আওয়ামী লীগ : শ্রীবরদী ও ঝিনাইগাতী-টাকার গন্ধ যেখানে 'এমপির লোক' সেখানে!

সীমান্তবর্তী দুটি উপজেলা শ্রীবরদী ও ঝিনাইগাতী নিয়ে গঠিত শেরপুর-৩ আসন। এ আসনটি স্বাধীনতার পর থেকেই 'লাকি' আসন হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। স্বাধীনতার পর যতবার সংসদ নির্বাচন হয়েছে প্রতিবারই এ আসনে বিজয়ী প্রার্থীর দলই সরকার গঠন করেছে। যে কারণে স্থানীয়ভাবে এমনকি জাতীয়ভাবেও আসনটি ভোটের রাজনীতির আলোচনায় সব সময় স্থান পেয়ে আসছে। কিন্তু এ 'লাকি' আসনে যতবার আওয়ামী লীগ ব্যর্থ হয়েছে এর পেছনে ততবারই 'আনলাকি ফ্যাক্টর' হিসেবে কাজ করেছে দলীয় কোন্দল।


১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ব্যবসায়ী এম এ বারীকে মনোনয়ন দিয়ে আসনটি লাভ করে চমক দেখায়। কিন্তু আসনটি পাওয়ার পর থেকেই এম এ বারী অরাজনৈতিক ব্যক্তি হওয়ায় শ্রীবরদী ও ঝিনাইগাতীর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব তৈরি হয়। দলের ত্যাগী নেতা-কর্মীরা তাঁর বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও ২০০১ সালের নির্বাচনে এম এ বারীকেই দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হলে তাঁর ভরাডুবি হয় বিএনপির তরুণ নেতা মাহমুদুল রুবেলের কাছে। এর মাঝেই জাতীয় পার্টি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেন সাবেক সংসদ সদস্য খন্দকার মো. খুররম। অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী ফজলুল হক চানও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা মতিয়া চৌধুরীর আশীর্বাদে স্থানীয় রাজনীতিতে নিজেকে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যেতে থাকেন। এ সময় দলীয় কোন্দল প্রকট হয়ে উঠলে জেলা আওয়ামী লীগের কোন্দল নিরসনে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। একপর্যায়ে সেই কমিটির মধ্যে বিভেদ দেখা দিলে তদন্ত কমিটির কোনো প্রতিবেদন আজ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। সাবেক সংসদ সদস্য এম এ বারী মারা যাওয়ায় গত নির্বাচনে সংসদ সদস্য পদে দলীয় মনোনয়নের জন্য প্রকৌশলী ফজলুল হক চান ও খন্দকার মো. খুররমের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত প্রকৌশলী ফজলুল হক চান দলীয় মনোনয়ন পান। কিন্তু খন্দকার মো. খুররম বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে স্বতন্ত্রভাবে সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। প্রকৌশলী ফজলুল হক চান বিএনপির সাবেক এমপি ও গত সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী মাহমুদুল হক রুবেলের আপন চাচা হওয়ায় দলের বেশির ভাগ ত্যাগী নেতা-কর্মী সে সময় খুররমের পক্ষে অবস্থান নেন। কিন্তু প্রকৌশলী ফজলুল হক চান নির্বাচনে জয়লাভ করেন। সেই থেকে দলের ভেতর যে কোন্দল শুরু হয়েছে তা এখনো আওয়ামী লীগের পিছু ছাড়ছে না।
প্রায় ৯ বছর হলো সম্মেলনের মাধ্যমে শ্রীবরদী ও ঝিনাইগাতী উপজেলায় আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়েছে। কিন্তু সেই কমিটির নেতারা এখন কার্যত দুই ভাগ হয়ে গেছেন। একটি অংশ সংসদ সদস্য প্রকৌশলী ফজলুল হক চানের আস্থা ও অনুগ্রহভাজন হিসেবে সরকারি বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নিজেদের সম্পৃক্ত রেখেছে। অন্য অংশ কিছুটা অভিমানে এবং অনেকটা কোণঠাসা হওয়ার কারণে দূরে সরে রয়েছে।
