হাট জমলেও দামে বনছে না by আলাউদ্দিন আরিফ

‘সরকার এইডা কী করলো, হামরারে মাইরা ফালাইলো, বর্ডার খুইলা দিয়া হামার মতো মাইনসির পেটে লাথি মারলো’। ঘরে পোষা গরুর দাম না পেয়ে এভাবেই আফসোস করছিলেন গাবতলী হাটে গরু নিয়ে আসা রাজশাহীর গোদাগাড়ীর বাসিন্দা খাইরুল বিশ্বাস। তিনি জানান, তিন বছর ধরে গরু পালন করে এখন যে দাম বলছে তাতে চালানও আসে না। বিশাল লোকসান গুনতে হবে। তার মতো একই অবস্থা অন্য খামারি ও বেপারিদেরও।


গরু আসার জন্য সীমান্ত উন্মুক্ত থাকায় ভারতীয় গরুতে সয়লাব হয়ে গেছে ঢাকার গবাদিপশুর হাটগুলো। শুক্রবার দুপুরের পর ঢাকার গবাদিপশুর হাটগুলোতে অস্বাভাবিক দাম দেখা গেলেও হঠাত্ অনেকটাই পড়ে গেছে গরুর দাম। কারণ বিপুল সংখ্যক ভারতীয় গরু এসেছে হাটে। ক্রেতারা বলছেন, ভারতীয় গরুর চাপে দাম তুলনামূলক নাগালে এসেছে। আর বিক্রেতারা বলছেন, বিশাল লোকসান গুনতে হবে তাদের। অবিক্রীত থেকে যাবে অনেক গরু। গতকাল ঢাকার গাবতলী, খিলগাঁও মৈত্রীসংঘের মাঠ, তেজগাঁও পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট মাঠ ও আফতাবনগর হাট ঘুরে দেখা গেছে বেপারিদের নীরব কান্না। অধিকাংশ বেপারি আশঙ্কা করছেন অনেক গরু অবিক্রীত থেকে যাওয়ার। গতকাল সকালে গাবতলী হাটের মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছিল, ‘বেপারি ভাইয়েরা, আপনারা গরুর দাম ধরে রাখবেন না। মোটামুটি লাভ হলে গরু ছেড়ে দিন। হাটে গরু রাখার জায়গা নাই, আপনার গরু বিক্রি করে যে গরুগুলো আসছে সেগুলোকে বাজারে ঢোকার ব্যবস্থা করে দিন।’
বেপারিরা জানান, এবার বর্ডার খোলা। সীমান্তে কোনো ঝামেলা না থাকায় ভারত থেকে হাজার হাজার গরু বাংলাদেশে আসছে। ফলে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরাসহ সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে গরুর দাম পড়ে গেছে। রাস্তায় যানজটে আটকা পড়ে আছে গরুবাহী অনেক ট্রাক। যমুনা সেতু এলাকায় ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে ভয়াবহ যানজট। দৌলতদিয়া ও কাওড়াকান্দিতে গরুবাহী ট্রাকগুলোকে ফেরির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ভয়াবহ যানজটের কারণে অনেক বেপারি উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে গরু নিয়ে কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের দিকে যেতে পারছেন না। তারাও ঢাকার হাটে গরু নামাতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে বিপুলসংখ্যক গরু আমদানি হওয়ায় গরুর দাম পড়ে গেছে। তবে কিছু কিছু বেপারি শেষদিন বাজার ধরার আশায় দাম ছাড়ছেন না।
রামপুরা ব্রিজের কাছে ইস্টার্ন হাউজিং সোসাইটির সামনে আফতাবনগরে বসেছে বিশাল হাট। পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে দেখা গেছে শুধু গরু আর গরু। হাটে তিলধারণের ঠাঁই নেই। রাস্তার ওপরও গরু রাখা হয়েছে। তারপরও ট্রাকে ট্রাকে গরু ঢুকছে। আফতাবনগর হাটে শেরপুরের বেপারি আওলাদ হোসেন জানান, ১৮টি গরু নিয়ে শুক্রবার হাটে গেছেন। গতকাল সকাল ১১টা পর্যন্ত একটি গরুও বিক্রি করতে পারেননি। হাটে গরু রাখার জায়গা নেই। দূরে একটি জায়গায় ক্ষেতের মধ্যে গরু রেখেছেন। ট্রাকে লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে গরুগুলো আনতে গিয়ে ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছে। গরুর খাবার কেনার মতো টাকাও তাদের পকেটে নেই। অন্তত একটি গরু বিক্রি করতে পারলেও তাদের সমস্যা কমতো। কিন্তু যে পাশে গরু রেখেছেন, সেখানে কোনো ক্রেতা যাচ্ছেন না।
পাবনা থেকে বড় আকারের ১৮টি ছাগল হাটে তুলেছেন কোরবান আলী। তিনি বলেন, দুই দিনে একটি ছাগলও বিক্রি করতে পারেননি। তার কাছে থাকা এক মণের বেশি ওজনের একটি খাসির দাম চাইছেন ৪০ হাজার টাকা। টাঙ্গাইলের সরুজ বেপারি একটি পিকআপে ২২টি ছাগল নিয়ে এসেছেন আফতাবনগর হাটে। গেটের পাশে বসেও দুই দিনে একটি ছাগলও বিক্রি করতে পারেননি তিনি। একই তথ্য জানালেন খাসির বেপারি রহমান, শামসু ও গিয়াসসহ অনেকে। তারা বলেন, খাসির বাজারও কেমন যেনো মন্দা। কেনা দামও বলেন না ক্রেতারা।
