পাটের দামে ধস : কৃষকের ভোগান্তি by ড. জাহাঙ্গীর আলম

পাটের বাজার খুবই মন্দা যাচ্ছে। এবার পাট উৎপাদিত হয়েছে বেশি। বাজারে পাটের সরবরাহ বেশি, কিন্তু ক্রেতা কম। ব্যাপারীরা ময়ালে ঘুরছেন, বাজারেও আসছেন, পাটের দরদাম করছেন, কিন্তু খুব একটা কিনছেন না। তাঁরা গড়পড়তা হাজার টাকার ওপর খুব বেশি দর করছেন না প্রতি মণ পাটের। ফলে কৃষকরা হতাশ হচ্ছেন। গত বছরের তুলনায় মাত্র প্রায় অর্ধেক দামে পাট বিক্রি করতে চাইছেন না অনেকে। এতে তাঁদের উৎপাদন খরচও আসছে না।


ফলে বোঝা বয়ে চাষিরা পাট ফিরিয়ে নিয়ে আসছেন বাজার থেকে। তাঁদের ঘরের পাট ঘরেই পড়ে থাকছে। পাট নিয়ে তাঁদের উৎকণ্ঠা ও বিড়ম্বনা বাড়ছে।
গত বছর পাটের বাজার ছিল তেজি। এর দাম ছিল মণপ্রতি এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকা। সেবার মোট উৎপাদন ছিল প্রায় ৭৮ লাখ বেল। এবার উৎসাহী কৃষকরা পাট চাষ করেছেন অনেক বেশি জমিতে। কম করে হলেও এবার পাট উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ১০০ লাখ বেল। এতে স্থান এবং প্রকারভেদে বাজারে পাটের দাম কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছে মণপ্রতি ৮০০ থেকে এক হাজার ৬০০ টাকায়। এখন উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে লোকসান না গুনে কৃষকের কোনো উপায় নেই। পাটের উৎপাদন খরচ বহুলাংশে নির্ভর করে প্রতি ইউনিট ফলনের ওপর। ফলন বেশি হলে উৎপাদন খরচ কমে আসে। গত বছরের তুলনায় এবার পাট চাষাধীন এলাকা বেড়েছে, কিন্তু ফলন তেমন বাড়েনি। অন্যদিকে উৎপাদনের উপকরণ খরচ বেড়েছে। তাতে মণপ্রতি পাটের উৎপাদন খরচ বেড়েছে।
বাংলাদেশে পাটের বাজারে ধস নামার প্রধান কারণ, আন্তর্জাতিক বাজারে এবার পাটের চাহিদা হ্রাস। এখনো বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশি পাটের জন্য তেমন ক্রয়াদেশ দিতে শুরু করেনি। মিসর, লিবিয়া ও সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক সংকটের কারণে সেখানে পাটের বাজার সংকুচিত। অন্যান্য আমদানিকারক দেশের ব্যবসায়ীরা এখনো বাংলাদেশের বাজার পর্যবেক্ষণ করছেন। ফলে বিদেশ থেকে তেমন ক্রয়াদেশ পাচ্ছে না বাংলাদেশ। অভ্যন্তরীণ বাজারের ক্রেতারাও অনেকটা হাত গুটিয়ে বসে আছে। সরকারি ও বেসরকারি পাটকলগুলো বাজার থেকে বেশি করে পাট কিনতে পারছে না মূলত অর্থাভাবে। পাট কেনার জন্য এখনো সরকার থেকে টাকা পায়নি বিজেএমসি। এ প্রতিষ্ঠানটি এখন পাট কিনছে নিজস্ব তহবিল থেকে। তা ছাড়া গত বছরের কেনা অনেক পাট এখনো সরকারি ও বেসরকারি গুদামগুলোতে জমা হয়ে আছে। এবার তাই মিলগুলোর নতুন পাট কেনার সামর্থ্য ও সংগ্রহ কম। ফলে পাটের বাজারে এখন এক অভাবনীয় মন্দা বিরাজ করছে। পাট বিক্রি করতে না পেরে যারপরনাই হতাশ হচ্ছেন কৃষকরা। পাট কাটার পর তা শুকিয়ে দ্রুত বিক্রি করতে না পেরে ঘরে স্তূপ করে রাখার ঝামেলা অনেক। প্রথমত, অর্থনৈতিক বিভ্রাট। এটা নগদ অর্থের সংকট সৃষ্টি করছে চাষিদের জন্য। তা ছাড়া চুরি-ডাকাতি, আগুন লেগে পুড়ে যাওয়া, ইঁদুরে খাওয়া, বৃষ্টির পানিতে নষ্ট হওয়া প্রভৃতি ঝামেলা আছে ঘরে পাট ধরে রাখার পেছনে। তদুপরি অনেক কৃষকের ঘর থাকে না, অনেক ব্যাপারীর গুদাম থাকে না পাট স্তূপ করে রাখার জন্য। ফলে তাড়াতাড়ি পাট বিক্রি করতে না পেরে চাষিদের ভোগান্তি ও বিড়ম্বনার এবার আর অন্ত নেই। পাট বাংলাদেশের সোনালি আঁশ। কৃষকদের জন্য নগদ অর্থের সংস্থান করে দিচ্ছে পাট। মহাজনের বা ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ, ছেলেমেয়ের পড়ার খরচ, সন্তানের বিয়ে, বউয়ের শাড়ি-গয়না, জমি কেনা_চাষিদের সবই হয় পাট বিক্রির অর্থ দিয়ে। গ্রাম ও শহরে আদিকাল থেকে পাটের জমজমাট ব্যবসা করছে অনেক মানুষ। দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে বাজার, পাটগুদাম, পাটকল ও বাণিজ্যকেন্দ্র। তাতে কর্মসংস্থান হচ্ছে অনেকের। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশের পাট যাচ্ছে যুক্তরাজ্য, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, রাশিয়া, চীন, থাইল্যান্ড, ভারত, ব্রাজিল ও আমেরিকায়। তাতে অর্জিত হচ্ছে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। পাটকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে এ দেশের সংস্কৃতি। এখনকার রাজনীতির অঙ্গনও মুখর করে রেখেছে এ দেশের পাট। পাটকে ঘিরে অতীতে অনেক স্বপ্ন দেখেছে এ দেশের মানুষ। হয়তো দেখবে ভবিষ্যতেও।
পাট এক প্রকার দ্বিবীজপত্রী আঁশযুক্ত গাছ। এর ছাল থেকে হয় আঁশ, আর ভেতরে থাকে কাঠি। প্রাচীনকালে একে বলা হতো নালিতা। অনেকের মতে, ওড়িয়া শব্দ 'ঝুট' বা সংস্কৃত শব্দ 'জুট' থেকে ইংরেজি 'জুট' শব্দের উৎপত্তি। কেউ কেউ মনে করেন, পাটের আদি নিবাস দক্ষিণ চীন ও আফ্রিকায়। মতান্তরে, মালয় কিংবা শ্রীলঙ্কা পাটের উৎপত্তিস্থল। ভারতে এর চাষ শুরু হয় বাগানের উদ্ভিদ হিসেবে। প্রথমে এর ব্যবহার হতো সবজি এবং ঔষধি গাছ হিসেবে। বস্ত্র হিসেবেও পাটের ব্যবহার অনেক পুরনো। পাটবস্ত্র ব্যবহারের কথা উল্লেখ আছে মহাভারত এবং বাইবেলেও।
পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশই ছিল ব্রিটিশ ভারতে কাঁচা পাটের সর্ববৃহৎ জোগানদার। বর্তমানে এই শরিকানা বহুলাংশেই হ্রাস পেয়েছে। এখন পাট উৎপাদনের প্রধান অংশীদার ভারত, যেখানে একসময় পাটের উৎপাদন ছিল খুবই কম।
১৯৬৯-৭০ সালে বাংলাদেশে পাট উৎপাদন হয়েছিল ১২ লাখ ৮০ হাজার টন। ওই বছর ভারতের উৎপাদন ছিল ৯ লাখ ৯৪ হাজার টন। ২০০৭-০৮ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট উৎপাদন হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৩৭ লাখ টনে। অন্যদিকে ভারতের উৎপাদন বেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৮২ লাখ টনে। একই সময় বাংলাদেশে পাট চাষাধীন জমির পরিমাণ কমেছে, অথচ ভারতে তা বেড়েছে। এর প্রধান কারণ, বিশ্ববাজারে পাটের বিকল্প হিসেবে সিনথেটিকের আবির্ভাব, বাংলাদেশে পাটকলগুলোর দৈন্যদশা, পাটচাষে কৃষকদের প্রণোদনাহীনতা এবং পাটজমি ধানিজমিতে রূপান্তর। