নরসিংদীর পৌর মেয়র লোকমান হত্যাকাণ্ড-গ্রেপ্তার নেই, গা-ছাড়া প্রশাসন-প্রধানমন্ত্রী নিজেই তদারক করছেন, বললেন এমপি হিরু by হায়দার আলী ও সুমন বর্মণ,

ণমানুষের নেতা নরসিংদীর পৌর মেয়র লোকমান হোসেন হত্যার পাঁচ দিন পেরিয়ে গেলেও মামলার আসামি বা হত্যাকাণ্ডে জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। প্রথম থেকেই গা-ছাড়াভাবে রয়েছে তারা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় সম্প্রতি নরসিংদী জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে নরসিংদী থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ায় জেলা পুলিশের মধ্যে গা-ছাড়া ভাব আরো প্রকট হয়েছে। পুলিশ সুপার ও একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইতিমধ্যে নরসিংদী ছেড়ে চলেও গেছেন। অন্যজন দায়িত্বভার বুঝিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন। নতুন দায়িত্বপ্রাপ্তরা এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কেউ এসে পৌঁছাননি।


জানা গেছে, ব্যর্থতার কারণেই নরসিংদী পুলিশের তিন কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। নরসিংদী সদর থেকে নির্বাচিত সরকারদলীয় সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম হিরু বলেন, 'পৌর মেয়র লোকমান হোসেন হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি সরাসরি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তদারক করছেন। তিনি প্রশাসনের কয়েকটি বিভাগকে দায়িত্ব দিয়েছেন প্রকৃত খুনিদের গ্রেপ্তারের জন্য। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। লোকমান হত্যার সঙ্গে জড়িতরা যে-ই হোক না কেন, আইনের আওতায় এনে তাদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।'
নরসিংদী পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে গতকাল দুপুর ১২টায় দেখা যায়, শীর্ষ তিন কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করায় হঠাৎ করেই পাল্টে গেছে চিত্র। কার্যালয়ের সামনে আগের মতো নেই গাড়ির ভিড়। কমে গেছে মানুষের আনাগোনা। ভেতরে গোয়েন্দা পুলিশ বিভাগে ঢুকেই দেখা যায়, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা লোকজনের সঙ্গে খোশমেজাজে গল্প করছেন। দোতলায় এসপি ও দুই অতিরিক্ত এসপির কক্ষ। প্রত্যাহার হওয়া এনামুল কবিরের দরজায় তালা ঝুলছে। আরেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিজয় বসাক ফাইল স্বাক্ষরে ব্যস্ত।
সদ্য বদলি হওয়া এএসপি বিজয় বসাক জানান, প্রত্যাহারের আদেশ পাওয়ার পর রাতেই পুলিশ সুপার ড. আক্কাছ উদ্দিন নরসিংদী ছেড়েছেন। বিশেষ শাখার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এনামুল কবিরও আজকের (শনিবার) মধ্যে নরসিংদী ছেড়ে যাবেন। নতুন দায়িত্ব পাওয়া ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রওনা হয়েছেন নরসিংদীর পথে। তিনি এসে যোগ দিলে দায়িত্ব হস্তান্তর হবে।
বিজয় কুমার বসাক মেয়র লোকমান হত্যা মামলার তদারকি কর্মকর্তা ছিলেন। হঠাৎ করেই জেলা পুলিশের শীর্ষ তিন কর্মকর্তা চলে যাওয়ায় মামলার তদন্তকাজ ব্যাহত হবে কি না_জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'ইতিমধ্যে আমরা মামলার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চিহ্নিত করেছি। আশা করছি, আমরা চলে গেলেও তদন্তে নিয়োজিত কর্মকর্তারা সেগুলোকে সামনে নিয়ে দ্রুত হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারবেন।'
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মামুনুর রশিদ বলেন, 'দায়িত্ব পাওয়ার পরই আমরা মামলার তদন্তে মাঠে নেমেছি। ইতিমধ্যে আমরা হত্যকারীদের চিহ্নিত করেছি। এখন তাঁদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালানো হচ্ছে।' এজাহারভুক্ত কোনো আসামি এখনো গ্রেপ্তার না হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মামলা করার আগেই আসামিরা জেনে ফেলায় তাঁরা গা-ঢাকা দিয়েছেন।
তাঁরা নরসিংদীতেই রয়েছেন_পরিবারের এমন দাবির ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'মামলা করলেই ধরতে হবে, এটা কোনো কথা নয়। ঘটনার সঙ্গে তিনি জড়িত কি না, তাও দেখতে হবে। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।'