এমপির অনুগ্রহভাজন নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দলীয় অনেক নেতা-কর্মী এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা ধরনের কথা প্রচলিত রয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে কাবিখা, কাবিটা, টিআর ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অর্থ ভাগবাটোয়ারা, ঠিকাদারির কমিশন, চাকরি ও নিয়োগ বাণিজ্য, থানা-পুলিশ নিয়ন্ত্রণ, হাসপাতালের সার্টিফিকেট, এমপির সুপারিশ বা ডিও বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। শ্রীবরদী উপজেলা হাসপাতাল রোডের এক আওয়ামী লীগ নেতার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান স্থানীয় লোকজনের 'এমপির গোডাউন' এবং 'চাকরির সার্ভিস সেন্টার' নামে পরিচিতি পেয়েছে। ঝিনাইগাতী উপজেলা আওয়ামী লীগের কয়েক নেতার বিরুদ্ধে এমপির প্রতিনিধি পরিচয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সিংহভাগ লুটপুটে খাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। দলীয় নেতাদের এমন কর্মকাণ্ডে অনেক সাধারণ নেতা-কর্মীই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, এমপির দোহাই দিয়ে এসব নেতা-কর্মী যা শুরু করেছেন, তা দলের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সামনে এর মাশুল গুনতে হবে দলকেই। মুষ্টিমেয় কিছু লোকের জন্য দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। তবে শ্রীবরদী ও ঝিনাইগাতী উপজেলার দলীয় অনেক নেতা-কর্মীই এসব বিষয়ে বলেন, 'কাউন্সিলে অনেক হেতকেত (উল্টাপাল্টা কথাবার্তা) হবে। কাউন্সিলে ভোটের মাধ্যমে ওইসব নেতাদের এসব কর্মকাণ্ডের জবাব দেওয়া হবে।'
শ্রীবরদীতে উপজেলা আওয়ামী লীগের কোনো অফিস নেই। এক বছরের বেশি সময় হলো সাধারণ সম্পাদক আজাহার আলী মারা গেছেন। কিন্তু ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক কে হবেন তা এখনো ঠিক হয়নি। শ্রীবরদীতে দলীয় একটি কর্মসূচিও পালিত হয় না। উপজেলা যুবলীগের কমিটি সম্প্রতি বাতিল করা হয়েছে। ছাত্রলীগের কমিটিও পূর্ণাঙ্গ হয়নি। ইউনিয়ন কমিটিগুলোও সব হয়নি। ঝিনাইগাতী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি একদিকে, আর সাধারণ সম্পাদকসহ কমিটির অন্যরা আরেকদিকে। এদিকে দলীয় কোন্দলের কারণে শ্রীবরদী ও ঝিনাইগাতীতে উপজেলা নির্বাচনে দলীয় নেতা-কর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়েন। যে কারণে দুই উপজেলাতেই উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী জয়ী হতে পারেননি।
এসব বিষয়ে শ্রীবরদী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আশরাফ হোসেন খোকা বলেন, দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম ঠিকভাবেই চলছে। তবে কিছু লোক এমপির নাম ভাঙিয়ে নানা ধরনের অপকর্মে জড়িত বলে কথা উঠেছে। ঈদের পর এমপি সাহেবের উপস্থিতিতে দলের সভা করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ঝিনাইগাতী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এমএসএ ওয়ারেজ নাঈম বলেন, ঝিনাইগাতীতেও দলের সাংগঠনিক অবস্থান ভালো। সরকারের উন্নয়নমূলক নানা কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন হচ্ছে। তবে এমপি সাহেব অসুস্থ থাকার কারণে এলাকায় আসতে না পারায় সবকিছু ঠিকমতো মনিটরিং হচ্ছে না_এটা ঠিক। কিছু লোক এমপি সাহেবের প্রতিনিধি হিসেবে নানা কাজকর্ম করে থাকে। তাদের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠছে। এর দায়ভার চাপছে এমপির ঘাড়ে। এতে দলের সুনাম নষ্ট হচ্ছে বলে তিনি স্বীকার করেন।

No comments

Powered by Blogger.