গাবতলীর গবাদিপশু ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সভাপতি নূরুল ইসলামসহ সমিতির নেতারা জানান, ভারতীয় গরুর চাপে গরুর দাম কমেছে। ফলে দেশি খামারিরা যারা ঋণ নিয়ে গরু মোটাতাজা করেছেন তারা সঠিক দামে গরু বিক্রি করতে না পারলে এই খাত বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হবে। অর্থনৈতিক মন্দা ও সব জিনিসের দাম বেশি। এতেও বাজারে গরুর চাহিদা কমেছে। তারা তাকিয়ে আছেন আজকের দিকে। যেহেতু অনেক মানুষ আজ হাটে নামবে তাই কিছুটা হলেও ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার আশা ক্রেতাদের।
গাবতলী হাটের পরিচালক মো. সোহেল জানান, বর্ডারে ঝামেলা না থাকায় ভারতীয় গরু আসছে প্রচুর। তাই গরুর অভাব নেই; কিন্তু আশানুরূপ বিক্রি হচ্ছে না। তিনি আরও জানান, গতকাল বিকাল থেকে কিছু ক্রেতা হাটে নেমেছেন।
আরমানিটোলা হাটের সীমানা নয়াবাজার হাটের সীমানা তাঁতীবাজার মোড়, রায়সাহেব বাজার মোড় ও চিত্রামহল সিনেমা হল থেকে নয়াবাজার বংশাল রোড, আরমানিটোলা ব্রিজের নিচ থেকে বাবুবাজার ঘাট ছাড়িয়ে গেছে। নবাবপুর থেকে গরু কিনতে আরমানিটোলা নয়াবাজার হাটে যাওয়া ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আজগর জানালেন, তার গরু পছন্দ হলেও দামে মিলছে না। তিনি বলেন, ‘কেবল টিভি পর্দাতেই দেখি বাজার সস্তা। হাটে এসে তো দেখি ঘটনা উল্টো।’
গুলশানের নিকেতন থেকে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট মাঠে পশুর হাটে গরু কিনতে যান চিকিত্সক মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম। সঙ্গে তার দুই প্রতিবেশী অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা শেখ মতিউর রহমান এবং ব্যবসায়ী দেওয়ান নকিবুল ইসলাম। শুক্রবারও তারা হাটে গিয়েছিলেন। তাদের মনে হচ্ছে, আগের দিনের চেয়ে গতকাল বাজারে দাম একটু কম। ঢাকা পলিটেকনিক মাঠে ৯টি গরু নিয়ে আসা জামালপুরের বেপারি বেলাল হোসেন বলেন, তারা ৫ জন মানুষ। গরুগুলোর খাওয়ার পেছনেই প্রত্যেকদিন খরচ হয় ১৫০০ টাকা। কম আর বেশি যে দামই চান, শুনেই কাস্টমার হাটা দেয়। মনে হয় তারা দর্শনার্থী, ক্রেতা নন।
রাজধানীর একমাত্র স্থায়ী পশুরহাট গাবতলী ছাড়া ডিসিসির অনুমোদনপ্রাপ্ত অস্থায়ী হাটগুলো হচ্ছে ঝিগাতলা হাজারীবাগ মাঠ, তালতলা বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন খালি মাঠ, রহমতগঞ্জ খেলার মাঠ, উত্তর শাহজানপুর খিলগাঁও রেলগেট বাজার সংলগ্ন মৈত্রীসংঘের মাঠ, উত্তরা আজমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ, গোপীবাগের ব্রাদার্স ইউনিয়ন সংলগ্ন বালুর মাঠ, খিলগাঁও মেরাদিয়া বাজার, ধুপখোলা ক্লাব মাঠ ও গোলাপবাগ মাঠসংলগ্ন ডিসিসির আদর্শ স্কুল মাঠ। এর বাইরে আফতাবনগর, শনির আখড়াসহ কয়েকটি হাটের ইজারা দিয়েছে ঢাকা জেলা প্রশাসন।
হাসিল শতকরা ৫ টাকা : ঢাকার অস্থায়ী হাটগুলোতে শতকরা ৫ টাকা বা হাজারে ৫০ টাকা হিসাবে হাসিল আদায় করা হচ্ছে। একলাখ টাকা দামের একটি গরুর হাসিল দিতে হয় ৫ হাজার টাকা। হাটে বেপারি ও ক্রেতাদের নিরাপত্তার জন্য র্যাব, পুলিশ, গোয়েন্দা বাহিনী ছাড়াও তাদের নিজস্ব ভলান্টিয়ার রয়েছে। হাটে রয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা। সবগুলো হাটেই বসানো হয়েছে জালটাকা শনাক্তের মেশিন।
খড় ও ভুসির বাজার : ঢাকার রাস্তার মোড়ে মোড়ে এখন খড়ের গাদা। আর আছে কাঁচা ঘাস, ভুসি, খৈল আর কাঁঠাল পাতার দোকান। কোরবানির এক-দুই দিন আগে যারা গরু কিনেন তারা এসবের ক্রেতা। এক কেজি বুটের ভুসি ৩০ টাকা, খড়ের আঁটি ১০ টাকা, কাঁঠাল পাতার আঁটি ১০ টাকা, কুড়া ৩০ টাকা, খৈল ৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.