, সবাই যদি মনে করি ক্ষমতা পেয়েছি বলে যা ইচ্ছা তাই করব, এটা ঠিক নয়।

স্পিকারের এই বক্তব্যের পর গত ৫ জুন হাইকোর্টের বিচারপতি সামসুদ্দিন মানিক স্পিকার ও সংসদ সম্পর্কে  হাইকোর্টের বেঞ্চে বিরূপ মন্তব্য করেন। তিনি স্পিকারের বক্তব্যকে রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক বলে মন্তব্য করেন। পাশাপাশি স্পিকারের যোগ্যতা ও অ্যাডভোকেটশিপ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ওই দিনই সন্ধ্যায় তার প্রতিক্রিয়ায় সংসদে মহাজোটের সিনিয়র সদস্যরা এর প্রতিবাদে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা এই বিচারপতিকে ‘স্যাডিস্ট’ মন্তব্য করেন। এই বিচারপতি সংসদের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত এবং প্রকারান্তরে সংসদ ও সংসদ সদস্যদের অপমান করেছেন বলে মন্তব্য করে তারা এই বিচারপতিকে অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করার জন্য রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ জানাতে তিন দিনের আলটিমেটাম দেন। গত ১৮ জুন স্পিকার এ ব্যাপারে রুলিং দেন। তাতে তিনি বলেন, বিচারপতি মানিক সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। তার বক্তব্য অশোভন ও ব্যক্তিগত আক্রমণপ্রসূত। তিনি বিষয়টি  প্রধান বিচারপতির ওপর ছেড়ে দেন।

পরে স্পিকারের রুলিং চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি রিট হয়। আর এতে একটি বেঞ্চ খোদ স্পিকারের রুলিংকেই অবৈধ ঘোষণা করে রুলিং দেন। ১৪তম অধিবেশনে ৪ সেপ্টেম্বর পয়েন্ট অব অর্ডারে এ নিয়ে আবার বিচার বিভাগের সমালোচনামুখর হন মহাজোটের সংসদ সদস্যরা। এ দিন সংসদ সদস্যরা বলেন, বিচারপতি সংবিধান লঙ্ঘন ও শপথ ভঙ্গ করেছেন। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি বিচারপতিদের ইমপিচমেন্টের ক্ষমতা আবার সংসদের ওপর ফিরিয়ে আনার অনুচ্ছেদ ৯৬ সংবিধানে ফিরিয়ে আনারও দাবি জানান। তারা স্পিকার সম্পর্কে ‘অশালীন’ মন্তব্যকারী বিচারপতি সামসুদ্দিন মানিকের অপসারণ করার দাবি জানান। তারা  স্পিকার এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা করে তার বক্তব্য দেবেন বলে জানান।

তারপর সরকারের পক্ষ থেকে আপিল করা হলে সেটিও খারিজ হয়ে যায়। সংসদের ১৫তম অধিবেশনে জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে স্পিকার বলেন, আইনমন্ত্রী বলেছেন এটা আপিল বিভাগের অবজারবেশন। তিনি এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানানোর পরই বক্তব্য দেবেন বলে স্পিকার জানান।





হুমায়ূনের বিদায়

নিজস্ব প্রতিবেদক

মানুষকে আনন্দ দেয়ার মধ্যেই যিনি নিজের জীবনের সুখ খুঁজে পেতেন, সেই কিংবদন্তি লেখক-নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ বিদায়ী বছরে ৬৪ বছর বয়সে ১৯ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের বেলভ্যু হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। ২৪ জুলাই অনেক তর্কের পর তাকে নূহাশপল্লীতে দাফন করা হয়। সেই সাথে তার ভাই মুহাম্মদ জাফর ইকবালের কথায় ‘হুমায়ূন অধ্যায়ের সমাপ্তি’। ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর কতুবপুর গ্রামে তার জন্ম। তার কথায় মধ্য রাতে জন্ম তার। ‘মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়েছে’ বলে ২০১১ সালের প্রকাশিতবাদশাহ নামদার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন সময় ঘনিয়ে আসছে।

বিবিসি  বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ২০১১ সালে তিনি বলেছিলেন, মৃত্যু এলে মানুষ বুঝতে পারে। শেষ নিঃশ্বাস ছাড়ার জন্য একটা প্রস্তুতি শুরু হয়। মানুষের মৃত্যুর সময় তার শরীরের প্রতিটি কোষ মরে যায়, সে বুঝতে পারে, এখনই তার মৃত্যু হবে। মৃত্যুর ঠিক এক ঘণ্টা আগেও তিনি লিখতে চেয়েছেন। বলেছেন, একটি লাইন লিখে যেতে চান। সে একটি লাইন কী? তাও তিনি ঠিক করে রেখেছেন বলে সাক্ষাৎকারে অর্চিকে জানিয়েছেন। তবে বেলভ্যু হাসপাতালে অচেতন থাকার আগে তিনি কোনো লেখা লিখে যেতে পারেননি। বলে যেতে পারেননি শেষ লাইনটি কী। মানুষ হয়তো সব সময় তার সব চাওয়া পূর্ণ করে যেতে পারেন না।

