সুখ দুঃখের গল্প by সন্জীদা খাতুন

৯৬১ সালে রবীন্দ্র শততমবার্ষিকী অনুষ্ঠান করলাম আমরা। শতবার্ষিকী পালন করবার পরে ৩১নং র‌্যাঙ্কিন স্টিটের সিধু ভাই [মোখলেসুর রহমান], রোজ বু [শামসুন্নাহার রহমান], গোপীবাগের আহমেদুর রহমান ['ইত্তেফাকে'র ভীমরুল], ছানা [মীজানুর রহমান], মানিক [সাইফউদ্দীন আহমেদ], আরও অনেকে, অন্যান্য অঞ্চল থেকে সুফিয়া কামাল, সাইদুল হাসান ও ফরিদা হাসান, ওয়াহিদুল হক এবং আরও বহু কর্মী একত্র হয়ে বনভোজনে যাওয়া হলো


একদিন জয়দেবপুরে। সেখানেই বসে বিকেলবেলার সভায় সাংস্কৃতিক আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্য সমিতি গঠন করা হলো। ছায়ানটের জন্মকথা এই।
সংগঠনের সূচনায় রবীন্দ্রনাথ আমাদের প্রেরণা হলেও, ছায়ানট সংঘবদ্ধ হলো সমগ্র বাঙালি সংস্কৃতির উজ্জীবন ও প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে চলবার জন্যে। তাই ছায়ানটের প্রথম অনুষ্ঠান পুরনো গানের আসর, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে। পরিচালনায় আবদুল আহাদ। সমগ্র বাংলার বিশিষ্ট সুরকার গীতরচয়িতাদের সঙ্গীতের ভিতর দিয়ে বাঙালি ঐতিহ্য স্মরণ করা হয়েছিল সেদিন। ফেরদৌসী রহমান যে-দুটি গান গেয়েছিলেন, তার উল্লেখ থেকেই সঙ্গীত নির্বাচনের কালপরিধি বোঝা যাবে। তাঁর প্রথম গান_ কাননবালার গাওয়া বিদ্যাপতির রচনা 'অঙ্গনে আওব যব রাসিয়া', দ্বিতীয় গান_ হিমাংশু দত্ত সুরসাগরের 'রাতের ময়ূর ছড়ালো যে পাখা'। এতদিন শাসককুল অত্যন্ত বক্রভাব নিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান পর্যন্ত কোনোমতে সহ্য করে আসছেন। বিদ্যাপতির গান বা দ্বিজেন্দ্রলাল অতুলপ্রসাদ রজনীকান্ত প্রমুখ গীতিকারের গান যে চলতে পারে, আর এদেশের ঐতিহ্য বলে স্বীকৃত হতে পারে_ এ কথা ভাবা যেত না এত কাল। ফরিদা হাসান তখন ছায়ানটের সম্পাদক। আর সভাপতি_ সুফিয়া কামাল। প্রথম অনুষ্ঠানের পর নানা সাংগঠনিক অসুবিধার দরুন ছায়ানটের কাজ কিছুদিনের জন্য বন্ধ থাকে। কিন্তু সাংস্কৃতিক তৎপরতার জন্য এমন একটা ব্যাকুলতা মানুষের মনে ছিল যে, সব অসুবিধা ঠেলে ছায়ানট আবার কাজে নামল। এবারে সম্পাদক কামাল লোহানী। সুফিয়া কামাল তো সভাপতির আসনে রয়েছেনই।
কার্যকরী সংসদের নতুন বিন্যাসের পর ছায়ানটের একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, সম্পাদকই কেবল কর্মসম্পাদনের সকল দায়িত্বে অধিষ্ঠিত থাকলেন না। সকল সদস্য সমান উৎসাহে প্রতিষ্ঠানের কর্মসূচি সফল করবার জন্য কাজ করতে লাগলেন।
তারপর আজ পর্যন্ত কতজনই সম্পাদক হলেন। লোহানীর পরে সম্পাদক হয়েছেন জিয়াউদ্দীন, তারপরে জাহিদুর রহিম, জাহিদের পর সাইফুদ্ দৌলা, তারপরে ইফ্ফাত আরা দেওয়ান, এখন খায়রুল আনাম। ছায়ানটের অনুষ্ঠানের রুচিসম্মত উদ্যাপনের জন্য প্রত্যেকে যার-পর-নাই সচেষ্ট ছিলেন। কী নিমন্ত্রণ-লিপি পরিকল্পনায়_ কী মঞ্চসজ্জার শিল্পে_ পরিশীলনের পরিচয় অক্ষুণ্ন রাখবার চেষ্টা থাকত। ছায়ানট মনে করল, বাঙালিকে তার গানের ঐতিহ্য স্মরণ করিয়ে