ত্যাগ ও আনন্দের ঈদ কাল by রকিবুল হক

গামীকাল পবিত্র ঈদুল আজহা। বিশ্ব মুসলিমের প্রধান দুই ধর্মীয় উত্সবের একটি দিন এটি। প্রতি বছর জিলহজ মাসের ১০ তারিখে ত্যাগ ও আনন্দের বার্তা নিয়ে মুসলমানদের দুয়ারে হাজির হয় এই ঈদ। কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়—‘শহীদের ঈদ এসেছে আজ; শিরোপরি খুন লোহিত তাজ, জিয়ারার চেয়ে পিয়ারা যে; আল্লাহর রাহে তাহারে দে।’ এদিন সকালে ঈদুল আজহার দু’রাকাত নামাজ আদায়ের পর আল্লাহর বিধান অনুযায়ী তার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে নির্দিষ্ট পশু কোরবানি করবেন সামর্থ্যবান মুসলমান।


‘ইন্না সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহইয়ায়া ওয়া মামাতিলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন’ অর্থাত্ আমার সব নামাজ ও কোরবানি এবং আমার জীবন ও মৃত্যু সবকিছুই মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য। পবিত্র কোরআনের এ আয়াত মুখে ও মনে রেখে ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত হয়ে দিনটি পালন করা হবে সারাদেশে।
বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের মুসলমানের কাছে ঈদুল আজহা কোরবানির ঈদ হিসেবে পরিচিত। এদিন সামর্থ্যবান মুসলমানরা জামাতে নামাজ আদায় করেন এবং সাধ্য অনুযায়ী গরু, ছাগল, ভেড়া, উট ইত্যাদি পশু কিনে কোরবানির মাধ্যমে মহান সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করেন। পাঁচ হাজার বছর আগে এদিনে সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর নির্দেশে তার সন্তুষ্টি লাভের জন্য হজরত ইব্রাহিম (আ.) পৃথিবীতে তার সবচেয়ে প্রিয় সন্তান হজরত ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানি করতে উদ্যত হয়ে আল্লাহর রাস্তায় আত্মত্যাগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে আল্লাহর ইশারায় একটি দুম্বা কোরবানির মাধ্যমে সে নির্দেশ বাস্তবায়িত হয়। এরপর থেকেই মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর ত্যাগের নিদর্শন হিসেবে প্রতিবছর গৃহপালিত পশু কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আত্মত্যাগের প্রতীকী পরীক্ষা দেয়ার বিধান চালু হয়। পরে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ ও সর্বশেষ নবী হজরত মুহম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে এই কোরবানি প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য বাধ্যতামূলক (ওয়াজিব) করা হয়।
কোরবানির গুরুত্ব সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ্ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করেন না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে, (ইবনে মাজাহ)। অপর এক হাদিসে আছে, হজরত যায়িদ ইবনে আরকাম (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! এ কোরবানি কী? তিনি বললেন, এটা তোমাদের পিতা ইব্রাহিম (আ.)-এর সুন্নত। তারা আবার বললেন, এতে আমাদের কী কল্যাণ নিহিত আছে? তিনি বললেন, এর প্রত্যেকটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকি রয়েছে। তারা ফের জিজ্ঞেস করলেন, দুম্বা বা মেষের পশমেও কি তাই? জবাবে তিনি বললেন, তাতেও প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকি রয়েছে। (ইবনে মাজাহ, মুসনাদ আহমদ)।
পবিত্র জিলহজ মাসের ১০ তারিখ কোরবানির এই দিনটি পালিত হয়। তবে ধর্মীয় বিধান অনুসারে পবিত্র এ মাসের ১০, ১১ এবং ১২ তারিখের যে কোনোদিনই পশু কোরবানি দেয়া যায়। ঈদুল আজহার সঙ্গে জড়িত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে পবিত্র হজ। পবিত্র মক্কায় জিলহজের ৯ তারিখ তথা গতকাল হজের মূল কাজ শেষ হয়েছে। হজ শেষে হাজীরা সেখানে আজ ঈদ উদযাপন করবেন।
সারাবিশ্বের মুসলমানের মতো বাংলাদেশেও যথাযোগ্য মর্যাদা, ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশ, উত্সাহ-উদ্দীপনা ও ত্যাগের মহিমার মধ্য দিয়ে পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপিত হবে। এরই মধ্যে ঈদের প্রস্তুতি প্রায় শেষ। তবে কোরবানির পশু কেনা এখনও শেষ হয়নি। ঈদের আগে আজ শেষ দিনে প্রায় সবাই এ কাজটি সম্পন্ন করবেন। অনেক জায়গায় ঈদের দিন সকালেও কোরবানির পশু বেচাকেনা হয়ে থাকে।
বাবা-মাসহ আপনজনের সঙ্গে মিলে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নিতে রাজধানী ঢাকাসহ প্রধান প্রধান নগরীর অধিকাংশ বাসিন্দা নানা ভোগান্তি ও দুর্ভোগ উপেক্ষা করে ছুটে চলেছেন নিজ নিজ গ্রামের বাড়িতে। আপনজনের সঙ্গে একত্রিত হয়ে আনন্দ ভাগাভাগির চেষ্টা করবেন অনেকেই। রাজধানী ঢাকা গতকালই অনেকটা ফাঁকা হয়ে গেছে। তবে এ ঈদ সবার মনে হয়তো সমান আনন্দ পৌঁছবে না; কারণ যাতায়াত সমস্যাসহ নানা কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আপনজনের কাছে যেতে পারবেন না অনেকে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাসহ অনেকেই ঈদ করবেন কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে।
ঈদুল আজহার নামাজের জন্য জাতীয় ঈদগাহসহ দেশের সব ঈদগাহ মাঠ ও প্রায় সব মসজিদে প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে ঢাকা সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে ঈদের প্রধান জামাত হবে জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে সকাল সাড়ে ৮টায়। তবে আবহাওয়া প্রতিকূল হলে ঈদের প্রধান জামাত বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে সকাল ৯টায় অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া ডিসিসি’র ব্যবস্থাপনায় ঢাকা মহানগরীর ৯০টি ওয়ার্ডে ৪টি করে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে একটিসহ মোট ৩৬১টি স্থানে ঈদ জামাত হবে। বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে সকাল সাড়ে ৭, ৮, ৯, ১০ ও পৌনে ১১টায় ৫টি জামাত হবে।
ঈদ শুভেচ্ছা বাণী : পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সংসদের বিরোধী দলের নেতা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া পৃথক বাণী দিয়েছেন। এছাড়া দেশবাসীকে ঈদের শুভেচ্ছা ও মোবারকবাদ জানিয়ে জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রধান বিবৃতি দিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান তার বাণীতে বলেন, আনুগত্যের উজ্জ্বল মহিমায় ভাস্বর ঈদুল আজহা। তাওহিদের চেতনায় সর্বোচ্চ ত্যাগের দৃষ্টান্ত ঈদুল আজহা। মহান আল্লাহর অভিপ্রায় বাস্তবায়নে হজরত ইব্রাহিম (আ.) যে গভীর আনুগত্য ও সীমাহীন ভক্তি প্রদর্শন করেছেন তা বিশ্বে অতুলনীয়। ঈদুল আজহার শিক্ষা ও আদর্শ আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে অনুসরণ করতে হবে। ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে এ শিক্ষা ও আদর্শে অনুপ্রাণিত করতে হবে। ঈদুল আজহা সবার জন্য কল্যাণ বয়ে আনুক, এই কামনা করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেন, প্রিয়বস্তুকে মহান আল্লাহর উদ্দেশে উত্সর্গের মাধ্যমে তার সন্তুষ্টি লাভের যে অনুপম দৃষ্টান্ত হজরত ইব্রাহিম (আ.) স্থাপন করে গেছেন, তা বিশ্ববাসীর জন্য চিরকালই অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। এ উত্সবের মধ্য দিয়ে সামর্থ্যবান মুসলমানরা কোরবানি করা পশুর গোশ্ত আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে প্রকারান্তরে সবার মধ্যে সমতা প্রতিবিধান এবং সহমর্মিতা অনুশীলন করে থাকেন। তিনি পবিত্র ঈদুল আজহার মর্মবাণী অন্তরে ধারণ করে নিজ নিজ অবস্থান থেকে জনকল্যাণমুখী কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে বিভেদ-বৈষম্যহীন এক সুখী, সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান।
বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া তার বাণীতে বলেন, ত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত প্রতি বছর ঈদুল আজহা আমাদের মধ্যে ফিরে আসে। স্বার্থপরতা পরিহার করে মানবতার কল্যাণে নিজেকে উত্সর্গ করা কোরবানির প্রধান শিক্ষা। হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-ক্রোধ পরিহার করে সমাজে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় আত্মনিবেদিত হওয়া আমাদের কর্তব্য। কোরবানির যে মূল শিক্ষা তা ব্যক্তিজীবনে প্রতিফলিত করে মানবকল্যাণে ব্রতী হওয়ার মাধ্যমে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভ সম্ভব। বিশ্বাসী হিসেবে সে চেষ্টায় নিমগ্ন থাকা প্রতিটি মুসলমানের কর্তব্য।
তিনি বলেন, দেশের বর্তমান অবস্থায় সবার পক্ষে ঈদের আনন্দ যথাযথ উপভোগ করা সম্ভব হবে না। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি দরিদ্র ও কম আয়ের মানুষকে চরম দুর্ভোগের মুখে ঠেলে দিয়েছে। পানি, জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের তীব্র সঙ্কট জনজীবনে দুর্বিষহ অবস্থার সৃষ্টি করেছে। তাই আমি দেশের সব বিত্তবান ও সামর্থ্যবান ব্যক্তিকে আহ্বান জানাই দরিদ্র ও অসহায় মানুষের দিকে সাহায্য ও সহমর্মিতার হাত প্রসারিত করার জন্য। ঈদের আনন্দের দিনে কেউ যাতে অভুক্ত না থাকে, সেদিকে আমাদের সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে। ঈদের আনন্দ সবাইকে একসঙ্গে ভাগ করে নিতে হবে এক কাতারে মিলে। ঈদুল আজহা সবার জীবনে বয়ে আনুক সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি, সমাজে সৃষ্টি হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দের মেলবন্ধন, মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে এ প্রার্থনা জানান তিনি।
জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে তার বাণীতে বলেন, মুসলমানদের কাছে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা—এ দুটি ঈদই আনন্দের দিন। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা আমাদের শুধু আনন্দই দেয় না, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ-অনৈক্য ভুলে গিয়ে পরস্পরকে ভ্রাতৃত্ব, সম্প্রীতি ও সৌহার্দের বন্ধনে আবদ্ধ করে সামাজিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করে। ঈদ আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও জাতীয়ভাবে ঐক্যের বন্ধন শক্তিশালী করে।
এছাড়া ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, ইসলামী ঐক্যজোট চেয়ারম্যান মুফতি ফজলুল হক আমিনী, জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরী আমির রফিকুল ইসলাম খান ও সেক্রেটারি এএইচএম হামিদুর রহমান আযাদ এমপি, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, চরমোনাই পীর ও ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের আমির মুফতি সৈয়দ মোহাম্মদ রেজাউল করিম, খেলাফত মজলিসের আমির অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক ও মহাসচিব অধ্যাপক আহমদ আবদুল কাদের, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান এমপি, নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি মাওলানা আবদুর রকিব ও মহাসচিব মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী, বাংলাদেশ ন্যাপের চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গনি ও মহাসচিব এম গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া, মুসলিম লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট নুরুল হক মজুমদার ও মহাসচিব কাজী আবুল খায়েরসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠনের নেতা বিবৃতি দেন।
ঈদুল আজহা উপলক্ষে রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভবনে আলোকসজ্জা করা হবে। এ উপলক্ষে হাসপাতাল, কারাগার ও এতিমখানায় পরিবেশন করা হবে বিশেষ খাবার। জাতীয় পত্রিকাগুলো প্রকাশ করেছে বিশেষ ক্রোড়পত্র। বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বিভিন্ন স্যাটেলাইট চ্যানেলে ঈদের বিশেষ অনুষ্ঠানমালাও প্রচার শুরু হবে আজ থেকে। ঈদ উপলক্ষে সংবাদপত্রগুলোতে আজ থেকে ৩ দিনের ছুটি শুরু হয়েছে। আগামী ৩ দিন পত্রিকা প্রকাশিত হবে না। সরকারি-বেসরকারি অফিসগুলোতেও আজ থেকে ৩ দিন ছুটি থাকবে।

No comments

Powered by Blogger.