ভারত-পাকিস্তান-বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য অগ্রগতির নিয়ামক by সুভাষ সাহা

৫ বছর পর কথিত দুই চিরবৈরী দেশের বাণিজ্যমন্ত্রীদের বৈঠকে মিলিত হওয়ার ঘটনা নিশ্চয়ই প্রতীকী নয়, পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা ও কার্যকর বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করার উদ্দেশ্যেই। দক্ষিণ এশিয়ার এই দুটি দেশের সামনে কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে বিরোধ অবসানের বাস্তব পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছেএক সাংবাদিক বন্ধু কয়েক বছর আগে পাকিস্তান সফরের সময় সিন্ধু প্রদেশে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সেখানকার আঞ্চলিক


ধারার নৃত্য পরিবেশন প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন। এটি অনেকটা বাঙালির ফসল তোলার (নবান্ন) সময়ের নৃত্যের মতো। পোশাক-আশাকের বৈচিত্র্য ছাড়া নাচের মুদ্রা প্রায় একই রকমের। আসলে দক্ষিণ এশিয়ার লোকায়ত সংস্কৃতি, যেমন_ নাচ-গান, পালা-পার্বণ, অতিথি আপ্যায়ন, বিয়ের অনুষ্ঠান ইত্যাদির মধ্যে এক অদ্ভুত মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। নানা ভাষা, নানা নৃগোষ্ঠী, নানা ধর্ম ও জাতি নিয়ে গঠিত এই দক্ষিণ এশিয়া এক চমৎকার বাস্তব-পরাবাস্তবের মিশেল।
দক্ষিণ এশিয়ায় বিভিন্ন জাতি-রাষ্ট্রের পৃথক দেয়াল তৈরি হওয়ার বিষয়টি তো এই সেদিনের ঘটনা। জাত-পাত, নৃগোষ্ঠীগত স্বার্থ, ধর্মীয় সংকীর্ণতা ইত্যাদি আমাদের মধ্যে কৃত্রিম দেয়াল খাড়া করে শেখায়_ বর্তমানের মধ্যেই তোমাদের আসল পরিচিতি। ভারতবর্ষ বিভক্তির সময় আট লাখ মানবশবের মিছিল ও এক কোটি মানুষের বাস্তুভিটা ত্যাগ দক্ষিণ এশিয়ার অভিন্ন সত্তার মধ্যে বিষবাষ্প ঢুকিয়ে দিয়ে এই নতুন পরিচিতিকে স্থায়ী করতে চেষ্টা করেছে। তাতে কি গোটা অঞ্চলের লোকায়ত সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্যে অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মতো প্রবহমান বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যকে ধরার নিরন্তর ঊর্ধ্বমুখী চেষ্টা বন্ধ হয়েছে? না হয়নি। আর হয়নি বলেই দক্ষিণ এশিয়ার কথিত চিরশত্রু নামে ষাট বছরেরও বেশি সময় ধরে পরিচিত দুটি দেশ ভারত ও পাকিস্তান নিজেদের বিরোধ শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের মাধ্যমে আবার বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য_ এই আদি ঐতিহ্যিক ধারায় ফিরে যাওয়ার বন্ধুর পথ পাড়ি দেওয়ার সংকল্প করেছে।
দেশ দুটির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই কাশ্মীর বিরোধের উপলক্ষ হয়ে রয়েছে। একটা সময়ে তো একে কেন্দ্র করে দেশ দুটির মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের প্রচণ্ড ঝুঁকিও সৃষ্টি হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক চাপ ও দেশ দুটির যুক্তিবাদী মানুষের বোধোদয়ের কারণে দক্ষিণ এশিয়া ভয়াবহ বিধ্বংসী পরিণতি থেকে রক্ষা পায়। তখন থেকেই বস্তুত ভারত-পাকিস্তান বিরোধের স্থায়ী সমাধান অন্বেষা শুরু।
তবে এর আগেও দুটি দেশের সুধী সমাজের একাংশ এমনকি রাষ্ট্রনায়কদের কেউ কেউ বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও অগ্রগতির চেষ্টা করেছিলেন। তাদের এবং আন্তর্জাতিকভাবে বৃহৎ শক্তিবর্গের সচেতন প্রচেষ্টার কারণে এ দুটি দেশের মধ্যে সীমান্তে বিক্ষিপ্ত গোলাগুলি এবং কারগিল সংঘর্ষের ঘটনা ছাড়া বড় ধরনের কোনো যুদ্ধ '৭১ সালের পর আর হয়নি। তবে এটাও সত্য, নব্বইয়ের দশকের শুরুতে শীতল যুদ্ধের অবসানের পর বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের মধ্যে উত্তেজনার পারদ হ্রাস পাওয়ার পরিবর্তে বৃদ্ধি পায়। তদানীন্তন জাতিসংঘ মহাসচিব বুট্রোস বুট্রোস ঘালির বক্তব্য থেকে এর সত্যতা মিলবে। তখন ঘালি বলেছিলেন, 'প্রতিদিনই জাতিসংঘকে রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরীণ সংঘাত-সংঘর্ষ, গৃহযুদ্ধ, দেশ-বিভক্তি, বিচ্ছিন্নতা, নৃগোষ্ঠীগত সংঘর্ষ ও উপজাতি সংঘর্ষজনিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে।' দক্ষিণ এশিয়ার পরিস্থিতিও এর থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না। ভারত ও পাকিস্তানের অভ্যন্তরেও বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র লড়াই, নৃগোষ্ঠীগত হানাহানি, ধর্মীয় উগ্রবাদী তৎপরতার অন্ত ছিল না। তবে পাকিস্তান যেভাবে ধর্মীয় উগ্রবাদী সন্ত্রাসে বিদীর্ণ হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে, ভারতের ক্ষেত্রে সামগ্রিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেনি। তবে উভয় দেশ নিজ প্রতিপক্ষের প্রতিটি দুর্বল মুহূর্তের সুযোগকেই কাজে লাগাতে চেষ্টা করেছে স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ হাসিলের নামে। সৌভাগ্যের কথা, বিদেশি প্রভাবশালী শক্তি এই অঞ্চলে অশান্তি বাড়তে দিতে রাজি ছিল না। অবশ্য ১৯৭২ সালে উভয় দেশের মধ্যে সম্পাদিত সিমলা চুক্তিও দেশ দুটির মধ্যে যুক্তিবাদী ধারণার জন্ম দিয়ে থাকবে। এরপর ১৯৮৫ সালে সার্ক গঠনের মধ্য দিয়ে চরম অশান্তির সময়ও শীর্ষ বৈঠকের ফাঁকে মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি হয়। ২০০৮ সালে মুম্বাই বোমা হামলার ঘটনায় পাকিস্তানি সন্ত্রাসী গ্রুপ ও গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই জড়িত রয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়ার পর ভারত দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক আলোচনা এবং যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। কিন্তু সার্ক কাঠমান্ডু বৈঠকে দু'দেশের প্রধানমন্ত্রী শীর্ষ বৈঠকের ফাঁকে দ্বিপক্ষীয় অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় মিলিত হয়ে আবার সম্পর্ক স্বাভাবিক করার সর্বাত্মক উদ্যোগ নেওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও উদ্যোগ এবং দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে ত্বরিত ও কার্যকর যোগাযোগের মাধ্যমে কথিত চিরবৈরী দুটি দেশ সম্পর্ক স্বাভাবিক ও উন্নত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যায়। ফলে যে শক্তিগুলো মুম্বাই হামলার মাধ্যমে দুটি দেশকে শত্রুর অবস্থানে রেখে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, তাদের কুমতলব সুবিবেচনার কাছে পরাস্ত হয়।
শেষ পর্যন্ত নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা স্থায়ী রূপ নেওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ওপর যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদীদের প্রশ্রয় না দেওয়ার জন্য ক্রমাগত কঠোর থেকে কঠোরতর চাপ প্রয়োগ করতে থাকার ঘটনাও ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক উন্নত হওয়ার পথে অবদান রাখে। চীনও এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকাই নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের মতো একই স্ট্র্যাটেজিক ভূমিকা পালনের জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী চীনকে রাজি করাতে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়। এই প্রক্রিয়ায় পাকিস্তানে অস্থিতিশীলতার শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্রের শক্তি জায়গা করে নেয়। পাকিস্তানের উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণী এ ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ শক্তি জোগায়। এভাবেই ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে কার্যকর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার সোপান তৈরি হয়ে যায়। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যপদে ভারত ও পাকিস্তানের পরস্পরকে সমর্থনদান, জাতিসংঘে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অভ্যর্থনা সভায় এই প্রথম ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর যোগদান এবং টেক্সটাইল ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পাকিস্তানের ওপর দেওয়া নিষেধাজ্ঞা অপসারণের বেলায় ভারত কোনো আপত্তি না জানানোয় দেশটির রফতানি ক্ষেত্রে বিপর্যয় কিছুটা হলেও সামাল দিতে সক্ষম হওয়ার ঘটনা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
