সরল গরল-ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর নতুন কীর্তি by মিজানুর রহমান খান

তুন কোনো আইন তৈরির আগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের, মানে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করাই সংগত। সেটা যত বেশি সময় নিয়ে যতটা নির্ভুল করা যায়, ততই ভালো। কিন্তু এই সোজা কথাটা আমাদের আমলানির্ভর আইন তৈরির কারখানার লোকজনের মাথায় কিছুতেই ঢোকে না। তাই যে আলোচনা, মত-দ্বিমত আলোচনার টেবিলে হওয়ার কথা, সেটা অনেক সময় চলে যায় আদালতে। তাতে দুটি ক্ষতি—সময় নষ্ট এবং আদালতের ওপর বোঝা বাড়ানো।


সংসদের বিতণ্ডা চলে আদালতে। এ রকম একটি অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে ১৮৯৮ সালের ডাক বিভাগ আইন সংশোধন ও তার আওতায় বিধি করা নিয়ে। ‘রানার রানার’ গান আর ডাক হরকরার চিরচেনা দৃশ্যপট ধীরে ধীরে বদলে গেল। সুন্দরবন ও এসএ পরিবহনের মতো প্রতিষ্ঠান সরকারি ডাক বিভাগকে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক করে দিল। বহুজাতিক কুরিয়ার সংস্থাগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিন্তু তাতে সরকারগুলোর টনক নড়েনি। তা না হলে অবৈধভাবে কুরিয়ার ব্যবসা কী করে ফুলে-ফেঁপে বেড়ে উঠতে দেওয়া হলো?
১৮৯৮ সালের আইনে বলা ছিল, ‘মাশুল নিয়ে ডাক সেবা সরকারই দেবে। অন্যরা দিলে তা আইনত দণ্ডনীয় হবে। কিন্তু জার্মান, ডাচ ও ফরাসি সরকারের ডিএইচএল, টিএনটি ও সোডেক্সি প্রভৃতি দেদার ব্যবসা করেছে। তাদের বেআইনি সেবা নিতে আইনি প্রতিষ্ঠানগুলো শরমিন্দা বোধ করেনি। এই হলো বাংলাদেশ।
এক শতাব্দী পরে সেই আইন যুগোপযোগী করার উদ্যোগ অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু তাতে স্বচ্ছতার ঘাটতি দুঃখজনক। এখানে জনস্বার্থ এতটাই ব্যাপক যে এই আইনের খসড়ার ওপর জনমত যাচাই হতে পারত।
বছরে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার (মোট গার্মেন্টস রপ্তানির প্রায় ২৭ শতাংশ) বিভিন্ন ধরনের নমুনা প্রেরণ ও পোশাক তৈরিতে ব্যবহূত কাঁচামাল আনার পুরো ব্যবসাটাই করে আসছে বহুজাতিক ওই কোম্পানিগুলো। আমাদের ডাক বিভাগের ভূমিকা প্রায় শূন্য। চার শতাধিক প্লেন থাকা ডিএইচএলের সঙ্গে আমাদের পতাকাবাহী বিমানের পেরে ওঠার কথা বলি না। কিন্তু বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ও বিমান কি চাইলে এই বিশাল ব্যবসায়ের একটা ন্যূনতম অংশের সঙ্গেও জড়িত হতে পারত না? দেশে বিদেশি কুরিয়ারদের সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল এয়ার এক্সপ্রেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএইএবি)। এর সদস্যসংখ্যা ৪২। বিজিএমইএ তাদের ওপরই নির্ভরশীল। কারণ ওয়ালমার্ট, জেসিপেনি, হলমার্ক, গোল্ডেন পেনি, পিয়েরে কার্ডিনের মতো তারকা ক্রেতারা তাদের ক্রয় আদেশেই তাদের মাধ্যমে মালামাল পাঠাতে বলে দিচ্ছে। আমাদের ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ হঠাৎ একটা বিপ্লব করে বসলেন। তিনি ওই আইনের আওতায় এমন একটি বিধিমালা করলেন, যা নিয়ে কয়েক মাস ধরে হুলুস্থুল কাণ্ড চলছে। শুধু বিদেশি নয়, দেশি কুরিয়ারগুলোও আপত্তি তুলেছে।
২৯ আগস্ট ২০১০ এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এ কে আজাদ মন্ত্রী রাজুকে লিখেছেন, মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস বিধিমালা প্রণয়নের জন্য একটি খসড়া সারসংক্ষেপ কুরিয়ার সার্ভিস অব অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের কাছ থেকে পেয়েছি। তাদের সঙ্গে গত ২৪ আগস্ট আমরা সভা করেছি। এফবিসিসিআই মনে করে, বিধিমালা চূড়ান্ত করার আগে আলোচনার মাধ্যমে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য বিধিমালা প্রণয়ন করা জরুরি। এতে বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হবে। জনাব আজাদ মন্ত্রীর ব্যক্তিগত উদ্যোগও কামনা করেছিলেন। নথিপত্র যা পেয়েছি তাতে প্রতীয়মান হচ্ছে যে দায়সারা একটা অলোচনা করা হয়েছে।
