মিসরে নয়া সংবিধান ॥ বিভেদ ও সংঘাত বাড়াবে!

মিসরের নতুন সংবিধান বলবৎ হয়েছে। গণভোটে ৬০ শতাংশেরও বেশি ভোটে পাস হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট মোহম্মদ মুরসির স্বাক্ষর লাভের মধ্য দিয়ে তা আনুষ্ঠানিক দলিলে পরিণত হয়েছে।
কোন দেশে নতুন সংবিধান গৃহীত হবার পর সাধারণত বিরাট আনন্দ উৎসবের মধ্যে দিয়ে সেটাকে স্বাগত জানানো হয়। সেই সংবিধানকে ঘিরে এক ধরনের জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠে। এর মধ্যে দিয়ে নতুন করে যাত্রা শুরুর অঙ্গীকার ঘোষিত হয় এবং এক বিশৃঙ্খলাপূর্ণ উত্তরণ পর্বের অবসান হয়।
কিন্তু মিসরের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা হয়েছে ঠিক তার উল্টো। নতুন সংবিধানকে ঘিরে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে ওঠা এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের সুদৃঢ় ভিত্তি রচিত হওয়া তো দূরের কথা, নতুন দলিলটি একটি বিভক্ত জাতির প্রতীকে পরিণত হয়েছে। সংবিধান যেভাবে পাস হয়েছে তাতে অধিকতর রাজনৈতিক বিশ্বাস ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তারপর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যেরূপ বেসামাল হয়ে উঠেছে তাতে এক নিদারুণ অন্ধকার ভবিষ্যতের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। গোড়া থেকেই বিতর্কিত এবং ইসলামপন্থীদের সমর্থিত এই সংবিধান আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদিত হলেও দু’বছরের টালমাটাল অবস্থা চলার পর দেশে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে এমন আশা নেই বললেই চলে।
বিরোধীদের অভিযোগ, এই সংবিধান জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে পাস হয়নি। এর ফলে জাতির বিভাজন আরও বেড়ে গেছে। ইসলামপন্থী নয় এমন লাখ লাখ মানুষ নিজেদের অধিকার বঞ্চিত মনে করেছে। তারা ক্রুব্ধ হয়ে উঠেছে এবং এই দলিলে পরিবর্তন আনতে সংকল্পবদ্ধ হয়েছে।
এই অবস্থায় সমস্যার একটা টেকসই সমাধান খুঁজে বের করার জন্য প্রেসিডেন্ট মুরসিকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। সংবিধানের যেসব বিধান অনেক মিসরীয়র কাছে আপত্তিকর মনে হয়েছে সেগুলোর সংশোধনী আনাসহ আপোস নিষ্পত্তির পরিবেশ তাকেই গড়ে তুলতে হবে। ২৬ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে প্রেসিডেন্ট মুরসি কোন ছাড় না দিলেও তাতে বিরোধীদের উদ্দেশে আপোস ও সমঝোতার সুর ছিল। তবে সেই সঙ্গে বিরোধীদের অর্থাৎ সেক্যুলারপন্থী, উদারপন্থী ও কপটিক খ্রীস্টানদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার আছে; তাদের দায়িত্বশীল বিরোধীদলের মতো আচরণ করতে হবে।
প্রায় ৬৪ শতাংশ ‘হ্যাঁ’ ভোটের মাধ্যমে সংবিধান গৃহীত হলেও এটাও লক্ষণীয় যে, ৫ কোটি ২০ লাখ ভোটারের মধ্যে মাত্র ৩২ দশমিক ৯ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছে। তার মানে গোটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রতি জনগণের বিরাগ ভাবের পরিচয় পাওয়া গেছে। তবে যে গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে হোসনি মোবারক ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন তার কতিপয় মৌলিক দাবি এই সংবিধান পূরণ করেছে; যেমন প্রেসিডেন্টের হাতে সর্বময় ক্ষতার অবসান করা হয়েছে। পার্লামেন্টকে শক্তিশালী করা হয়েছে। তবে নাগরিক অধিকারের ক্ষেত্রে এই সংবিধান দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছে। তা ছাড়া মোবারক যুগে জেনারেলরা যেসব ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত সংবিধানে তার অনেকটাই অক্ষুণœ রাখা হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট মুরসি আইন প্রণয়নের ক্ষমতা শূরা কাউন্সিল বা পার্লামেন্টের উচ্চ পরিষদের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। এই শূরা পরিষদ সাধারণত নখদন্তহীন। এটাকে অগ্রগতির লক্ষণ বলে গণ্য করা হলেও মনে রাখতে হবে, শূরা পরিষদে সরকারের মতোই ইসলামপন্থীদের আধিপত্য। পার্লামেন্টের নিম্ন-পরিষদের নির্বাচন আগামী মাস দুয়েকের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে। নিম্ন-পরিষদের নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর শূরা পরিষদের আইন প্রণয়ণের দায়িত্ব এই নিম্ন-পরিষদের হাতে ছেড়ে দেয়ার কথা। তবে শূরা পরিষদ বাড়াবাড়ি কিছু করলে এবং দায়িত্ব হস্তান্তরে বাগড়া দিলে বিরোধী দলকে ক্ষেপিয়ে তোলা হবে মাত্র। আপাতত যেসব লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, তাতে আগামী দু’মাসের মধ্যে পার্লামেন্ট নির্বাচন নিয়ে মিসরের প্রকাশ্য রাজনৈতিক ক্ষতগুলো আরও দগদগে ক্ষতের আকার ধারণ করবেÑসেরে উঠার তো প্রশ্নই ওঠে না।
তার মানে, সরকার পরিচালনায় আরও এলোমেলো ও গোলমেলে ভাব দেখা দেবে। রাজপথে আরও বিক্ষোভ গোলযোগ হবে। অর্থনীতি আরও বেহাল হবে। মোবারকের আমলে যা ছিল তার চেয়েও খারাপ আকার ধারণ করবে। ডলারের সঙ্গে মিসরের পাউন্ডের বিনিময়মূল্য বর্তমানে যত নিচে নেমে এসেছে আট বছরের মধ্যে এত নিচে আর নামেনি। মিসরীয় মুদ্রার মূল্যমানই বলে দেবে আগামী বছরগুলোতে মিসরে কি ঘটবে। মিসরের ৮ কোটি মানুষের মধ্যে মোটামুটি ৩ কোটি মানুষের দৈনিক রোজগার ২ ডলার বা তারও কম। এরা সরকারের ভর্তুকির ওপর দারুণভাবে নির্ভরশীল। গত বছর শুধু রুটির পেছনে ভর্তুকি বাবদ সরকার ৩শ’ কোটি ডলার ব্যয় করেছে। মিসরের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ৩৬০০ কোটি ডলার থেকে নেমে এসেছে ১০৫০ কোটি ডলারে। লোকের হাতে ডলার মজুদ করার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এ অবস্থায় মিসরে আরও অশান্তি ও গোলযোগ দেখা দিলে অর্থনীতি এক কথায় ধসে পড়বে।
চলমান ডেস্ক

No comments

Powered by Blogger.