আরব বসন্তের মতো ভারত বসন্ত কি আসছে

ভারতীয়রা সহজে উত্তেজিত হয় না। কিন্তু যখন হয় তখন চারদিকে রুদ্ররোষে তোলপাড় করে ছাড়ে। দিল্লীর চলন্ত বাসে গণধর্ষণের ঘটনা নিয়ে বিক্ষোভের যে উত্তাল জোয়ার বয়ে চলল তাকে নিছক সাধারণ বিক্ষোভ বলে চালিয়ে দেয়ার উপায় নেই।
এ আসলে ভিন্ন ধরনের কিছু এবং অসাধারণ। এ শুধু ধর্ষণের প্রতিবাদ নয় কিংবা আরও কঠোর আইন ও নিরাপত্তার দাবিতে বিক্ষোভ নয়, নিউজ পত্রিকার ভাষ্যকার আইজাজ জাকা সাইদের ভাষায় : “আমরা যা দেখছি তা হয়ত এক বিপ্লবের সূচনা। মনে হচ্ছে ভারতীয় বসন্তের শেষ পর্যন্ত আগমন ঘটেছে এখানে। দিল্লীর প্রবেশদ্বারে এসে সেই বিপ্লব করাঘাত করছে।”
গণধর্ষণের শিকার সেই ছাত্রীটি শেষ পর্যন্ত মারা গেছে। সোনালী কফিনবাহী তার লাশ দিল্লী বিমানবন্দরে এসে পৌঁছলে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী তা গ্রহণ করেন। এর ঘণ্টাখানেক পর সম্পন্ন হয় তার শেষ কৃত্য।
কিন্তু বিক্ষোভের সেই উত্তাল দিনগুলোতে কি করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী সিং? সেই নজিরবিহীন বিক্ষোভ এবং বিশ্বের মিডিয়াগুলোর দৃষ্টির সামনে অবিশ্বাস্য রকমের অসংবেদনশীল পুলিশ বাহিনীর লাঠিপেটার ঘটনার মুখে এক সপ্তাহ নীরব থাকার পর সুদূরের প্রাচীরবেষ্টিত নিভৃতাবাস থেকে আবির্ভূত হলেন প্রধানমন্ত্রী সিং। লিখিত এক মিনিটের টেলিভিশন ভাষণ পাঠ করে সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানালেন। বলাবাহুল্য তাঁর চেহারায় সে সময় কোন অভিব্যক্তি বা অনুভূতির প্রকাশ ছিল না।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকরাও লক্ষ্য করেছেন যে, গণধর্ষণ পরবর্তী এক সপ্তাহের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে জনগণ ও রাজনৈতিক শ্রেণীর মধ্যে ‘বিপজ্জনক বিচ্ছিন্নতা’ সৃষ্টি হয়। ওটা স্রেফ বিচ্ছিন্নতা ছিল না। ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছিল এমন যেন ভারতীয় রাজনীতিকরা আর জনগণ দুই ভিন্ন গ্রহের বাসিন্দা। সপ্তাহজুড়ে ক্ষুব্ধ জনতা দিল্লীর রাজপথ দাপিয়ে বেড়িয়েছে। তারা ন্যায়বিচার ও মহিলাদের উন্নততর নিরাপত্তার দাবি জানিয়েছে। এ সময় সাধারণত কর্মচঞ্চল রাজধানীর বুকে প্রায় পরিপূর্ণ নীরবতা নেমে এসেছিল। মনে হচ্ছিল যেন দিল্লীতে কোন সরকার নেই।
সে সময় টিভি স্ক্রিনে শুধু যেটা দেখা গিয়েছিল তা হচ্ছে পুলিশের বিপুল উপস্থিতি। রাস্তায় কোন মিছিল দেখামাত্র তারা পূর্ণ শক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের প্রতিবাদ জানাতে যে হাজার হাজার স্কুলছাত্রী ও মহিলা রাস্তায় নেমে এসেছিল তাদেরকেও তারা রেহাই দেয়নি। জনৈক পর্যবেক্ষক মন্তব্য করেন, খাকি পোশাকের এই লোকেরা যদি তাদের এই পশুশক্তি ও কঠোরতার অর্ধেকটা সেইসব জানোয়ারদের দমনের কাজে নিয়োগ করত যারা দিল্লীকে ধর্ষণের রাজধানীতে পরিণত করেছে তাহলে প্রথমতঃ এই সঙ্কটই দেখা দিত না।
এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন যে, দিল্লী নগরী মহিলাদের দ্বারা শাসিত। শীলা দীক্ষিত দিল্লী সরকারের প্রধান। সোনিয়া গান্ধী ভারতে শাসক দলের প্রধান। লোকসভার স্পীকার ও বিরোধীদলীয় নেত্রীও মহিলা। পুলিশের জবাবদিহিতার দাবি করে বিক্ষোভ শুরু হবার কয়েকদিন পর শীলা দীক্ষিত দৃশ্যপটে আবির্ভূত হন। অন্যদিকে সোনিয়া গান্ধীও গভীর রাতে তাঁর ঘাঁটি ছেড়ে বেরিয়ে আসেন এবং বিলম্বে হলেও বিক্ষোভকারীদের প্রতি সমর্থন ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের অঙ্গীকার করেন।
ভারতীয় রাজনীতিকরা নিজেদের জনগণকে এত ভয় পান কেন? জাতি যখন সঙ্কটে তখন জনগণের পাশে কেউ নেই। অথচ তখনই তাদের নেতৃত্বের প্রয়োজন। সঙ্কটের এমন মুহূর্তেই নেতৃত্বের পথ নির্দেশনা ও সহমর্মিতা জনগণ কামনা করে। নেতৃত্বের এই পথ নির্দেশনাই আজকের ভারতে অতি তীব্র রূপে প্রয়োজন। এই সুবিশাল দেশটির সামনে যেসব বহুবিধ চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে অনেক সময় তার মর্মমূলেই রয়েছে এই পথ নির্দেশনার সঙ্কট। একজন অর্থনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে ড. মনমোহন সিংয়ের যত শক্তিই থাক না কেন সঙ্কটের সময় জাতির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা ও অনুভূতির আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে তার মধ্যে দুঃখজনকভাবে সেই শক্তির অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। পার্টি ও সরকারের তিন জ্যোতিষ সোনিয়া গান্ধী, তার পুত্র রাহুল গান্ধী ও প্রধানমন্ত্রী সিং এঁরা সবাই ‘মিডিয়ার দৃষ্টি’ এড়িয়ে চলতে চান। শাসিতের অর্থাৎ জনগণের সঙ্গে কদাচিতই তাদের মিথষ্ক্রিয়া ঘটতে দেখা যায়। ভারতীয় জনগণের ঘাড়ে আজ যে সমস্যা চেপে বসেছে সেটা আরও বিশাল। তা হলো সরকার বা প্রশাসনের অযোগ্যতা ও ত্রুটিপূর্ণ শাসন পারিচালনা। সেই সঙ্গে শীর্ষ মহলের সার্বিক নিষ্পৃহতা ও দিকভ্রান্তি।
অবিশ্বাস্য মাত্রায় দুর্নীতি থেকে শুরু করে গগনচুম্বী মুদ্রাস্ফীতি এবং অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মতো যেসব গুরুতর সমস্যা বা চ্যালেঞ্জ দেশটির সামনে রয়েছে সেগুলোর ব্যাপারে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ জাতির চেতনায় খুব একটা আস্থা সঞ্চার করতে পারছে না। নরেন্দ্র মোদি ও তার পৃষ্ঠপোষকরা যে এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
শোকসভায় স্পীকার মীরা কুমার যথার্থই বলেছেন এই বিক্ষোভ হলো পুঞ্জীভূত ক্রোধের বিস্ফোরণ। জনগণের প্রাপ্তি যথেষ্ট হয়েছে। তারা যথেষ্ট অবহেলা পেয়েছেন। রাজনৈতিক নিষ্পৃহতা লাভ করেছেন। প্রশাসনিক ব্যবস্থার অযোগ্যতার বিষময় ফল যথেষ্ট ভোগ করেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক অপব্যবহারের শিকারও তারা হয়েছেন। ভারত এমন এক দেশ যেখানে প্রতি ২২ মিনিটে একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে এবং প্রতি ৭৬ মিনিটে একটি শিশু ধর্ষিত হয়। এগুলো ছাড়াও নারীদের বিরুদ্ধে নানাভাবে নীরব যুদ্ধ চলে। মাতৃগর্ভে তাদের হত্যা করা থেকে শুরু করে কন্যাসন্তান জন্ম দেয়ার অপরাধে মাকে শাস্তি দেয়া এমনকি সনাতনী পুরুষ শাসন চ্যালেঞ্জ করার জন্য মহিলাদের নির্যাতন করা সবই এখানে চলে। কোনটাতেই বাধা দেয়া হয় না। কারো কাছ থেকে কোন নিরাপত্তা পাওয়া যায় না না সরকার, না রাষ্ট্র।
চলমান ডেস্ক

No comments

Powered by Blogger.