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে পাটের অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা বেড়েছে। সগৌরবে গড়ে উঠেছে নতুন নতুন পাটকল। কৃষকরা পাচ্ছেন প্রণোদনামূলক মূল্য। তাতে বাড়ছে পাটের উৎপাদন। স্বাধীনতার আগে বিশ্বের পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের শরিকানা ছিল প্রায় ৮০ শতাংশ। বর্তমানে তা নেমে গেছে ৩৪ শতাংশে। অন্যদিকে ভারতের অংশীদারি দ্রুত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৬ শতাংশে। বাংলাদেশের পাটকলগুলোর উন্নয়ন এবং পাটের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির মাধ্যমে পাটচাষে কৃষকদের প্রণোদনা জোগানো ছাড়া এখানকার পাট উৎপাদনের হ্রাসমান ধারা ঠেকানো দুষ্কর।
বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি পাটের আধিপত্য এখনো বিরাজমান। কাঁচা পাট রপ্তানির ক্ষেত্রে ২০০৭-০৮ সালে বাংলাদেশের শরিকানা ছিল ৯৭ শতাংশ এবং পাটজাত দ্রব্যের ক্ষেত্রে ছিল ৬৩ শতাংশ। বাংলাদেশি কাঁচা পাট প্রধানত রপ্তানি করা হয় ভারত, পাকিস্তান, চীন, ইউরোপ, আইভরি কোস্ট, থাইল্যান্ড এবং অন্যান্য দেশে। অন্যদিকে পাটজাত দ্রব্যও রপ্তানি করা হয় ইউরোপ, তুরস্ক, ইরান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সিরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব, জাপান, সুদান, ঘানা এবং অন্যান্য রাষ্ট্রে। আমাদের কাঁচা পাট রপ্তানির ক্ষেত্রে পাকিস্তান, চীন ও ভারত এবং পাটজাত দ্রব্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ইউরোপ ও তুরস্কের স্থান সবার শীর্ষে। বর্তমানে পাটের বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। কারণ পলিথিন এবং সিনথেটিকের ব্যবহারকে বিশ্বব্যাপী এখন নিরুৎসাহী করছে পরিবেশবাদীরা।
পলিথিন ও সিনথেটিক দ্রব্য পচনশীল নয় বিধায় এগুলো পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। অন্যদিকে পাট পরিবেশবান্ধব। তাই এর চাহিদা বিশ্বব্যাপী। এটা চলমান থাকবে। মধ্যপ্রাচ্য সংকটের কারণে এবারকার সম্ভাব্য চাহিদা হ্রাসের বিষয়টি সাময়িক। মৌসুমের শেষ নাগাদ পাটের আন্তর্জাতিক বাজার চাঙ্গা হতে পারে। তৎপর হয়ে উঠতে পারে আমদানিকারকরা।
পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি পাটের কদর বাড়ছে আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারেও। তবে এর গতি অত্যন্ত শ্লথ। পাটের ব্যাগ, থলি ইত্যাদি ব্যবহারের ওপর সরকারি ও বেসরকারিভাবে গুরুত্বারোপ করা হলেও তা সব সময় মেনে চলা হচ্ছে না।
