দেশে চিকনগুনিয়া রোগ, চিকিৎসা হচ্ছে ডেঙ্গুর! by তৌফিক মারুফ

দেশে হঠাৎ বিস্তার ঘটছে চিকনগুনিয়া রোগের। ডেঙ্গুর মতো একই প্রজাতির এডিশ মশাবাহিত জীবাণু থেকে এ রোগের উৎপত্তি। তবে ডেঙ্গুর চেয়েও দ্রুত এর বিস্তার ঘটে। দেশের চিকিৎসকরা এ রোগ সম্পর্কে সচেতন না থাকার ফলে রোগটির জন্য যথাযথ চিকিৎসা হয় না বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. বে-নজীর আহম্মেদ বলেন, চলতি মাসের শুরুতে ঢাকার অদূরে দোহারে এ রোগের


প্রাদুর্ভাব ধরা পড়ে। এরই মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এ রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারে চিকিৎসক ও জনসাধারণকে সচেতন করার জন্য নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
ডা. বে-নজীর আহম্মেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, চিকনগুনিয়া রোগটির লক্ষণ অনেকটাই ডেঙ্গুর মতো। তাই অনেক চিকিৎসক এ রোগকে ডেঙ্গু বলেই চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। আবার ডেঙ্গুর লক্ষণ থাকলেও পরীক্ষায় যেহেতু ডেঙ্গু ধরা পড়ছে না, তাই অনেক ক্ষেত্রেই রোগীকে অন্য কোনো চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। রোগী চিকনগুনিয়ায় আক্রান্ত কি না তা আর পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে না।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, চিকনগুনিয়ার রোগী পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। তবে এ রোগের কথা শুনেছি। এটা ডেঙ্গুর সময় হয়ে থাকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশের অন্যতম পরামর্শক ডা. আবদুল মান্নান বাঙ্গালী কালের কণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশের বেশির ভাগ চিকিৎসকের এ রোগটি সম্পর্কে ভালো ধারণা নেই। ফলে অনেকেই ডেঙ্গু হিসেবে ধরে চিকিৎসা দিয়ে থাকতে পারেন। এতে হিতে বিপরীত হয়।
অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহও এমন পরিস্থিতি হতে পারে বলে স্বীকার করে জানান, এ রোগটি সম্পর্কে চিকিৎসক ও সাধারণ মানুষকে বেশি করে জানানো উচিত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশের অন্যতম পরামর্শক জানান, বাংলাদেশে এ রোগের বিস্তার ইতিমধ্যেই বিশ্ব স্থাস্থ্য সংস্থা কাজ শুরু করেছে। জীবাণু শনাক্ত করতে দুই-এক দিনের মধ্যে বিশেষ উপকরণ দেশে এসে পেঁৗছবে, যা দিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ আরো কয়েকটি হাসপাতালে এর পরীক্ষা করা সম্ভব হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, পরিষ্কার জমানো পানিতে থাকা এডিশ মশা থেকে ডেঙ্গু হলেও চিকনগুনিয়া হয়ে থাকে নোংরা ও ময়লা পানিতে থাকা এডিশ মশার মাধ্যমে। চিকনগুনিয়ায় আক্রান্ত হলে জ্বরের সঙ্গে অত্যধিক দুর্বলতা ও শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জোড়ায় বা গিঁটে ব্যথা থাকে। শরীরের বিভিন্ন স্থানে ডেঙ্গুর মতো লালচে রাশ উঠতে পারে। এমনকি হাঁটাচলার মতো ক্ষমতাও সাময়িক খর্ব হয় এ রোগের কারণে। সাধারণত দুই থেকে ১২ দিন পর্যন্ত এ অবস্থা থাকতে পারে। তবে এ রোগে এখনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি বলে এ সূত্র নিশ্চিত করেছে।
ডা. আবদুল মান্নান বাঙ্গালী জানান, এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এর বিস্তার আছে। তবে ভারতে এ রোগের প্রাদুর্ভাব ব্যাপক। বিশেষ করে মহারাষ্ট্র, গুজরাট ও কর্নাটকে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৫ শতাংশ মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশে প্রথম এ রোগ দেখা যায় ২০০৮ সালে রাজশাহী, পবা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে। এবার চলতি মাসে দোহারে স্থানীয় চিকিৎসকরা কয়েকজন রোগীকে চিকনগুনিয়ায় আক্রান্ত বলে সন্দেহ করলে এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এর ভিত্তিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কাজ শুরু করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পুরো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। দেশের চিকিৎসক ও জনসাধারণকে সচেতন করাসহ মশা নিধন ও এডিশ মশার উৎপত্তি বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২৪৫ জনের রক্ত সংগ্রহ করে ৫২ জনের রক্ত পরীক্ষা করে ৩১ জনের দেহে চিকনগুনিয়ার জীবাণু পাওয়া যায়। চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৯৪ জনের নমুনা সংগ্রহ করে ৩০ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এ ক্ষেত্রে ১২ জনের দেহে চিকনগুনিয়া শনাক্ত হয়। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় তিনজন রোগীর দেহে চিকনগুনিয়া শনাক্ত করা হয়। এ ছাড়া আরো বেশ কয়েকটি স্থানে সরকারের আইইডিসিআর থেকে পাঠানো টিমের মাধ্যমে পরীক্ষা চলছে।
অধ্যাপক ডা. বে-নজীর আহম্মেদ বলেন, দেশের বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি হাসপাতালে বিদ্যমান আইসিটি, এলাইজা ও আরটি-পিসিআর প্রযুক্তির সাহায্যেই এ চিকনগুনিয়া রোগ শনাক্ত করা সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে কেবল আলাদা কিছু কিটস লাগে। যেটা বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আইইডিসিআরে রয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং কোনো হাসপাতাল বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গবেষণাগার থেকে এ রোগ শনাক্ত করা যাবে।
সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উদ্যোগে গত মঙ্গলবার এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয় অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখায়। এতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, আইইডিসিআর-সহ বিভিন্ন পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ ও প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় চিকনগুনিয়া রোগ প্রতিরোধে জরুরি ভিত্তিতে বিভিন্ন এলাকায় পর্যবেক্ষণ, চিকিৎসকদের অবহিতকরণ, জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণসহ আরো বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়। পাশাপাশি পর্যায়ক্রমে সারা দেশে পর্যবেক্ষণ ও সচেতনতা কার্যক্রম এবং পরীক্ষার ব্যবস্থা করার তাগিদ দেওয়া হয়।

No comments

Powered by Blogger.