আমি এর কয়েকটি বিধান দেখে অবাক হয়েছি। যেমন দুই কেজির বেশি যেকোনো ধরনের মুদ্রিত উপকরণ কোনো কুরিয়ার বহন করতে পারবে না। আজকাল অনেক সময় একটি সংবাদপত্রের কপির ওজনও দুই কেজির বেশি হয়।
আইন বলেছে, আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ কুরিয়ার নিয়ন্ত্রণে একটি লাইসেন্সিং অথরিটি গঠন করতে হবে। কত দিনের মধ্যে করতে হবে, তার কোনো তারিখ নেই। সুতরাং তাড়াহুড়ার বিষয় ছিল না। আইন বলেছে, তিন সদস্য থাকবেন। চেয়ারম্যান নিয়োগ দেবে সরকার। অন্য দুই সদস্য কারা হবেন, সে বিষয়ে আইন নীরব। কুরিয়ার সমিতির দাবি, এই দুজন হবেন স্টেকহোল্ডার থেকে। কিন্তু বাস্তবে ডাক বিভাগের অতিরিক্ত মহাপরিচালকসহ তিনজনই সরকারি।
যুগ্ম সচিব এম এম শওকত আলীকে চেয়ারম্যান করে গঠিত অথরিটির অপর দুজন হলেন ইসমত আরা জাহান এবং এস এস ভদ্র। গতকাল এ বিষয়ে কথা বলেছি জনাব শওকত আলীর সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে আমরা একমত যে, সেকেলে আইনকে যুগোপযোগী করা এবং কুরিয়ার ব্যবসায় শৃঙ্খলা আনার চিন্তা থেকেই নতুন বিধিমালা করা হয়েছে। তবে প্রশ্ন হলো, বিধিমালাহীন বেআইনি ৪০ বছরই যখন কাটল তখন কেন এত তাড়াহুড়া করা হলো? সেটা করে লাভ কী হলো? নতুন বিধিমালার সাংবিধানিকতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে। ১২ ডিসেম্বরের মধ্যে সব কুরিয়ারকে জামানতের অর্থ দিয়ে লাইসেন্স নিতে বলা হয়েছিল। এর কার্যকরিতা স্থগিত করা হয়েছে। শুনানি চলছে। হার-জিত যে পক্ষেই হোক, বিষয়টি আপিল বিভাগেও গড়াবে।
২৮ জানুয়ারি ২০১০ সংসদে পোস্ট অফিস অ্যাক্ট ১৮৯৮ সংশোধন করা হয়। কুরিয়ার খাতের আশঙ্কা এখানে সরকারি হস্তক্ষেপের থাবা অত্যন্ত প্রকট। এর নাম শৃঙ্খলা আনার চেষ্টা নয়। আমরা দেখি, জনগণ যখন বেসরকারি কুরিয়ারমুখী, তখন জাতীয় ডাক বিভাগের সব ধরনের স্থাপনা, কাউন্টার ও চত্বর ভাড়া এবং ইজারা দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা হলো কেন? মহাপরিচালককে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যাতে তিনি কমিশন, ফি ও চার্জের ভিত্তিতে এজেন্ট নিয়োগ করতে পারেন। এমনকি বেসরকারি খাতের সঙ্গে নতুন ব্যবসা করতে পারেন যৌথভাবে। এর উদ্দেশ্য কী? দখলবাজির যুগে এ ধরনের নতুন ব্যবসা কারা পাবে, তাতে রাজস্ব কতটা উসুল হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অস্বাভাবিক নয়।
কুরিয়ার সমিতির যুক্তি: ডাক বিভাগ সমব্যবসায়ী। তারা আমাদের প্রশাসক হতে পারে না। তারা রেট ঠিক করবে। তাহলে ব্যবসার ধর্ম থাকে? অপারেটরদের পোশাক, লোগো, কর্মঘণ্টাও অথরিটি ঠিক করে দেবে। এমনকি ন্যূনতম মজুরিও। আমরা এর ব্যাখ্যা চেয়ে বলেছি, এটা আমরা গ্রহণ করতে পারি না। কারণ সারা বিশ্বে একই মান ও ব্র্যান্ড বজায় রাখার এখতিয়ার আমাদের আছে।
নতুন আইনে অপরাধের সংজ্ঞা নির্দিষ্ট করা হয়নি। অথচ বলেছে যে প্রথম অপরাধ করলে ৫০ হাজার টাকা, দ্বিতীয় অপরাধ করলে দুই লাখ টাকা জরিমানা। বিধি কখনো মূল আইনকে টপকাতে পারে না। কিন্তু বিধিতে যথাক্রমে পাঁচ লাখ, ১২ লাখ ও লাইসেন্স বাতিলসহ ২৫ লাখ টাকার জরিমানার বিধান করা হয়েছে।