পাটের ব্যবহার মূলত প্যাকেজিংয়ের কাঁচামাল হিসেবে। আমাদের চটের ব্যাগের খ্যাতি রয়েছে বিশ্বজোড়া। পাটকাঠি গ্রামের মানুষের জ্বালানি এবং ঘরের বেড়া নির্মাণের একটি বিশেষ অবলম্বন। প্রথাগতভাবে পাটের ব্যবহার হচ্ছে রশি, সুতলি, শিকা, পাকানো সুতা, হাতে তৈরি কাপড়, কম্বল, মাদুর, গালিচা এবং দেয়ালের আচ্ছাদন হিসেবে। গোয়ালঘরে গরু বাঁধা, নৌকা ঘাটে বেঁধে রাখা কিংবা গুণ টানা এবং মাছ ধরার কাজে পাটের দড়ি ও সুতার ব্যবহার এ দেশে খুবই জনপ্রিয়। পাটের সুতা দিয়ে শাড়ি ও লুঙ্গি তৈরি সম্পর্কেও আমরা অবহিত। বর্তমানে শপিং ব্যাগ হিসেবেও এর ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। তা ছাড়া কাঁচা পাট ব্যবহার করে কাগজ তৈরির পাল্প, তুলার সঙ্গে পাট মিশিয়ে মিহি সুতা, ঘরের আসবাবপত্র তৈরির জন্য জুটোপ্লাস্টিক সামগ্রী, নদী ও রাস্তার ভাঙন রোধকল্পে জুট জিও-টেঙ্টাইল প্রভৃতির সঙ্গেও আমরা পরিচিত। পাট থেকে মূল্যবান কার্পেট তৈরির বিষয়টিও এখানে উল্লেখ করার মতো। এসব ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ বাজারে পাটের ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টি করা খুবই প্রয়োজন। অন্যথায় শুধুই আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল থেকে অভ্যন্তরীণ বাজারে পাটের মূল্য স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হবে না। বর্তমানে পাটের দামে যে ধস নেমেছে, তা মোকাবিলা করার জন্য আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বাজারে দ্রুত হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন উৎপাদিত বা ক্রয়কৃত মজুদ পাট জামানত হিসেবে রেখে দ্রুত ঋণ দিয়ে কৃষক এবং গ্রামীণ ব্যাপারীদের সহায়তা করা। তা ছাড়া বিজেএমসি এবং বেসরকারি পাটকলগুলোকে আর্থিক বরাদ্দ ও ঋণ দিয়ে কাঁচা পাট ক্রয়ে আগ্রহী করে তোলা। তদুপরি পাট শিল্প খাতে ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে পাট এবং পাটজাত পণ্যের উৎপাদন ও রপ্তানিকে উৎসাহী করা। তাতে অভ্যন্তরীণ বাজারে কাঁচা পাট ক্রয়ে গতিশীলতা আসবে। আস্থা ফিরে আসবে পাটচাষিদের মনে। পাট বাংলাদেশের ঐতিহ্য। এটা বাঙালি সংস্কৃতিরই একটি অপরিহার্য অংশ। এ দেশের কৃষকদের নগদ অর্থোপার্জনে, কর্মসংস্থানে, দারিদ্র্য বিমোচন, বৈদেশিক মুদ্রা আহরণে, সর্বোপরি জাতীয় অর্থনীতিকে শক্তভাবে বিনির্মাণে পাটের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে বিশ্ববাজারে পাটের চাহিদা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে পাটের উৎপাদন বৃদ্ধির যে অমিত সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচিত হয়েছে, তাকে সাময়িক মন্দার কারণে বিনষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। সব আন্তরিকতা দিয়ে আমাদের এর মোকাবিলা করতে হবে। এর জন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোক্তা এবং নীতিনির্ধারকদের খোলা মনে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ

No comments

Powered by Blogger.