সময়ের প্রতিধ্বনি-আইভীর বিজয় এবং দুই নেত্রীর জন্য সতর্ক সংকেত by মোস্তফা কামাল

য়তু সেলিনা হায়াত আইভী। নবগঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচিত মেয়র, আপনাকে উষ্ণ অভিনন্দন। আমাদের জাতীয় রাজনীতি যখন হতাশায় নিমজ্জিত হতে যাচ্ছিল, তখন ধ্রুবতারার মতো জ্বলে উঠলেন আপনি। নতুন করে আশার আলো জ্বালালেন। আপনার কাছ থেকে আমাদের জাতীয় রাজনীতিরও অনেক কিছু শেখার আছে। রাজনীতি যে এখনো শেষ হয়ে যায়নি, তারই প্রমাণ রাখলেন আপনি।


আইভী এর আগে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ছিলেন। আট বছর নগরবাসীর কল্যাণে তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি আমাদের দেশের আর দশজন নেতা-নেত্রীর মতো নন। অতি সাদামাটা আটপৌরে বাঙালি নারী। তিনি নিজের বিত্ত-বৈভবের কথা চিন্তাও করেননি। নির্লোভ-নির্মোহ এবং নিবেদিতপ্রাণ এই রাজনীতিক সর্বদা দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর চিন্তায় বিভোর ছিলেন। নগরবাসীর সুখ-দুঃখের সব সময়ের সাথি ছিলেন। তাই তো তিনি হয়ে ওঠেন অতি সাধারণ মানুষের আপনজন।
দেশের এই সাধারণ মানুষের সেবার উদ্দেশ্যেই হয়তো তিনি ডাক্তারি পেশা বেছে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার চেয়েও বড় কিছুর হাতছানি ছিল তাঁর। তা ছাড়া রাজনীতি যাঁর রক্তে, তাঁকে কি কোনো বাধা আটকে রাখতে পারে! প্রবাসে তিনি সুখের জীবন কাটাতে পারতেন। কিন্তু তিনি নিজের সুখের কথা ভাবেননি। সবাইকে নিয়ে ভালো থাকার প্রত্যয় ছিল তাঁর। তাই তিনি ছুটে এলেন দেশে। বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করলেন। রাজনীতির জটিল ও কুটিল পথে পা বাড়ালেন। সেই পথটি মোটেই মসৃণ ছিল না। যেকোনো মুহূর্তে ফসকে যাওয়ার ভয় ছিল। কিন্তু তিনি নিজের সততা, কর্মদক্ষতা, মেধা ও মননের সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন পৌর মেয়র থাকাকালে। সাধারণ মানুষের জন্য তাঁর দরজা সব সময় খোলা ছিল। তিনি যেকোনো মানুষের বিপদ-আপদে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।
সাধারণত আমরা দেখি আমাদের নেতা-নেত্রীরা নির্বাচনের আগে সাধারণ মানুষকে অনেক প্রতিশ্রুতি দেন। অনেক রঙিন স্বপ্ন দেখান। কিন্তু নির্বাচনের পর আর তাঁদের খবর থাকে না। তাঁরা বেমালুম সব ভুলে যান। সাধারণ মানুষ তাঁদের চেহারাও আর দেখতে পায় না। এ ক্ষেত্রে আইভী ছিলেন পুরোপুরি ব্যতিক্রম। তিনি গতানুগতিক ধারার রাজনীতি করেননি। তাঁর রাজনীতি যে গণমানুষের জন্য, মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য_তারই প্রমাণ রেখেছেন। তিনি রাজনীতির নামে দলীয়করণ ও আত্মীয়করণ করেননি। কোনো বাহিনীও সৃষ্টি করতে হয়নি তাঁকে। তাঁর গণমুখী রাজনীতিই তাঁকে নিয়ে গেছে উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে। জনগণকে ভালোবাসলে যে জনগণ উজাড় করে দিতে জানে, তা-ই প্রমাণ করল নারায়ণগঞ্জবাসী।
প্রসঙ্গক্রমে বলতে চাই, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে উন্নীত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই পৌর মেয়র আইভী দলীয় সমর্থন প্রত্যাশা করেছিলেন। কিন্তু দলের সমর্থন তিনি পাননি। একইভাবে তাঁর বাবা আলী আহমদ চুনকাও ১৯৭৪ সালে পৌর চেয়ারম্যান নির্বাচনে দলীয় সমর্থন লাভে ব্যর্থ হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁকে সমর্থন না দিয়ে আওয়ামী লীগের আরেক নেতা খোকা মহিউদ্দিনকে সমর্থন দেন। এতেও দমেননি চুনকা। তিনি বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে পৌর চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করেন এবং বিপুল ভোটে বিজয়ী হন। পরে তিনি বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করে বলেন, বঙ্গবন্ধু আমি বিজয়ী হয়েছি। নারায়ণগঞ্জবাসী আমাকে বিজয়ী করেছে। জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমি জানতাম তুই-ই বিজয়ী হবি।