মামুনুর রশিদ আরো বলেন, 'ঘাতকদের ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের মালিকের পরিচয় পাওয়া গেছে। মোটরসাইকেলটির লাইসেন্স পরীক্ষা করে জানা যায়, এর মালিক কুমিল্লার। কিন্তু মোটরসাইকেলটি বেশ কয়েকবার হাত বদল হয়েছে। আমরা প্রকৃত মালিককে চিহ্নিত করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।'
নিহত মেয়র লোকমান হোসেনের স্ত্রী বুবলি বলেন, 'আমি প্রধানমন্ত্রীকে বলতে চাই, তিনিও স্বজনহারা, তিনি মা-বাবা, ভাই-বোনসহ সবাইকে হারিয়েছেন। তিনি স্বজন হারানোর দুঃখ বোঝেন। তিনি আমার দুঃখটা কি বুঝবেন না? আমার বাচ্চাদের দুঃখ কি বুঝবেন না? কেন তিনি আমাকে স্বামীর হত্যাকাণ্ডের বিচারের আশ্বাস দিচ্ছেন না? আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে এর বিচার দাবি করছি।'
লোকমানের মা মজিদা বেগম এখন আর আগের মতো কথা বলেন না। সারা দিন নিশ্চুপ বসে থেকে অবিরত চোখের জল ফেলছেন। অনেকক্ষণ পর ছেলের খুনিদের ফাঁসির দাবি করে তিনি বলেন, 'আমার ছেলে চেয়েছিল নরসিংদীকে স্বপ্নের মতো করে সাজাতে। সেই ছেলের খুনিদের আজও পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারেনি। ওদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমার চোখের জল থামবে না।'
হত্যা মামলার বাদী মেয়র লোকমানের ছোট ভাই কামরুজ্জমানের বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রী এ হত্যাকাণ্ডের বিচারের ব্যবস্থা করবেন। তিনি বলেন, 'আমরা চেয়ে আছি প্রধানমন্ত্রীর দিকে। তিনি আমার ভাই লোকমানকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন ও স্নেহ করতেন। আমার বিশ্বাস, তিনি নিজেই মামলাটি তদারক করে খুনিদের বিচারের ব্যবস্থা করবেন।'
মেয়র লোকমান হত্যার ঘটনায় নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কিত নরসিংদীবাসী। নরসিংদী সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফা মিয়া বলেন, 'লোকমান হত্যাকাণ্ডের পর থেকে আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। এভাবে জনপ্রিয় নেতাদের যদি হত্যা করা হয়, তাহলে নরসিংদীবাসীর নিরাপত্তা কোথায়? আমরা লোকমানের হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।'
বিএনপির প্রতিবাদ সভা : ছাত্রদলের সভাপতি সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু বলেন, 'আওয়ামী লীগ এ নির্দয় হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে না পারলেও আমরা এ জননন্দিত নেতার হত্যার বিচার করব। ঘটনার ছয় ঘণ্টার মধ্যে খায়রুল কবির খোকনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জনতার নেতাকে জেলে পাঠিয়ে কেউ শান্তিতে থাকতে পারবে না। এসপিকে প্রত্যাহার করলে চলবে না, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে সরিয়ে দিতে হবে।'
গতকাল শনিবার দুপুরে নরসিংদী জেলা বিএনপির সভাপতি খায়রুল কবির খোকনকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ও তাঁর মুক্তির দাবিতে জেলা ছাত্রদল আয়োজিত প্রতিবাদ সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে সালাহউদ্দিন টুকু এসব কথা বলেন।
প্রতিবাদ সভায় কেন্দ্রীয় বিএনপির গণশিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, 'খুনের ৫০ ঘণ্টা পরে এজাহার দায়ের করা হয়েছে। পুলিশকে এর কারণ জানাতে হবে। লোকমানের পরিবার থেকে খোকনকে আসামি করা হয়নি, সুতরাং তাঁকে জেলে আটকে রাখা যাবে না। ৩ তারিখে খোকনকে মুক্তি না দিলে নরসিংদী অচল করে দেওয়া হবে।' বিএনপির কেন্দ্রীয় পর্ষদের সদস্য লে. কর্নেল জয়নাল আবেদীন বলেন, 'খোকনের মুক্তি ছাড়া আন্দোলনে ছাড় নেই। তাঁকে মুক্ত না করে নরসিংদীবাসী ঘরে ফিরে যাবে না।'
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মাস্টার বলেন, লোকমান হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অভিযোগের তীর অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্যই খোকনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নতুন করে ষড়যন্ত্র হলে কঠোরভাবে তা মোকাবিলা করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.