অক্টোবরে ভারতের একটি জঙ্গি বিমান পাকিস্তানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে ঢুকে পড়ার পর সেটিকে ইসলামাবাদ এই প্রথমবারের মতো ভারতবিরোধী প্রচারণার অংশ করেনি। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এর রিফুয়েলিংয়ের ব্যবস্থা করে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পর আবার ভারতে ফিরে যাওয়ার বন্দোবস্ত করে দু'দেশের সম্পর্কোন্নয়নে তাদের সদিচ্ছার প্রমাণ দেয়। এর আগে এ ধরনের প্রতিটি ঘটনাতেই দুই দেশ একে অপরের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারে নামত। এ ঘটনাটিকে পাকিস্তান ও ভারতের ইতিবাচক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে টার্নিং পয়েন্টরূপে বিবেচনা করা যায়। ভারতকে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে 'মোস্ট ফেভারড নেশন' (এমএফএম)-এর মর্যাদাদানের সিদ্ধান্তটি যুগান্তকারী। এতে দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য স্বল্প সময়েই বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে পাকিস্তানে বিনিয়োগ বিশেষত বৈদেশিক পুঁজি বিনিয়োগের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে। ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির ফলে নতুন কর্মসংস্থান হবে। ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের সুবাদে পাকিস্তানের ফিকে হয়ে যাওয়া ইমেজটা পুনরুদ্ধারের পথ প্রশস্ত হবে। এতে ভারতও লাভবান হবে। মধ্য এশিয়া, এমনকি রাশিয়া ও ইরান থেকে পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে পাইপলাইনে ভারতের জ্বালানি চাহিদা মেটানো সহজ হবে। তা ছাড়া মধ্য এশিয়ায় ভারতের বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ বেড়ে যাবে। এতে উভয় দেশের মানুষের আসা-যাওয়াও বৃদ্ধি পাবে। চূড়ান্ত বিচারে দক্ষিণ এশিয়া উপকৃত হবে। সার্কের দ্রুত অভিন্ন বাজার অভিমুখে যাত্রা করার বাস্তব ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে এতে। আর আফগানিস্তান প্রশ্নে দুটি দেশ একই নিরাপত্তা বলয় গড়তে পারলে তো সম্পর্ক আরও উন্নত হবে।
৩৫ বছর পর কথিত দুই চিরবৈরী দেশের বাণিজ্যমন্ত্রীদের বৈঠকে মিলিত হওয়ার ঘটনা নিশ্চয়ই প্রতীকী নয়, পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা ও কার্যকর বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করার উদ্দেশ্যেই।
দক্ষিণ এশিয়ার এই দুটি দেশের সামনে কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে বিরোধ অবসানের বাস্তব পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। দুই দেশের জনগণ, কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো সমস্যা নিষ্পত্তির পক্ষে। গত বছরের নভেম্বরে ভারতীয় কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে পরামর্শক্রমে জঙ্গিদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর পাকিস্তানি কাশ্মীর ও অন্য এলাকায় অবস্থানকারী কয়েক হাজার জঙ্গি এই সুযোগ গ্রহণ করেছে। নিশ্চয়ই পাকিস্তান সেনাবাহিনী এসব জঙ্গির ভারতে ফিরে যাওয়ায় বাধা দেয়নি বলেই তাদের পক্ষে পুনর্বাসনের সুযোগ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে। এই পুনর্বাসন প্রক্রিয়া আরও বেগবান হলে এবং দুই কাশ্মীরের মধ্যে পণ্য ও মানুষের চলাচল অবাধ হয়ে গেলে এক দশকেই ওই অঞ্চলে শান্তি স্থায়ী রূপ নেবে।
দক্ষিণ এশিয়া আবার তার ইতিহাস-ঐতিহ্যের মূলে ফিরে যেতে চায়। বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান দোস্তি দক্ষিণ এশিয়ার স্বাভাবিক চালিকাশক্তি হিসেবে ঐতিহাসিক পথ ধরেই একের পর এক বাধার প্রাচীর ডিঙিয়ে যাবে। আমরা সেই মৈত্রী শকটের যাত্রী হতে
উদগ্রীব হয়ে আছি।

সুভাষ সাহা : সাংবাদিক
 

No comments

Powered by Blogger.