লাইসেন্স অথরিটির চেয়ারম্যান গতকাল জানালেন, ‘বর্তমানে দেশে ছোট-বড় পাঁচ শতাধিক কুরিয়ার আছে। অনেকগুলো আছে, যারা একটি বা দুটি জেলার মধ্যে ব্যবসা করছে।’ অথচ গত ১৩ সেপ্টেম্বর জারি করা ওই বিধি এখন তাদের লাইসেন্স প্রাপ্তির শর্তে বলেছে, ‘রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য সিটি করপোরেশন এলাকায় ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ক থাকতে হবে। অন্তত দুই বছর ব্যবসা চালাতেই হবে।’ কেন থাকবে? কে কবে শুনেছে যে কে কোথায় কত দিন ব্যবসা করবে, তা সরকার এভাবে ঠিক করে দিতে পারে? বলা হয়েছে, কমপক্ষে ২০টি বুকিং ও বিতরণ অফিস থাকতে হবে। কেন? এর মাধ্যমে কী ফায়দা মিলবে? আরও বলা হয়েছে, লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্দিষ্ট আয়তন ও মানের গুদামঘর এবং তাতে ‘গ্রহণযোগ্য’ সুবিধা থাকতে হবে।
যারা এসব বিধান লিখেছেন, তাঁদের মহৎ লক্ষ্য থাকলেও বলতে পারি, এগুলো হাস্যকর। তাঁরা হয়তো এই কুরিয়ার ব্যবসায় একটা যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে চেয়েছেন। কিন্তু সেটা বিদ্যমান কুরিয়ার ব্যবসা তছনছ করে দিয়ে। কুরিয়ার খাতে ছোট ও মাঝারি পুঁজি উৎখাত করার একটা বেপরোয়া চেষ্টা লক্ষণীয়। যেমন—গ্রাহক অভিযোগ শোনার প্রতি গুরুত্বদান একটা জনদরদি চিন্তা। কিন্তু বিধি বলেছে, গ্রাহক অভিযোগ ব্যবস্থাপনার জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে প্রতিটি মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানের ন্যূনতম আট ঘণ্টার জন্য কমপক্ষে একটি কল সেন্টার (বিটিআরসির অনুমোদনসাপেক্ষ) থাকতে হবে। এটা বাস্তবসম্মত?
বস্তুত, উল্লিখিত ধরনের কোনো বিধান কার্যকর করা সম্ভব নয়। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এসব বিধান কি আইন মন্ত্রণালয় দেখে দিয়েছে? উত্তর পেয়েছি, নিশ্চিয়ই। তারা ভেটিং দিয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়েরও অনুমোদন পেয়েছি।
বেসরকারি কুরিয়ারের একটি অংশ অবৈধ হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ আছে। বিদেশি কুরিয়ারগুলো কার্গো ও কুরিয়ারের মধ্যে ফারাক মানতে চায় না। সে জন্য তারা কুরিয়ারের আড়ালে চুটিয়ে কার্গো ব্যবসা করছে। সে জন্য সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। একটি অনুমান হচ্ছে, কুরিয়ারগুলো ইচ্ছেমতো চলার কারণে সরকার বছরে ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। সে জন্য সরকারি নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা আবশ্যক।
তবে আশু উদ্বেগ অন্যত্র। বিজিএমইএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোহামদ সিদ্দিকুর রহমান গত ১৫ ডিসেম্বর ডাকসচিবকে লেখা চিঠিতে বলেছেন, গত ২৭ নভেম্বর আইএইএবির সভাপতি ডেসমন্ড কুইয়ার কাছ থেকে চিঠি পেলাম। তাঁরা ওই বিধি দেশের সংবিধানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করে না শোধরালে আন্তর্জাতিক কুরিয়ার ব্যবসা বন্ধ করে দেবে। আমরা তাঁদের সঙ্গে একমত যে বিধিটি ব্যবসাবৈরী। তাঁরা যদি এ নিয়ে দু-তিন দিনের জন্যও ধর্মঘটে যান, তাহলে দেশের অর্থনীতির সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাতটি ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। ১১ নভেম্বর বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশন ডাকসচিবকে লেখা এক পত্রে বিজিএমইএর ওই অভিমতের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন।
অথরিটি চেয়ারম্যান আমাকে বলেন, এফবিসিসিআই ও বিজিএমইএর চিঠির কথা জানি। পাট সমিতির কথা এই জানলাম। বললাম, আদালতে শুনানি চলছে বলে আপনারা চুপচাপ বসে থাকতে পারেন না। স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে সংলাপে বাধা নেই। তিনি একমত হলেন। আমরা মনে করি, চুপকে চুপকে আইন করতে গিয়ে ফাঁদে পড়েছেন মন্ত্রী রাজু। নরসিংদীর মেয়র হত্যার পরে তিনি শিরোনাম হয়েছিলেন। বিজিএমইএর আশঙ্কামতে ওই ধর্মঘট সত্যি হলে তিনি আবার শিরোনামে আসবেন।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.