আইভীর ক্ষেত্রেও সেই একই ঘটনা ঘটল। আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা নিয়েও আইভী ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সমর্থন পেতে ব্যর্থ হয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন। লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী শামীম ওসমানকে হারিয়ে তিনি মেয়র নির্বাচিত হলেন। একই সঙ্গে তিনি দেশে নতুন ইতিহাস গড়লেন। হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতোই তিনি ভোটারদের নিয়ে এলেন ভোটকেন্দ্রে। আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে তাঁরা ভোট দিলেন এবং তাঁদের পছন্দের প্রার্থীকে জয়ের মালা পরালেন। সেই সঙ্গে নারায়ণগঞ্জবাসী সারা দেশের জনগণকে দেখিয়ে দিলেন, জনতার শক্তির কাছে অন্য কোনো শক্তির স্থান নেই। যেকোনো অপশক্তিকে জনতা গুঁড়িয়ে দিতে পারে। আইভীর বিজয়ের পর অবশ্য আওয়ামী লীগ নেতারা এখন সুর বদল করেছেন। কোনো কোনো নেতাকে বলতে শুনেছি, 'আমরা আসলে ওইভাবে কাউকে সমর্থন দিইনি।'
নির্বাচনে সেনা মোতায়েন না করার অজুহাতে বিএনপি শেষ মুহূর্তে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। যদিও প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার সরে দাঁড়াতে রাজি ছিলেন না। তিনি বললেন, সেনাবাহিনী ছাড়াও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব। আসলে বিএনপি ভেবেছিল, তারা প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিলে ভোটাররাও মুখ ফিরিয়ে নেবেন। ভোটকেন্দ্রে ভোটাররা যাবেন না। ফলে এই সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন যে সম্ভব নয়, তা প্রমাণিত হবে। কিন্তু বিএনপির চালে বড় ভুল ছিল। একইভাবে ক্ষমতাসীন দলও যে ভুল করেছিল তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন আইভী। তাঁর জনপ্রিয়তার কাছে সব কূটকৌশল ভণ্ডুল হয়ে গেল।
অথচ আমরা নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়ে কত নাটকীয় ঘটনা দেখলাম। আমরা জানি, সিটি করপোরেশন স্থানীয় সরকার নির্বাচন। এই নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া যায় না। এটাই নির্বাচন কমিশনের আইন। অথচ সেই আইনের বরখেলাপ করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। উভয় দলই পছন্দের প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতারা ছুটে গেছেন দলীয় প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে। আইভী দলীয় সমর্থন না পেলেও নারায়ণগঞ্জবাসী তাঁর পক্ষে ছিল। আইভীর পক্ষে যে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, তা নির্বাচন অনুষ্ঠানের কয়েক দিন আগেই আভাস পাওয়া গিয়েছিল। এ কারণে বিএনপি আইভীকে কাছে টানার চেষ্টা করেছিল। সেই চেষ্টায় ব্যর্থ হয় বিএনপি। বিএনপি এটাও আঁচ করতে পেরেছিল যে তাদের প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকারের ভাবমূর্তি ভালো নয়। তিনি নির্বাচনী দৌড়ে হয়তো তৃতীয় হবেন। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনে থাকা না থাকা সমান। তাই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর অজুহাত খুঁজছিল বিএনপি।
সেনা মোতায়েন না হওয়ায় বিএনপি তৈমূর আলম খন্দকারকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য চাপ দিয়েছিল। তিনি রাজি না হওয়ায় খালেদা জিয়া তাঁকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেন। এতে তিনি ক্ষুব্ধ। তার পরও তিনি গভীর রাতে সংবাদ সম্মেলন ডেকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিতে বাধ্য হন। তিনি এখন বারবারই বলছেন, নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়ে খালেদা জিয়া আমাকে জবাই করেছেন। তাঁকে কিছু নেতা ভুল বুঝিয়েছেন।