দিতে হবে, তার সঙ্গীতরুচিতে আনতে হবে আভিজাত্য। ছায়ানটের জন্মের সময়ে কলকাতার অনুসরণে, বিদেশি অনুকরণে গলা-কাঁপানো আধুনিক গানই সাধারণ শ্রোতৃসমাজের চিত্তবিনোদন করছিল। কাব্যাংশের সেন্সারের পর পাস-হওয়া কিছু নজরুলসঙ্গীত অবশ্য বাজারে চালু ছিল। রাজার অভিপ্রায় আঁচ করে পারিষদেরা তারই সোৎসাহ পৃষ্ঠপোষণ করে চলছিলেন বেতারে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। উচ্চাঙ্গসঙ্গীত তখন ুচিতে ছিল দুঃসহ। আসরে গাইতে বসে, চুটকি গানের ফরমায়েশ শুনে, ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি মর্মাহত হয়ে ফিরেছিলেন ঢাকা থেকে। রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং অন্যান্য মার্জিত রুচির গানও সাধারণ শিক্ষিত মনে ঢেউ জাগাতে পারছিল না সেই সময়টাতে।
রুচিগঠনের প্রয়োজন অনুভব করা গেল তাই। ঘরোয়া আসরে সুরুচিসম্মত গান পরিবেশনের ব্যবস্থা হলো। একত্রিশ নম্বর র‌্যাঙ্কিন স্ট্রিটে ইংরেজি 'এল' ছাঁদের একটি বৃহৎ কক্ষের কোণাকৃতি অংশে নিচু চৌকি পেতে ক্ষুদ্র মঞ্চ তৈরি হলো। সুদৃশ্য মঞ্চ-আবরণীর ওপর বৃহৎ থালিতে পুষ্পসম্ভার। মোমবাতির শুভ্র কোমল আলোকে ফুলগন্ধমোদিত সি্নগ্ধ পরিবেশে প্রথমে কলকাতা থেকে আগত শিল্পী ফিরোজা বেগম গান শুনিয়েছিলেন। পরবর্তী অনুষ্ঠানে একক কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন হলো। শিল্পী_ ফাহ্মিদা খাতুন। পরবর্তী অনুষ্ঠান_ উচ্চাঙ্গসঙ্গীত। প্রথমে, সেতারে খাদেম হোসেন, পরে কণ্ঠসঙ্গীতে ইউসুফ খান কোরেশী ও ইয়াসিন খান।
শ্রোতাদের বসবার ব্যবস্থা ফরাশে। নীরবে সঙ্গীতরসে হৃদয়পূর্ণ করবার উপযোগী সেই ভাবগম্ভীর পরিবেশে, আমন্ত্রিত সকলের মনে মুগ্ধ বিস্ময় জেগেছিল।
এ রকম 'শ্রোতার আসরে'র অধিবেশন হয় বেশ কয়েকটি। পরপর আসর করতে গিয়ে শিগগিরই দেশে শিল্পীর অভাব অনুভব করা গেল। উন্নত ধরনের সঙ্গীত শোনাবার আয়োজন করতে হলে গুটিকয়েক শিল্পীকেই ফিরে ফিরে ডাকতে হয়। এর থেকে উদ্ধারের পথ খুঁজতে গিয়ে দুঃসাহসিক পরিকল্পনা নেওয়া হলো_ সঙ্গীত-শিক্ষালয় স্থাপন করতে হবে আমাদের। সেখান থেকে সাধনা করে জন্ম নেবে নতুন শিল্পী।
অর্থ আসবে কোথা থেকে? অন্তরে সাধ আছে, কিন্তু সাধ্য কতটুকু? শ্রোতা সদস্যদের কাছ থেকে কিছু চাঁদা নিয়ে কোনোমতে শ্রোতার আসর চলে। বিদ্যালয় চালাবার খরচ বহন হবে কীসে? অনেকের আপত্তি সত্ত্বেও, কার্যকরী সংসদের সভ্যদের সকলের নামে চাঁদা ধার্য হলো। তা ছাড়া রইল ছাত্রবেতনের ভরসা। সে কত? ছোটদের তিন টাকা, বড়দের পাঁচ টাকা? নাকি ছোটদের পাঁচ টাকা, বড়দের সাত টাকা? ঐ বেতনের কথা ভুলতে পারিনি বলে আজও ছায়ানটের বেতন মাথাপিছু মাত্র একশো টাকা রয়ে গেছে, আর বাড়ানো যায়নি। আর এই বিদ্যায়তন শুরু করা সম্ভব হয়েছিল ওয়াহিদুল হকের প্রবল জিদে। শংকর মোড়ে আজকে যে ছায়ানট ভবন দেখতে পাওয়া যায় তা শুধু সঙ্গীতপ্রেমী নয়, এদেশের মানুষের ভালোবাসার প্রতিদান। অনেক সংগ্রামের ফসল।
হ লেখক : সভাপতি, ছায়ানট

No comments

Powered by Blogger.