তবু যেতে হবে বাড়ি by পার্থ সারথি দাস

রাত জেগেও ট্রেনের দেখা মিলছে না। দিনভর অপেক্ষার পরও মিলছে না বাসের দেখা। দূরের পথ পাড়ি দিতে টিকিট মিলবে কি মিলবে না_এ নিয়েও সংশয়। তবু ঈদে যে করেই হোক ফিরতে হবে বাড়ি। টিকিট হাতে নিয়ে বা না নিয়ে রেলস্টেশন ও বাস টার্মিনালে এখন শুধুই মানুষের মুখ। সদরঘাটে লঞ্চ-স্টিমারে আগেভাগে জায়গা নিতেও মানুষের কমতি নেই।রাজধানী থেকে দেশের বিভিন্ন দিকে বাড়িমুখো হতে পেরেই এই মানুষগুলো খুশিতে ডগমগ। এই যাত্রার কষ্ট অনেক, তবু মুখে হাসি। যানজটের যন্ত্রণা, টিকিটের হাহাকার, ট্রেন-বাসের সময়সূচি উধাও হয়ে যাওয়াকে জয় করে তারা ছুটতে চায় রাজধানী থেকে দূরে।


রাজশাহীতে গিয়ে ঈদ উদযাপন করতে মাসুম রেজা ও তাঁর স্ত্রী শারমীন বেগম গতকাল সকাল ৯টায় একটি প্রাইভেট কার ভাড়া করে চাঁদপুর থেকে রওনা দেন ঢাকার পথে। দুর্ভোগপথ পার হয়ে রাজধানীর কল্যাণপুরে আসেন দুপুর ১টায়। এই কাউন্টারে যান, ওই কাউন্টারে যান কিন্তু কোথাও রাজশাহী যাওয়ার টিকিট নেই। এভাবে প্রায় দুই ঘণ্টা ধরেই টিকিট খুঁজে হয়রান মাসুম। যাবেন কিভাবে_প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলেন, 'চেষ্টা করে দেখি কী করা যায়। যেতে তো হবেই।' গতকাল কল্যাণপুরে হানিফ পরিবহন, ন্যাশনাল ট্রাভেলস, নাবিল পরিবহনসহ বিভিন্ন কাউন্টারে টিকিটের জন্য মাসুমের মতো আরো অনেকে শুধুই ঘুরছিলেন। তিনি তখনো টিকিট না পেলেও কিন্তু কাউন্টার ও কাউন্টারের বাইরের ফুটপাতে ও রাস্তার ধারে ছিল টিকিট কাটা যাত্রীদের ভিড়। কেউ একা বা দল বেঁধে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কেউ ক্লান্ত হয়ে মালপত্রের বোঝার ওপর বসেছিলেন। অনেকেই ভোর থেকে বাসের অপেক্ষায় ছিলেন। মহাসড়কে যানজটে বাসগুলো আটকে থাকায় গতকাল বাস সংকট ছিল আগের দিনের চেয়ে আরো তীব্র।
বেলা আড়াইটার দিকে কল্যাণপুরে এসে থামে ঢাকা-রাজশাহী রুটের ন্যাশনাল ট্রাভেলস পরিবহনের একটি বাস। এই কম্পাানির ২৬টি বাস চলাচল করে এই রুটে। বাসটির চালক মো. নুরুল ইসলাম জানান, পাঁচ ঘণ্টার পথ ১০ ঘণ্টায় এসেছেন। রাজশাহী থেকে শুক্রবার রাত ১১টায় রওনা দিয়ে গতকাল বেলা আড়াইটায় কল্যাণপুরে পেঁৗছেছেন। তিনি জানান, রাজশাহী থেকে রওনা দেওয়ার পর রাত ১টা থেকেই যানজটে আটকা পড়তে হয় সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে। শনিবার ভোর ৫টার মধ্যে ঢাকায় এসে আবার ৬টায় যাত্রী নিয়ে তাঁর রাজশাহী ফেরার কথা ছিল। তিনি আর দেরি না করে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের নিয়ে বিকেল ৩টার দিকে রাজশাহীর উদ্দেশে রওনা দেন। বাসটির যাত্রীরা সকাল থেকেই কল্যাণপুরে অপেক্ষায় ছিলেন। এই বাসের যাত্রী ব্যবসায়ী মো. শরিফুল আলম বলেন, উত্তরার বাসা থেকে বের হয়ে কল্যাণপুরে সকাল ৬টায় গিয়ে জানতে পারেন, বাসটি আসতে দুপুর হয়ে যাবে। এরপর দুপুর সাড়ে ১২টায় আবার কল্যাণপুরে যান। কিন্তু তার পরও বাসটির দেখা মেলেনি। প্রায় আড়াই ঘণ্টা অপেক্ষার পর বাসটি ছাড়ছে। শরিফুল কোনো টিকিট পাননি। চালকের পাশে তৈরি করা আসনে তাঁকে বসানো হয়েছে। এ জন্য তাঁর কাছ থেকেও অন্যদের মতোই ৪৭০ টাকা ভাড়া নেওয়া হয়। বসার মতো আসন না পেলেও শরিফুল খুশি। 'কোনো রকমে যেতে পারলেই হলো।' বলেন তিনি। তবে যানজটের কারণে ঠিকমতো পেঁৗছাতে পারবেন কি না সেই উদ্বেগ এখন তাঁর মনে চেপে বসেছে।
কল্যাণপুরে শ্যামলী পরিবহনের কাউন্টারেও ছিল অপেক্ষমাণ যাত্রীদের ভিড়। গতকাল সকাল ১০টার পর থেকে বিকেল সাড়ে তিনটা পর্যন্ত বাস সংকটের কারণে এই পরিবহনের কোনো বাস কল্যাণপুর থেকে যাত্রী নিয়ে যেতে পারেনি। কাউন্টারের মাস্টার রফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত মোট পাঁচটি বাসের যাত্রীরা অপেক্ষায় আছেন। আজ কোনো টিকিটও বিক্রি হচ্ছে না। এই প্রতিনিধি দাঁড়িয়ে থেকে দেখলেন, ১০ মিনিটের মধ্যেই ১২ জন্য উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় যাওয়ার টিকিট কিনতে আসেন। এর মধ্যে শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জ যাওবার টিকিট নিতে আসা নিজাম উদ্দিনকে দেওয়া হয় রবিবার রাত ১১টার বাসের একটি টিকিট।