যা হোক, সেনাবাহিনী ছাড়া নির্বাচন হলে ব্যাপক গোলযোগ হবে এবং নির্বাচন ভণ্ডুল হয়ে যাবে বলে যে আশঙ্কা বিএনপি করেছিল, তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তা ছাড়া বিএনপি যে ইস্যু তৈরির চেষ্টা করেছিল সে ক্ষেত্রেও তারা ব্যর্থ হয়েছে। এখন নতুন করে রাজনীতির ছক কাটতে হবে বিএনপিকে। তাদের এখন গণমুখী রাজনীতির কথা মাথায় রেখে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে। রাজনীতি শুধু প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা, কূটকৌশলে প্রতিপক্ষকে ফাঁদে ফেলা কিংবা মিথ্যার বেসাতি নয়, রাজনীতির মূলমন্ত্রই হবে গণমানুষের কল্যাণ সাধন। সেই শিক্ষাই নতুন করে রাজনীতিকদের নিতে হবে।
আমাদের জাতীয় পর্যায়ের নেতা-নেত্রীরা বলে থাকেন, বাংলাদেশের মতো সমস্যাসংকুল দেশে কাজ করে জনপ্রিয়তা অর্জন করা সম্ভব নয়। আইভীর হাতে নিশ্চয়ই কোনো জাদুর কাঠি ছিল না। তিনিও এ দেশের শত সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করেছেন। তিনি কী করে মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান করে নিলেন! এ ক্ষেত্রে তাঁর সম্বল ছিল সততা, একাগ্রতা এবং কাজ করার ব্যাপারে পূর্ণ আন্তরিকতা। এমন রাজনীতিকই তো আমরা দেখতে চাই। দেশ তো তাঁরাই পরিচালনা করবেন। আমরা তো কোনো খাকি পোশাকধারীকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে দেখতে চাই না। তারা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবে। দেশের নিরাপত্তা বিধান করবে। আর রাজনীতিকরা দেশকে সঠিক পথে এগিয়ে নেবেন। দেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাবেন।
অথচ আমাদের জাতীয় রাজনীতি আজ কোন পথে! প্রধান দুটি দলের সম্পর্ক বিরোধপূর্ণ। দুই নেত্রীর মুখ দেখাদেখি বন্ধ। তাঁরা পরস্পরের প্রতি বিষোদগার আর রেষারেষিতে ব্যস্ত। দুই নেত্রীর সম্পর্ক শত্রুতাপূর্ণ বলে আওয়ামী লীগ-বিএনপির নেতা-কর্মী এবং সমর্থকদের মধ্যেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আজকে দেশ যে সংঘাতের দিকে ধাবিত হচ্ছে, তার মূলে দুই নেত্রীর বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক। দেশে যদি কোনো কারণে গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়ে, তারও দায় কিন্তু দুই নেত্রীকেই নিতে হবে। তাঁদের কারণে আবারও দেশে ওয়ান-ইলেভেনের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। কাজেই দেশের এবং তাঁদের নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই দুই নেত্রীর উচিত রাজনীতিকে সুস্থধারায় ফিরিয়ে আনা। তার সুফল দুই নেত্রীই পাবেন।
কারণ এ দেশে দ্বি-দলীয় রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। ঘুরে-ফিরে শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়াই ক্ষমতায় আসবেন। ১৯৯১ সালের পর থেকে এই ধারাই তো বহাল রয়েছে। তাঁদের জীবদ্দশায় হয়তো এ ধারাই চলতে থাকবে। এটা তাঁরা নিজেরাও জানেন। তাহলে কেন শুধু শুধু বিরোধের রাজনীতি? কেন জনগণকে নিয়ে এত ছিনিমিনি খেলা? তবে আমার আশা, এ দেশের জনগণই গণতন্ত্রকে অতন্দ্র প্রহরীর মতো রক্ষা করবে। আর সেই গণতন্ত্রের আলো ছড়াবে গণমাধ্যম।
পরিশেষে নবনির্বাচিত মেয়র আইভীর কাছে প্রত্যাশা, আপনি গণমুখী রাজনীতির যে ধারা সৃষ্টি করেছেন, তা টিকিয়ে রাখতে হবে আপনাকেই। চাটুকার, সুবিধাভোগী লোকরা যেন আপনাকে ঘিরে রাখতে না পারে। আপনি যেমন বলেছেন, 'আমি মেয়র নই, সেবক।' সেটাই আমরা আগামী দিনগুলোতে দেখতে চাই। আপনি যেন চিরদিন গণমানুষের নেত্রী হয়েই থাকতে পারেন, গণমানুষের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে পারেন_সেই প্রত্যাশা করছি। তিনি নিশ্চয়ই জানেন, সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধনের চেয়ে বড় সুখ আর কিছুতেই নেই। আমরা যেন তাঁকে উদ্দেশ করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলতে পারি,
'তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ,
তাই তব জীবনের রথ
পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমার
বারম্বার।'

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.