সাহিত্যের বরপুত্র হুমায়ূন আহমেদ তার লেখালেখি শুরু করেছিলেন ছাত্রজীবনে। নন্দিত নরকে তার প্রথম গ্রন্থ, যেটি প্রথম খবরের কাগজে প্রকাশিত হলে আহমদ ছফা এ গল্পটটি খুব পছন্দ করেন। তিনি নিজ উদ্যোগে এটি প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। খান ব্রাদার্স থেকে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এর ভূমিকা লিখেছেন পণ্ডিত আহমদ শরিফ। প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। বাংলা কথাসাহিত্যে ভারতীয় দখলদারিত্ব থেকে এক হাতে টেনে তুলেছিলেন তিনি। চার দশকজুড়ে তিনি একাই নেতৃত্ব দিয়েছেন। জিতেছেন একুশে পদক। তার লেখা প্রথম নাটক প্রথম প্রহর নওয়াজেশ আলী খান এটি বিটিভির জন্য নির্মাণ করেন। নওয়াজেশ স্মৃতিচারণ করে বলেন, নাটকটি হাতে পেয়ে আমি তো অবাক। ছোট ছোট বাক্য, ছোট কথা। প্রচারের পর এত সাড়া পেলাম যে তা বলার মতো নয়।

তার শঙ্খ নীল কারাগার  সিনেমায় রূপান্তর করা হয়। মুস্তাফিজুর রহমান এটি নির্মাণ করেন। এরপর তিনি নিজেই আগুনের পরশমণি নির্মাণ করেন। তার বক্তব্য দেশে এত বড় একটা মুক্তিযুদ্ধ হয়ে গেলো, অথচ এ নিয়ে ভালো কোনো চলচ্চিত্র হলো না। তাই আমি নিজে উদ্যোগ নিয়ে চলচ্চিত্রটি তৈরি করি। এটা বলব না যে আমি অনেক বড় কিছু করে ফেলেছি। তবে একটা ভালো কিছু করার চেষ্টা আমার ছিল।

গানের প্রতি প্রচণ্ড অনুরক্ত ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। সুযোগ পেলেই নূহাশপল্লীতে বাউল গানের আসর বসাতেন। হুমায়ূন আহমেদের কারণে উকিল মুন্সী, বিদিতলাল দাস, হাছন রাজা, গিয়াউদ্দিন ও বাউল শাহ আবদুল করিমের মতো অনেকের গান আজ দেশে জনপ্রিয়। বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলের প্রতি হুমায়ূন আহমেদের এক ধরনের টান ছিল। তিনি হাছন রাজার গানকে জনপ্রিয় করার অন্যতম প্রধান নেপথ্য কারিগর।

হুমায়ূন আহমেদ মরমি ধাঁচের গান বেশি পছন্দ করতেন। তার অন্যতম প্রিয় গান ছিল ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়’। চলে যায় বসন্তের দিন  গ্রন্থে সূচনাতে হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন, ‘আমার একটি খুব প্রিয় গান আছে, গিয়াসউদ্দিন সাহেবের লেখা ‘মরণ সঙ্গীত’Ñ ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়’ প্রায়ই ভাবি আমি মারা গেছি, শবদেহ বিছানায় পড়ে আছে, একজন কেউ গভীর আবেগে গাইছেÑ ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়’।

১৯৭৩ সালে হুমায়ূন আহমেদ প্রভাষক হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। ১৯৭৩ সালেই তিনি বিয়ে করে গুলতেকিন খানকে। ২০০৩ সালে তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। ২০০৫ সালে হুমায়ূন মেহের আফরোজ শাওনকে বিয়ে করেন।  কোনো দলের হয়ে কোনো কথা বলেননি হুমায়ূন। তিনি ছিলেন সব সময় নিজের মধ্যে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। তাই বলে সমসাময়িক প্রসঙ্গ যে তিনি এড়িয়ে গেছেন তা নয়। তার লেখায় তার স্পষ্ট আভাস রয়েছে। হুমায়ূন নিজেই বলেছেন, ‘আমার কাছে মানবিক সম্পর্ক রাজনীতির চেয়ে অনেক বেশি আকর্ষণীয় বলে মনে হয়।’ তাই আমি সারাজীবন মানুষকে নিয়ে কাজ করেছি। যত দিন বাঁচি তা-ই করতে চাই। মানুষের দুঃখ-বেদনা, কান্না-হাসির ভেতর দিয়ে তিনি নতুন এক সমাজের ছবি আঁকতে চেয়েছেন। বলেছেন নিজের মতো করে সমাজের কথা। মধ্যবিত্ত পরিবারের সংস্কৃতি, টানা পড়েন ও মূল্যবোধ ঘিরেই তার সাহিত্য আচ্ছন্ন। তিনি আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা অন্য কোনো ধরনের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না। পরোক্ষভাবেও কাউকে তিনি প্রশ্রয় দিতেন না। এমনকি যে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট তার মৃত্যুর পর শ্রদ্ধা নিবেদনের আয়োজন করেছে, তিনি জীবিত থাকতে কোনো দিন তাদের ছায়াও মাড়াননি।

রামেন্দু মজুমদার বিদায়ী বছরের ২৮ জুলাই নাগরিক শোক সভায় বলেন, ‘হুমায়ূন অনেক সময় আমাদের আন্দোলনে যুক্ত হননি। একবার একটা বিবৃতিতে তার সই নেয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। তিনি সই করেননি। মন খারাপ হয়েছিল। কিন্তু তিনি আমাদের আন্দোলনে যুক্ত না হলেও তার লেখা দিয়ে আমাদের আন্দোলনের সহযোগী হয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.