কল্যাণপুর শুধু নয়, গতকাল সারা দিনই বাসের অপেক্ষায় যাত্রীদের ভিড় ছিল সায়েদাবাদ, গাবতলী ও মহাখালী বাস টার্মিনালে। সকালে সায়েদাবাদে গিয়ে শ্যামলী, হানিফ, ইউনিক, এস আলম, সাকুরাসহ বিভিন্ন পরিবহনের কাউন্টারের সামনে যাত্রীদের ভিড় দেখা যায়। এখানে কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ফেনী রুটে বাসের সংকট ছিল তীব্র। মহাখালী ও গাবতলী টার্মিনালে সকালে কিছু বাস ছাড়তে পারলেও দুপুর থেকে বাস সংকট ছিল।
স্টেশনে ট্রেনের জন্য রাত জাগা : যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন গত বৃহস্পতিবার কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে বলেছিলেন, দু-এক দিনের মধ্যে ট্রেনের সময়সূচি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তাঁর এই 'আশ্বাস' আশ্বাসই থেকে গেছে। গতকালও বিভিন্ন স্টেশনে ট্রেনের সময়সূচি ঠিক ছিল না। নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেনের দেখা না পেয়ে শত শত যাত্রী রেলস্টেশনেই রাত কাটায়। গতকাল সকাল থেকেই স্টেশনে যাত্রীর ঢল নামে। তাদের একটি বড় অংশই ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় ছিল। সকালে কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে জানা যায়, লালমনি এঙ্প্রেস ট্রেনটির গত শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টার মধ্যে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে লালমনিরহাটের দিকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এটি ছেড়ে যায় সকাল সাড়ে ৭টার দিকে। এই ট্রেনে যাত্রীদের প্রচণ্ড ভিড় ছিল। অনেকে ছাদেও ওঠে। ছাদে উঠেও ভিড়ের কারণে ভয়ে নেমে আসেন যাত্রী বাবুল হোসেন (৪৫)। তিনি শুক্রবার রাত ৮টা থেকেই অপেক্ষায় ছিলেন ট্রেনটিতে ওঠার জন্য। তিনি বলেন, 'রাতে প্লাটফর্মে ঘুমিয়ে থাকার কারণে আগে ছাদে জায়গা নিতে পারিনি। পরে ছাদে উঠলেও ভিড়ের কারণে নেমে গেছি।' দুপুর ১২টার দিকে বাবুল স্টেশনমাস্টারের কক্ষে এসে জিজ্ঞেস করছিলেন, লালমনিরহাটের আর কোনো ট্রেন আছে কি না। রেলওয়ের (লালমনিরহাট) পরিবহন কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান গতকাল সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে বলেন, লালমনি এঙ্প্রেসে যাত্রীর চাপ বেশি ও ইঞ্জিন সংকটের কারণে এমন দেরি করে চলাচল করছে।
গতকাল কমলাপুর থেকে খুলনার উদ্দেশে সুন্দরবন এঙ্প্রেসের ছেড়ে যাওয়ার নির্ধারিত সময় ছিল সকাল ৬টা ২০। এটি ছেড়ে যায় ৯টা ৫০ মিনিটে। দুপুর ১২টায় রেলস্টেশনে রংপুর এঙ্প্রেসের যাত্রী সুমনা ইসলাম জানান, সাড়ে ৯টায় ট্রেনটি ছাড়বে জানানো হলেও এটি ছাড়ছে না। দিনাজপুরগামী একতা এঙ্প্রেসের যাত্রীরাও তখন অপেক্ষায় ছিল।
গতকাল বিকেল ৩টার দিকে বিমানবন্দর রেলস্টেশনে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে জয়ন্তিকা, সিল্কসিটি ও যমুনা আন্তনগর এঙ্প্রেস ট্রেনের যাত্রীরা অপেক্ষা করছে। জয়ন্তিকার কমলাপুর স্টেশন থেকে ছেড়ে আসার কথা দুপুর ২টায়। সিলেট থেকে উপবন ট্রেনটি কমলাপুর এলেই তবে এটি জয়ন্তিকা হয়ে সিলেটের দিকে যায়। কিন্তু ওই সময়ে উপবন ট্রেনটি বিমানবন্দর স্টেশন অতিক্রম করে কমলাপুর স্টেশনের দিকে যাচ্ছিল।
গতকাল কমলাপুর ও বিমানবন্দর রেলস্টেশনে অপেক্ষারত বহু যাত্রীর কাছেই টিকিট ছিল না। বিমানবন্দরে যমুনা ট্রেনে জামালপুর যেতে অপেক্ষারত নাজিম উদ্দিন কালের কণ্ঠকে জানান, তাঁর সঙ্গে আসা আরো তিনজন স্ট্যান্ডিং টিকিট পেয়েছেন কিন্তু তিনি পাননি। এ কারণে ট্রেনের ভেতর কিংবা ছাদে_যেকোনো জায়গায় উঠে যাওয়ার পরিকল্পনা তাঁর।

No comments

Powered by Blogger.